লরেন্স লিপশুলজ বিবিসির সংবাদদাতা হিসেবে বাংলাদেশে অনেকবার গিয়েছেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন তিনি। মেজর জিয়ার রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলসহ কর্নেল তাহেরের ফাঁসির সংবাদও বহির্বিশ্বে তুলে ধরেন তিনি। কর্ণেল তাহেরকে ফাঁসির মামলার প্রত্যক্ষ্য সাক্ষী হিসেবে হাইকোর্টে সাক্ষী দিয়েছেন। সম্প্রতি নিউইয়র্কে লরেন্স লিফ শুলাজের একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধ গবেষক সাংবাদিক রণেন্দ্র তালুকদার পিংকু। হাওরটুয়েন্টিফোরডটনেটের পাঠকদের উদ্দেশ্যে আজকালে প্রকাশিত সাক্ষাৎকারটি প্রকাশ করা হলো।
পিংকু : জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে কাছ থেকে দেখেছেন, তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন অনেকবার, তাকে কিভাবে মূল্যায়ন করেন?
লরেন্স লিফ শুলাজ : বঙ্গবন্ধু আপনাদের নেতা ছিলেন, ছিলেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি। এ জন্য আপনারা গর্ববোধ করতে পারেন। আমি বিশ্বের বহু দেশে ঘুরেছি। ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, লাওসের মতো যুদ্ধবিধস্ত দেশে ঘুরে সংবাদ সংগ্রহ করেছি। আমি বিশ্বের কোথাও তাঁর মতো এমন অবিচল নেতা দেখিনি। বিশাল বড় মাপের নেতা ছিলেন তিনি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সাধারণ রাজাকারদের ক্ষমা করে দেন তিনি। তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল বিশ্বের বিভিন্ন দেশে স্বাধীনতা বিরোধীদের বিচার হচ্ছে, কিন্তু আপনি ক্ষমা করে দিচ্ছেন। জবাবে মুজিব আমাকে বলেছিলেন, আমি একটি আইন করেছি সেটি দালাল আইন, এই আইনে যারা সরাসরি বাংলাদেশের বিরোধীতা করেছে, বাঙালিদের হত্যা করেছে তাদের বিচার করা হবে। নিরীহ মানুষ যারা ১৯৭১ সালে অনেকে প্রাণের ভয়ে অনেকে না বুঝে যুদ্ধের বিরোধিতা করেছে অর্থাৎ সাধারণ নাগরিকদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে দিয়েছি। খুনি, ধর্ষক, অগ্নিসংযোগকারীদের ক্ষমা নয়।
পিংকু : ১৯৭৫ সালে জাতির জনককে নৃশংসভাবে সপরিবারে খুন করা হয়। আপনি সে সংবাদ কভার করেছেন। এ বিষয়ে একটু জানতে চাই।
লরেন্স লিফৎ শুলাজ: ফার ইকনোমিস্ট রিভিউ পত্রিকায় আমি একটি সংবাদ প্রকাশ করি। সেই পত্রিকায় লিখেছিলাম খন্দকার মোশতাক সপরিবারে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে। বঙ্গবন্ধু হত্যায় কিসিঞ্জারের হাত ছিল। ১৯৭১ সালে কিসিঞ্জার যখন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধিতা করে ব্যর্থ হন তখন থেকেই বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। প্রায় ৪ বছর পর তার পরিকল্পনা সফল হয়। এর অন্যতম কুশিলব ছিল কিসিঞ্জার।
খন্দকার মোশতাক ছিল তার এজেন্ট। মোশতাককে দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করায় কিসিঞ্জার। আমি রজারের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করি। রজার কিসিঞ্জারের সিকিউরিটি ছিল। তার বক্তব্য থেকে জানতে পারি কিসিঞ্জার পাকিস্তানের পক্ষে সরাসরি সহায়তা করেছেন। বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের স্বাধীনতালাভে ক্ষুব্দ ছিল সে। সেই ক্ষোভ থেকেই হত্যা পরিকল্পনায় যুক্ত ছিল কিসিঞ্জার।
পিংকু : বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে আমেরিকার বিরোধিতা করার কারণ কি ছিল?
