1. haornews@gmail.com : admin :
  2. editor@haor24.net : Haor 24 : Haor 24
শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:৩৯ অপরাহ্ন
সংবাদ শিরোনাম ::

ডায়মন্ড এবং নীল।। মো. তারিকুল ইসলাম

  • আপডেট টাইম :: বুধবার, ১৭ অক্টোবর, ২০১৮, ৫.২১ এএম
  • ২৭৬ বার পড়া হয়েছে

১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারি অথবা মার্চ মাস। আমি তখন সাত আট বছরের শিশু । বড়ভাই সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজের ছাত্র।সিন্ধান্ত হলো আমাকে সুনামগঞ্জ পিটিআই সংলগ্ন পরীক্ষণ বিদ্যালয়ে ভর্তি করা হবে ।ঠিক হলো পরের দিন বড়ভাইয়ের সাথে সুনামগঞ্জ যাব।মনে এক ধরণের কৌতুহল কাজ করছিল-কেমন হবে আমার অদেখা স্কুল ।পাশাপাশি প্রিয় বন্ধুদের ছেড়ে যেতে কিছুতেই মন মানছিল না।বলা যায় প্রায় অষ্ট প্রহরের সাথী ডায়মন্ডকে ফেলে যেতে মনটা ব্যথাতুর হয়ে উঠেছিল।
জন্মের পর থেকেই ডায়মন্ডকে আমাদের বাড়িতে দেখছি ।আঠার আঙুল আর সাধারণের ছেয়ে লম্বা লেজের সরাইলের গ্রে হাউন্ড।ডায়মন্ড ছিল বহু গুনে গুনান্বিত -বিশ্বস্থ, প্রভুভক্ত,প্রাণবন্ত এবং চলাফেরায় রাজকীয় ।আমাদের পরিবারের সকলের প্রিয় ছিল এই প্রাণীটি ।পরিবারের প্রত্যেককে সে চিনত এবং তার নিরাপত্তায় অতন্দ্র থাকতো ।কুকুরকুলের কৌলিন্যের ধারক তার দীর্ঘ ঝুলানো কান এবং উপরের দিকে বাক খাওয়া লেজ উচিয়ে সে যখন হাটতো কিংবা দৌড়াত তখন এক ধরণের বিরল বিশেষত্ব চোখে ধরা পড়তো।শুনেছি পার্শবর্তী গ্রাম দত্তগ্রামের ঠাকুরবাড়ি থেকে তাকে আনা হয় আতুরঘরে থাকা অবস্থায়।তখনও নাকি তার চোখই ফোটেনি ।কিন্তু তার মালিক প্রিন্স অব আনোয়ারপুর লোকমান হেকিম এবং তাঁর পরামর্শক পর্ষদের দেখাশোনায় ডায়মন্ড বড় হতে থাকে পরম আদরে।যে পরিবারে শুকনো মওসুমে চার পাঁচটা গাভী বাচ্চা দিত সেখানে দুধের অভাব না হওয়াটাই স্বাভাবিক ।সুতরাং সেই সময়ের নৌকাকৃতি দুদিক থেকে নিপল লাগানো ফিডারে দুধ খাওয়ানো হত ডায়মন্ডকে ।লোকমান হেকিম পৈতৃক ডাবল ব্যারেল বন্দুক দিয়ে প্রচুর পাখি শিকার করতেন । মাংশ খাওয়ার মত বয়স হওয়ার পর এই শিকার করা পাখির একটা বড় অংশ যেত ডায়মন্ডের পেটে ।
সরাইলের এ গ্রে হাউন্ড গুলো এমনিতেই সাধারণ কুকুরের ছেয়ে আকারে বড় হয়।তাজা মাছ মাংশ আর দুধ পেটে পড়ায় ডায়মন্ডের দৈর্ঘ্য প্রায় পাঁচ ফুট ছাড়িয়ে গিয়েছিল।শিশু ডায়মন্ডের ফিডার ধোয়ার জন্যই নাকি একজন লোক সারাদিন ব্যস্ত থাকতো।লোকমান হেকিম তাঁর ঘরের মেঝেতে গর্ত করে সেখানে খড় ছড়িয়ে দিয়েছিলেন যাতে ডায়মন্ডের সুখনিদ্রায় ব্যাঘাত না ঘটে।ছোট কুকুরেরা ঘুমানোর জন্য প্রবেশপথ ছাড়া চারিদিক ঢাকা গর্ত পছন্দ করে।তাই লোকমান হেকিম বাশের টুকরা গর্তের উপর বসিয়ে তার উপর ছাটাই বিছিয়ে দিয়ে মাটি
