ঝর্ণা মনি :
ভাদ্র মাসের পড়ন্ত বিকেল। রৌদ্রোজ্জ্বল আকাশের নিচে সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদবিরোধী সমাবেশ। তখন বিকেল ৫টা বেজে ২২ মিনিট। হঠাৎ বিকট শব্দে গ্রেনেড বিস্ফোরণ। এরপর খই ফোটার মতো ফুটতে থাকে একের পর এক গ্রেনেড। জনাকীর্ণ সমাবেশে মঞ্চ হিসেবে ব্যবহৃত ট্রাককে লক্ষ্য করেই ছোড়া হচ্ছিল গ্রেনেডগুলো। কিছু বুঝে ওঠার আগেই বিস্ফোরিত হয় ১৩টি গ্রেনেড। সেদিনের পৈশাচিক হামলার প্রধান টার্গেট ছিলেন গণতন্ত্রের মানসকন্যা, মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের ও অসাম্প্রদায়িক আন্দোলনের পুরোধা বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। পরিস্থিতির তাৎপর্য বুঝতে পেরে ট্রাকে অবস্থানরত নেতারা ও শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত দেহরক্ষীরা ঘিরে ফেলেন তাকে। প্রিয় নেত্রীকে রক্ষা করতে মানবঢাল রচনা করেন তারা। ভাগ্যক্রমে ঘাতকের গুলিবর্ষণ ও গ্রেনেড হামলা থেকে তিনি বেঁচে গেলেও, ভয়াবহ ওই ঘাতক বুলেটে আওয়ামী লীগ নেত্রী আইভি রহমানসহ চিরতরে হারিয়ে যায় ২৪টি তাজা প্রাণ। আহত হন ৪ শতাধিক নেতাকর্মী। লাশের মিছিলে স্বজনদের আহাজারি আর আহতদের চিৎকারে ভারি হয়ে ওঠে রাজধানীর পরিবেশ।
সেই বিভীষিকাময় ২১ আগস্ট আজ। রাজধানী ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে স্মরণকালের নৃশংসতম গ্রেনেড হামলার রক্তঝরা দিন। ২০০৪ সালের এই দিনে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করার ঘৃণ্য লক্ষ্যে পরিকল্পিতভাবে সংঘবদ্ধ গ্রেনেড হামলায় মেতে ওঠে ঘাতকের দল। বেদনাবিধুর স্মৃতিবহ সেই গ্রেনেড হামলার দিনটি আজ এমন এক পরিস্থিতিতে পালন করা হচ্ছে যখন টানা দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতাসীন শেখ হাসিনা।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগকে সমূলে ধ্বংস করার লক্ষ্যে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে সেনাবাহিনীর আদর্শচ্যুত কয়েকজন হিংস্র-লোভী-ঘাতক ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের সেই বাড়িটিতে সপরিবারে হত্যা করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। তারই ধারাবাহিকতায় ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করার হীন লক্ষ্যে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে নৃশংস গ্রেনেড হামলা চালিয়ে ঘটানো হয় নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। ইতিহাসের বর্বরতম সেই ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার দ্বাদশ বার্ষিকী আজ। বিগত বছরগুলোতে সেই হামলাকারী খুনিদের বিচার হয়নি। সে সময়ের ক্ষমতাসীন বিএনপি-জামায়াত জোটের রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের হীন চেষ্টা, হামলাকারীদের আড়াল করার লক্ষ্যে তদন্তের নামে নানারকম টালবাহানা এই ঘটনার সুবিচার পাওয়ার আশাকে করে তোলে সুদূর পরাহত।
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় এসে তদন্তের গতি সঠিক ধারায় নিয়ে এলে, সুবিচার পাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী হয়ে উঠেছেন সংশ্লিষ্টরা। তদন্তে একের পর এক বেরিয়ে আসে সেদিনের হামলার ঘটনার সঙ্গে মৌলবাদী জঙ্গিচক্র ও সে সময়ের বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের নেতাদের সংশ্লিষ্টতার কথা। তবে সেই নারকীয় হত্যাযজ্ঞের নেপথ্য নায়করা আজো রয়ে গেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।
ফিরে দেখা ২১ আগস্ট ২০০৪ : ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট, সেদিন ছিল শনিবার। বিকেলে বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে শুরু হয় আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশ। প্রধান অতিথি ছিলেন আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ও সে সময়ের সংসদে বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা। সমাবেশ শেষে সন্ত্রাসবিরোধী মিছিল হওয়ার কথা। তাই মঞ্চ নির্মাণ না করে আওয়ামী
লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে একটি ট্রাককে মঞ্চ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সমাবেশে অন্য নেতাদের বক্তৃতার পর বক্তৃতা করেন শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনার বক্তৃতার শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বিকট শব্দে একের পর এক গ্রেনেডের বিস্ফোরণ ঘটতেই থাকে। হামলাকারীরা যখন বুঝতে পারল গ্রেনেড জখম করতে পারেনি শেখ হাসিনাকে, তখন গুলি ছুড়তে শুরু করল তারা। নেতারা ও দেহরক্ষীরা দ্রুত মানবঢাল রচনা করে শেখ হাসিনাকে তার বুলেটপ্রুফ গাড়িতে তুলে দেন। এ সময় শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে ছোড়া হয় পর পর ৬টি বুলেট। ভাগ্যক্রমে বুলেট থেকেও রক্ষা পান শেখ হাসিনা। তবে বুলেটবিদ্ধ হন শেখ হাসিনাকে পেছন থেকে আগলে রাখা তার ব্যক্তিগত দেহরক্ষী মাহবুব। গাড়িতেও একাধিক বুলেট আঘাত হানে। গ্রেনেড বা বুলেটের আঘাতে শেখ হাসিনা আহত না হলেও, গ্রেনেডের বিকট শব্দে তার কানের শ্রবণযন্ত্র মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