লিফ শুলাজ : ১৯৭১Ñএ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রেসিডেন্ট নিক্সন ও তার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার ইয়াহিয়া খান ও তার দোসরদের বাঁচাতে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে আণবিক যুদ্ধের ঝুঁকি নিতেও প্রস্তুত ছিলেন। ১৯৭১ সালে ওয়াশিংটনে স্পেশাল একশন গ্রুপের আলোচনার অন্যতম বিষয় ছিল বাংলাদেশ প্রশ্ন। পাকিস্তানে মার্কিন অস্ত্র পাঠানো যাবে না মার্কিন কংগ্রেসের এই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে নিক্সন প্রশাসন যে সামরিক অস্ত্র ও সরঞ্জাম পাঠায়। কিসিঞ্জার একাত্তরে বাংলাদেশ যুদ্ধের সময় ইয়াইয়ার মাধ্যমে চীনের সাথে গোপন দূতিয়ালির কাজ করেছিলেন। খুব ধূর্ত লোক ছিল কিসিঞ্জার। তার কাজে সেগুলো সে প্রমাণ করেছে। সে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদ্বয়ের প্রতি বিরুপ ছিল।
পিংকু: বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর মোশতাক এবং পরবর্তীতে মেজর জিয়া বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে কর্নেল তাহেরসহ অনেক মুক্তিযোদ্ধা অফিসারকে তড়িঘড়ি করে ফাঁসি দিলে, আপনি তাহের হত্যা মামলা সাক্ষ্য দিয়েছেন। একটু বর্ণনা করবেন?
লরেন্স লিফ শুলাজ: দেখুন বাংলাদেশে আমি অনেক দিন অবস্থান করছিলাম। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা, খন্দকার মোশতাককে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল এবং পরবর্তীতে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের শাসনভার গ্রহণ করে তড়িঘড়ি করে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তাকে ফাঁসি দিয়ে দিলো। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কর্নেল তাহের। মেজর জিয়াকে যখন বন্দী করা হয় তখন কর্নেল তাহের তাকে ৭ নভেম্বর উদ্ধার করেন, তাকে বাঁচান। জিয়ার ভেতর একটা ভয় কাজ করতো এবং তিনি মনে করতেন কর্নেল তাহের বেঁচে থাকলে নির্বিঘেœ ক্ষমতা প্রয়োগ করা যাবে না। তাই তিনি তাহেরকে ফাঁসি দিয়ে দিলেন, পথের কাটা মনে করে সরিয়ে দিলেন। আমি কর্নেল তাহেরকে যে অবৈধভাবে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে সেই মামলার সাক্ষী দিয়েছি এবং সেই মামলায় ফাঁসি যে অবৈধ তা প্রমাণ হয়েছে। মজার ব্যাপর হলোÑ তাহের জিয়াকে প্রাণে বাঁচিয়েছে অথচ জিয়া তাকে ফাঁসি দিয়ে দিলো।
পিংকু : আপনি বাংলাদেশের আদালতপাড়ায় ছিলেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে আন্তর্জাতিক রীতিনীতি কতোটা মানা হচ্ছে।
লরেন্স লিফ শুলাজ : দেখুন আমি আগেই বলেছি। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলো আমি ঘুরেছি। আমি ভিয়েতনামসহ অনেক দেশের বিচার প্রক্রিয়া দেখেছি। বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা প্রত্যক্ষ করেছি। এমনকি একটি মামলায় সাক্ষী ছিলাম। বাংলাদেশে অনেক আইনজীবী আছেন আন্তর্জাতিক মাপের। বিচারের আগে ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামদের নিয়ে একটা কাউন্সিল বা বোর্ড গঠন করলে এবং যুদ্ধ বিধ্বস্ত কম্বোডিয়া, লাওস, ভিয়েতনামের বিচার প্রক্রিয়া অনুসরণ করলে আরো আন্তর্জাতিক মানের হতো। কিন্তু সেটা মনে হয় রাজনৈতিক আদর্শের কারণে সম্ভব না।
পিংকু : যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কি সঠিক হচ্ছে না?
লরেন্স লিফ শুলাজ : যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হোক সেটা আমিও চাই। যে কোন বিচারেই প্রশ্ন থাকে। প্রশ্ন থাকাটাই স্বাভাবিক। তবে যুদ্ধাপরাধীর বিচার হচ্ছে এটাই বড় কথা।