দিয়ে এমনভাবে গর্ত ঢেকে দিয়েছিলেন যে গর্তটিতে একটি গুহা গুহা ভাব এসে গিয়েছিল ।এ গুহায় ডায়মন্ড তার মালিকের স্নেহছায়ায় সিংহের মেজাজ নিয়ে বড় হতে লাগলো ।মালিকের প্রতি তার ভালবাসা , ভক্তি ও আনুগত্য ছিল অনির্বচনীয় ।সম্ভবত ১৯৭৩ সালে লোকমান হেকিম যখন গণিত বিভাগে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেওয়ার জন্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যান তখন বাড়ি থেকে বিদায়ের সময় মালিকের প্রতি ডায়মন্ডের আকুতি আজও আমার মনে পড়ে। হাওরে পানি না থাকায় এবং মেঝ চাচীর হাটার অভ্যাস না থাকায় নদীপথে বেশ খানিকটা পথ পাড়ি দিয়ে লঞ্চে উঠতে হয়েছিল। ডায়মন্ডকে কোনভাবে নিবৃত্ত করা যাচ্ছে না ।আমার সেজচাচা লোকমান হেকিমের মন খুব খারাপ ।ডায়মন্ডের দিকে তাকাচ্ছেন না । ডায়মন্ডকে কোনভাবে ডাঙায় রেখে নৌকা ভাসানো হলো ।সুরমার শাখা নদী ধরে আমাদের নৌকা এগুতে লাগলো।নদীর তীর ধরে দুলকি চালে এগুচ্ছে ডায়মন্ড ।চাচা মুখ ঘুরিয়ে বসে আছেন যাতে ডায়মন্ডকে দেখা না যায়। নদীর দুই তীরের দূরত্ব ক্রমশ বাড়তে লাগলো সেই সাথে বাড়ল গভীরতা ।নৌকার খুব কাছ থেকে হুম করে শব্দ করে দুটি শুশুক হঠাৎ লাফিয়ে উঠলো।পথে খাওয়ার জন্য মায়ের বানিয়ে দেওয়া ঘি এবং বিরুম চালের রাইস বলটা আমার হাত থেকে ভয়ে পড়ে গেল ।ভয়ে কুকরে আমি মেজচাচীর কাছে গেলাম।ওদিকে ডায়মন্ড তার মালিক যে তাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে ন সেটা ভেবে করুন বিলাপে আর্তনাদ করে উঠলো ।
১৯৭২ সালে আমার বড় ভাইয়েরা সবাই সুনামগঞ্জ চলে যান ।সেখানকার স্কুলে ভর্তি হন সবাই। তারপর চাচা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সুতরাং ডায়মন্ড চলে আসে আমার জিম্মায়।তার খাওয়া দাওয়া এবং ক্ষেত্র বিশেষে থাকার ব্যবস্থা আমাকেই করতে হয় । আমি তা করি খুব খুশি মনে ।মাঝে মাঝে সে আমার সাথে স্কুলে যেত ।স্কুল ছুটি অবধি বারান্দায় বসে ঝিমুত।সহপাঠীদের সাথে খেলতে গিয়ে মাঝে মাঝে ঝগড়াও বেধে যেত।সে সময় ডায়মন্ড আমার পক্ষ নিয়ে তার গা দিয়ে ঠেলে আমার প্রতিদ্বন্দীকে এক পাশে সরিয়ে দিত ।তারপরেও প্রতিদ্বন্দী মারমুখো হলে তাকে কামড়ে দেয়ার ভান করে ভয় দেখাতো।
মনে পড়ে এক শীতের সকালে আমার বাবা গোসল সেরে গায়ে নারকেল তেল মাখছিলেন।
আমি পাশের তক্তপোষে বসে মুড়ি খাচ্ছিলাম , পাশে বসা ডায়মন্ড ।মুড়ির ভাগ তাকেও দিচ্ছিলাম ।আদুরে ভঙ্গিতে সে তার গা আমার পায়ে ঘসে ঘসে গরম করছিল । মুড়ি চিবুচ্ছিলাম আপন মনে ।হঠাৎ আমাদের পাওয়ার পাম্পের ড্রাইভার মান্নান মিয়া আসার সাথে সাথে আমার বাবা তাকে কিল ঘুষি মারতে লাগলেন।ঘটনার আকস্মিকতায় আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম । বাবার খেদোক্তিতে রহস্যের জট খুলল-হারামজাদা বল, কয় লিটার ডিজেল চুরি করে বিক্রি করেছিস?
বাবার হাত থেকে ড্রাইভারকে বাচাতে আব্বাস নামের আমাদের এক চাচাত ভাই আসলেন দুই হাত উচু করে বাবাকে থামাতে ।আর তখনই ডায়মন্ড যাদু দেখাল । সে ভাবলো বাবাকে আক্রমন করতে এসেছেন আব্বাস ভাই ।আর যায় কোথায় । মুহু্র্তের মধ্যেই পিছনের দুই পায়ের উপর ভর করে সামনের দুই পা রাখলো আব্বাস ভাইয়ের দুই কাধের উপর ।আর মুখটা রাখলো আব্বাস ভাইয়ের মুখের কাছে ।মনে হলো এটি একটি সতর্ক অবস্থা জারি করলো-আব্বাস ভাইকে বুঝিয়ে দিল- যথেস্ট হয়েছে -আর একটু এগুলেই আমার লম্বা দাতগুলো দিয়ে তোমার গালে চুমু খাব।বাবা , মান্নান মিয়া এবং আব্বাস ভাই তিন জনই এ ঘটনায় স্তম্ভিত হয়ে গেলেন।তারপরই শব্দ করে হাসলেন বাবা- আব্বাস বাবার সাথে হাসিতে যোগ দিলেন আর মাথা নিচু করে দাড়িয়ে মান্নান মিয়া মনে হয় মার খেয়েও কিছুটা হাসলেন ।এরই ফাকে ডায়মন্ড কখন যে তার জায়গায় এসে তার গা আমার পায়ে ঘসতে লাগলো টেরই পায়নি।