মৃত্যুর মিছিলে অকুতোভয় সৈনিকরা : সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে এসে সন্ত্রাসীদের গ্রেনেডে নির্মমভাবে হত্যাকা-ের শিকার হন আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক আইভি রহমান, কেন্দ্রীয় উপকমিটির সহসম্পাদক মোস্তাক আহমেদ সেন্টু, শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত নিরাপত্তাকর্মী ল্যান্স কর্পোরাল (অব.) মাহবুবুর রশীদ, মহানগর আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা রফিকুল ইসলাম (আদা চাচা), মহানগর মহিলা আওয়ামী লীগের (দক্ষিণ) কর্মী সুফিয়া বেগম, ১৫নং ওয়ার্ড মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হাসিনা মমতাজ রীনা, মাদারীপুর জেলার ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি লিটন মুন্সী, রি-রোলিং মিল ব্যবসায়ী রতন সিকদার, ৩০নং ওয়ার্ড শ্রমিক নেতা মো. হানিফ, সরকারি কবি নজরুল কলেজের দ্বিতীয়বর্ষের ছাত্র মামুন মৃধা, ৬৯ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগ সহসম্পাদক বেলাল হোসেন, আমিনুল ইসলাম মোয়জ্জেম, স্বেচ্ছাসেবক লীগের আবদুস কুদ্দুস পাটোয়ারী, যুবলীগ নেতা আতিক সরকার, শ্রমিক লীগ কর্মী নাসিরউদ্দীন সরদার, মহিলা আওয়ামী লীগের রেজিয়া বেগম, বালুঘাট ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ, আবুল কাশেম, মমিন আলী, শামসুদ্দিন, ইছহাক মিয়া এবং অজ্ঞাতনামা আরো দুজন। ২৪ জন নিহত হওয়া ছাড়াও সেদিন আহত হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারাসহ ৪ শতাধিক নেতাকর্মী। কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে আহত হন আমির হোসেন আমু, আব্দুর রাজ্জাক, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, এডভোকেট সাহারা খাতুন, ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর, মোহাম্মদ হানিফ, সাবের হোসেন চৌধুরী, সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহম্মেদ, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ প্রমুখ।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ছিল ঠুঁটো জগন্নাথ : ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে পরিকল্পিত হামলায় ১৩টি গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটে এবং সমাবেশস্থলে ও এর আশপাশে বেশ কয়েকটি গ্রেনেড অবিস্ফোরিত অবস্থায় পাওয়া যায়। সুপ্রশিক্ষিত হামলাকারীরা সমাবেশস্থলের জনতার সঙ্গে মিশে গিয়ে এবং বিপরীত দিকের ভবন থেকে একের পর এক গ্রেনেড ছোড়ে। পরে হামলাকারীদের একটি গ্রুপ মঞ্চ হিসেবে ব্যবহৃত ট্রাকের খুব কাছে থেকে শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে গুলি করে। হামলার বীভৎসতায় মুহূর্তেই রক্ত-মাংসের স্তূপে পরিণত হয় বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের সমাবেশস্থল। সেদিন সমাবেশস্থল ও এর আশপাশে কয়েকশ সশস্ত্র পুলিশ এবং বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা কর্তব্যরত থাকলেও, রহস্যজনকভাবে সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয় হামলাকারীরা। পুলিশ কাউকে আটক তো করতে পারেইনি; বরং হতাহতদের উদ্ধারে এগিয়ে আসা নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের ওপর ব্যাপকভাবে লাঠিচার্জ এবং টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ করে হামলাকারীদের নিরাপদে পালিয়ে যেতে সহযোগিতা করে। পরবর্তী সময়ে মামলার তদন্তেও সে সময়ের ক্ষমতাসীনদের নির্দেশে ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নেয় পুলিশ।
প্রকৃত খুনি ও অপরাধীদের আড়াল করার হীন উদ্দেশে জজ মিয়া নামক এক অপ্রকৃতিস্থ ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে এবং তদন্তকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার অপপ্রয়াস চালায়। এই ন্যক্কারজনক কর্মকা-ে সে সময়ের সরকারি মদদপুষ্ট সন্ত্রাসী জঙ্গিগোষ্ঠী ছাড়াও বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শীর্ষস্থানীয় নেতাকর্মীরাও প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিল। তাই ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার প্রকৃত অপরাধী এবং হুকুমের আসামিদের যথোপযুক্ত দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি আজ সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে।