এ আর জুয়েল::
জাগৃতি প্রকাশনীর প্রকাশক দীপন হত্যার প্রধান পরিকল্পনাকারী সুনামগঞ্জের ছাতকের মইনুল হাসান শামীম ওরফে জঙ্গি শামীম। তার মা সালেহা বেগম সন্তানের এই অধপতনে এখন কাঁদছেন আর হা-হুতাশ করে বলছেন,‘আমার শান্ত- বিনয়ী ছেলেটিকে যারা জঙ্গি তৈরি করেছে তাদের কঠোর শাস্তি দেখতে চাই আমি। এদের শাস্তি হলে আর কোন মা’কে এভাবে কাঁদতে হবে না। সন্তান যে হারায় সে বুঝতে পারে কেমন বেদনা। আমার সন্তান এমন পথে গেছে, এটি বিশ্বাস করতেই আমার কষ্ট হচ্ছে’। বৃহস্পতিবার দুপুরে ছাতকের কালারুখা ইউনিয়নের মাধবপুরে শামীমদের (সংগঠনে যার কয়েকটি টেক নাম ছিল শিফাত, শামীম ও ইমরান) বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে শোকাবহ পরিবেশ। মা একস্থানে বসে, ভাই আবু জাফর টিপু আরেক স্থানে বসে কাঁদছেন। পরিবারের কেউ-ই বিশ্বাস করতে পারছেন না, এমন দুর্র্ধষ জঙ্গি হন্তারক তাদের শামীম। তারা এই প্রতিবেদককে জঙ্গি হয়ে ওঠা শামীম সম্পর্কে অনেক কিছুই জানালেন।
মাধবপুর গ্রামের এক সময়ের ত্যাগী আওয়ামী লীগ নেতা মরহুম আব্দুল কদ্দুছ’এর ৬ সন্তানের মধ্যে সবার ছোট মঈনুল হাসান ওরফে শামীম ওরফে শিফাত। ২০১০ ইংরেজি সালে ছাতকের গোবিন্দগঞ্জ কলেজের আশপাশে হিজবুত তাহ্রিরের লিফলেট বিতরণের সময় পুলিশের হাতে প্রথম গ্রেপ্তার হয়েছিল সে। এরপর ৮ মাস জেল খেটে ছাতকের জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আদালত থেকে ১ বছরের জন্য জামিনে মুক্তি পায় শামীম। শেষে হাইকোর্ট থেকে দীর্ঘ মেয়াদে জামিন নেয় সে। পরিবারের সদস্যরা বলেছেন- শামীম হিযবুত তাহ্রিরের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল, এমন বিষয়টি আঁচ করতে পেরে পারিবারিকভাবে তাকে শাসন করা হয়েছে। তাঁর ব্যবহারের লেপটপ, মোবাইলও কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। তার চাল-চলনে অসঙ্গতি দেখে পরিবারের পক্ষ থেকে তাকে নানাভাবে নিবৃত করার চেষ্টা করা হয়। বলা হয়েছিলÑ যারা এসব করাচ্ছে, তারা শয়তানের দল। এক পর্যায়ে সিলেট নগরে জামায়াতের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসাবে পরিচিত শাহ্জালাল জামেয়া হাইস্কুল থেকে থেকে এসএসসি পাস করার পর মদন মোহন কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে সে। পড়াশুনায় মনোযোগি হওয়ায় তার প্রতি পরিবারের লোকজনের আস্থা বাড়ে এবং তাদের ধারণা হয়েছিল সে ভাল পথে চলে এসেছে। গত রমজানের প্রথম দিকে সর্বশেষ ছাতকের বাড়িতে আসে শামীম। কিন্তু রমজানের ঈদেও বাড়ি আসেনি সে। বাড়িতে যোগাযোগও কমিয়ে দেয় সে। টিভিতে বিজ্ঞাপন দেখে প্রথম পরিবারের এবং গ্রামের লোকজন জানতে পারেন শামীম বড় অপরাধ কর্মে জড়িয়ে পড়েছে।
শামীমের মা সালেহা বেগম কাঁদতে কাঁদতে বলেন,‘আমার বুক শুকিয়ে গেছে, মুখ দিয়ে কোন কথা আসছে না, আমার বাচ্চারে (ছেলেকে) যারা ই-পথে নিছে আমি তারার বিচার চাই’।
শামীমের বড় ভাই আবু জাফর টিপু বলেন, ‘টিভিতে আমি প্রথম দেখি আমার ভাই এতো বড় অপরাধ কর্মে যুক্ত হয়ে পড়েছে। সে এতো বড় সন্ত্রাসী হয়ে গেছে এটি বুঝতেই পারিনি আমরা। আমাদের ধারণা তাকে ড্রাগ খাইয়ে এই পথে নেওয়া হয়েছে। যারা এটি করেছে তারা ভাল মানুষ নয়’।
গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা গিয়াস উদ্দিন বলেন,‘আমি তাকে পড়াতাম, হঠাৎ একদিন ডাক্তারে যাবে বলে গ্রাম ছেড়ে যায়, আর আসেনি’।
গ্রামের দোকানী মোহাম্মদ আলী বলেন,‘৫ বছর আগে একবার এতেকাপে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। এরপর ৫ বছরের মধ্যে বাড়িতে আসলে তার সঙ্গে দেখা হয়নি বা রাস্তা-ঘাটেও তাকে দেখিনি।
গ্রামের শিক্ষার্থীরা জানান, গত কয়েকদিন ধরেই এলাকার স্কুলগুলোতে সভা সমাবেশ করে জানিয়ে দেওয়া হচ্ছিল শামীমের জঙ্গি হবার কথা এবং সবাই যেন এ বিষয়ে সতর্ক থাকে। এটি কোন ভাল পথ নয়।
গ্রামের হাজী কমর আলী উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী ইসলাম উদ্দিন বলেন,‘কয়েকদিন আগে ছাতকের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা স্কুলে এসে সভা করে বুঝিয়ে গেছেন জঙ্গিদের থেকে সাবধান থাকতে হবে। এই গ্রামেরই ছেলে শামীম জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে জড়িয়েছে। সেও এই স্কুলের অন্য ছেলেকে টার্গেট করতে পারে, সকল শিক্ষার্থী ও অভিভাবক এই বিষয়ে সাবধান থাকতে হবে’।
প্রসঙ্গত. মঙ্গলবার রাতে টঙ্গির চেরাগ আলী মার্কেটের সামনে থেকে শামীম ওরফে সিফাতকে গ্রেপ্তার করে পুলিশের গোয়েন্দা ও অপরাধ তথ্য বিভাগ (ডিবি)। ঢাকার প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান জাগৃতির কর্ণধার ফয়সল আরেফীন দীপন হত্যা ঘটনার কিলারগ্রুপের নেতা ছিলো শামীম।