ডায়মন্ড বয়োপ্রাপ্ত হলো। এর মাঝে দেখা গেলো নীলমন নামে তার এক জুলিয়েট ঝুটে গেল।দুজনের প্রণয়কে বাড়িসুদ্ধ সবাই স্বীকৃতি দিল ।আমার বাবা প্রতিদিন সকাল আটটায় নাস্তা সেরে রওয়ানা দিতেন সুলমানপুরের উদ্দেশ্যে ।এই সুলমানপুরে ছিল আমাদের রাইসমিল ।কৃষির পরেই এই রাইসমিলটি ছিল আমাদের আয়ের একটা বড় উৎস।বাবা সকালে ঘোড়ায় চড়ে রওয়ানা হয়ে সুলমান পুর সারাদিন কাটিয়ে রাতে বাড়ি ফিরতেন । সাথে টাকা পয়সাও থাকতো । তাই রাতে বাড়ি ফেরাতে একটু নিরাপত্তাজনিত ঝুকি থাকতো ।ডায়মন্ড ও নীলমন মাঝে মাঝে দৌড়তে দৌড়তে বাবার সাথে সুলমানপুর চলে যেত।উদ্দেশ্য আনন্দ ভ্রমন নয় বরং মালিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ।বাবার মুখে শুনেছি রাতে ঘোড়াযোগে বাড়ি ফেরার সময় ডায়মন্ড ও নীলমন ঘোড়াকে মাঝে রেখে তাদের একটি সামনে অপরটি পিছনের দিকে দুশ গজের মত দৌড়ে আবার ঘোড়ার কাছে আসত ।এর মাধ্যমে তারা বাবাকে জানিয়ে দিত সামনে পিছনে অন্তত
চারশ হাত জায়গা নিরাপদ আছে।প্রভূভক্তির এমনই হাজারো ঘটনা আছে ডায়মন্ড ও নীলমনকে নিয়ে।
আমরা জানি কুকুরের ঘ্রাণশক্তি অত্যন্ত প্রখর।ডায়মন্ড ও নীলমন ছিল এক্ষেত্রে সাধারনের ছেয়ে এগিয়ে ।আর এ বিষয়টিকে কাজে লাগিয়েছিলেন ডায়মন্ডের মালিক লোকমান হেকিম।তিনি ডায়মন্ড ও নীলমনকে ঝোপে লুকায় এমন পাখির গন্ধ খুজে বের করার প্রশিক্ষণ দেন।প্রশিক্ষণের প্রথম পর্যায় ছিল এমন -ধানী জমির পাশে অপেক্ষাকৃত উচু জায়গাতে লম্বা ঘাস কিংবা ঘাস জাতীয় গুল্মের ঝোপের চারিদিকে কিছু ছেলেকে চিকন লম্বা বাশ হাতে দাড় করিয়ে দেন।আর একটি লাঠি তিনি ঝোপে আঘাত করেন।ঝোপে লুকিয়ে থাকা কুড়া পাখি উড়ে পালানোর সময় দাড়িয়ে থাকা একটি ছেলের চিকন বাশের আঘাতে মাটিতে পড়ে ডানা ঝাপটাতে থাকে ।এই অবস্থায় ডায়মন্ড ও নীলমন পাখিটিকে ধরে ফেলে।এতে প্রাণী দুটি একই সাথে দুটি বিষয় শিখে ফেলে । একটি হচ্ছে পাখিটির গন্ধ সনাক্ত করার ক্ষমতা আর অপরটি হচ্ছে পাখিটি লুকানোর সম্ভাব্য জায়গা খুজে পাওয়ার ক্ষমতা ।
শহরে পড়ুয়া আমাদের মত গ্রামের ছেলেরা যখন শীতের ছুটিতে বাড়ি আসতাম তখন কুকুর ব্যবহার করে পাখি শিকার করা ছিল আমাদের একটি ভাল অবসর বিনোদন।শিকার করতে গিয়ে সারাদিন চিকন লম্বা বাশ নিয়ে কুকুরের পিছন পিছন ছুটটাম-পাখির মাংশের যোগান পেতাম-ক্ষুধা বাড়তো-পেটপুরে খেতাম-রাতভর শান্তির ঘুম ঘুমাতাম।

( চলবে)

(লেখাটি লেখকের ফেইসবুক থেকে নেওয়া)

Print Friendly, PDF & Email

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর
themesbazarhaor24net
© All rights reserved © 2019-2024 haor24.net
Theme Download From ThemesBazar.Com
error: Content is protected !!