বছরভর জন ইস্যুতে সবসময়ই বামরা সোচ্চার থাকে। আমরা যাদেরকে ভোট দেই, বিদ্যুৎ বিল বাড়ালে কি রেলের ভাড়া বাড়লে সেই বড় বড় পার্টিরা স্পিকটি নট থাকলেও বামরা সেগুলো নিয়ে সাধ্যমতো প্রতিবাদ করেন। সুন্দরবনের ঘন জঙ্গল থেকে বঙ্গোপসাগরের তলদেশ পর্যন্ত যত ইস্যু আছে সেগুলো নিয়ে বামরা সবসময়ই কর্মব্যস্ত। কিন্তু ভোটের মাঠে এসে তাঁরা আর আলোচনায় থাকেন না। অথচ এই বামরা নির্বাচনী মাঠে অনেকের জন্য ভোট দেয়ার একটি কার্যকর বিকল্প হতে পারতেন। তাঁরা কেন পারছেন না, সে বিষয়ে আমার দুই ছটাক পর্যবেক্ষন-
১. ব্র্যান্ডিং প্রবলেম -১ : বামরা বছর ভর বিভিন্ন ব্র্যান্ডে কাজ করেন। যেমন বড় বড় বামদলগুলো কখনো ‘সিপিবি-বাসদ’, কখনো বাম ঐক্যজোট, কখনো বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট, ( সরি, এই জোটগুলোর নাম আমারই খেয়াল নেই) কখনো শুধুই সিপিবি বা বাসদ বা নিজ নিজ পার্টির নাম, কখনো তেল-গ্যাস-বিদ্যুত-বন্দর রক্ষার নাম, এভাবে বিভিন্ন নামে এসে হাজির হন। এদের ছাত্র সংগঠনগুলোও কখনো নিজ নামে, কখনো জোটের নামে আবার কখনো ‘সাধারন ছাত্র’ ব্যানারে কাজ করে থাকে।
যারা মার্কেটিং নিয়ে কাজ করেন, তাঁরা জানেন যে এই যে হরেক নামে কাজ করা, এটি ব্র্যান্ডিংয়ের জন্য ক্ষতিকর। সাধারন মানুষের এতো সময় নেই যে এই সব ব্র্র্যান্ড আলাদা আলাদা ভাবে চিহ্নিত করে মনে রাখবে। বামরা দীর্ঘমেয়াদে সিঙ্গেল ব্র্যান্ডিং স্ট্রাটেজিতে না গিয়ে মাল্টি ব্র্যান্ডিং স্ট্রাটেজিতে গেছে, কিন্তু কন্টিনিউটি না থাকলে এবং ব্র্যান্ড রিইনফোর্স না করলে মাল্টি ব্র্যান্ডিংয়ের রেজাল্ট জিরো, এটি উনারা মাথায় রাখেননি।
২. চিহ্নিত করার মতো নেতা : দুনিয়ার সবখানে রাজনীতির বড় চিহ্ন হচ্ছে নেতা। নেতা চিহ্নিত থাকলে মানুষের পক্ষে বুঝতে সুবিধা হয়। এজন্য দেখবেন মান্নার দলে এক কুড়ি মানুষ না থাকলেও মানুষ মান্নাকে চিনে, কাদের সিদ্দিকীকে চিনে কিন্তু বামদের শীর্ষ নেতা কে, সেটি চট করে বলতে পারবে না। আপনি আশেপাশের যে কাউকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন যে সিপিবির নেতা কে, খুব সম্ভবত কেউ জোর গলায় বলতে পারবে না। আমি সেদিন আড্ডায় এটা পরীক্ষা করেছি, কেউ পরিস্কার ভাবে বলতে পারেনি। বামরা দীর্ঘমেয়াদে নেতার আইডেন্টিটি তৈরিতে মনোযোগ দেননি, এটা তাঁদের করা উচিত ছিল।
৩. হরেক ইস্যুর ডিপার্টমেন্টাল স্টোর : ঐ যে বললাম, সুন্দরবন থেকে সমুদ্রতল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে কাজ করা, এর ফলে মানুষ পরিস্কার হতে পারছে না যে বামদের কোর ভ্যালু এডিশনটা কী? এগুলো এক্টিভিজমের ইস্যু, রাজনীতির মূল ইস্যু হতে পারে না।
৪. ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্নের অভাব : আমি যেসব বাম বন্ধুদের চিনি, তাঁদের মধ্যে আমি রাষ্ট্র ক্ষমতায় যাওয়ার কি সরকার গঠনের কোনো তাড়া কখনো দেখি না। তাঁদের কোনো নির্দিষ্ট টাইম লাইন নাই। আপনি বিএনপি আওয়ামী লীগ এদের যে কোনো কর্মীকে জিজ্ঞেস করেন যে তাঁরা কবে ক্ষমতায় যেতে চায়, একেবারে ওয়ার্ড পর্যায়ের একটা কর্মীও বলবে, নেক্সট ইলেকশনেই আমাদের জিততে হবে ভাই। এই যে অবচেতনে তাঁরা জানে যে তাঁদের টাইমলাইন সামনের ইলেকশন ( সেটা যখনই হোক) এটি দ্বারা তাঁদের কাজকর্ম নিয়ন্ত্রিত হয়। তাঁদের লক্ষ্য পরিস্কার। কিন্তু বামরা বলতে পারবে না যে ২০১৮ কি ২০৬৮তে তাঁরা ক্ষমতায় যাওয়ার প্ল্যান করছে । এর ফলে তাঁদের কাজকর্ম অনেকটাই লক্ষহীন মনে হয় সাধারন মানুষের কাছে।
৫. পাবলিক পারসেপশন : বামদের সম্পর্কে জনমনে সাধারন ধারনা হলো, এরা সবাই বসেই আছে আল্লাহকে গালি দেয়ার জন্য। এই ভুল ধারনা ভাঙ্গার ব্যাপারে বামরা সক্ষম হননি। তাঁদের রাজনীতির সাথে যে ধর্মের বন্ধুত্ব-শত্রুত্ব কিছুই নাই, তাঁরা জনতার ইস্যু নিয়ে কাজ করতে চান, এটি তাঁরা স্টাবলিশ করতে পারছেন না। এমনকি জামাতের সব মিডিয়া বন্ধ হয়ে গেলেও তারা বাশের কেল্লা দিয়ে কমিউনিকেশনটা জোরালো ভাবে ধরে রেখেছে, বামদের কোনো ওল্ড মিডিয়া, নিউ মিডিয়া কিছুই নেই।
এই পর্যবেক্ষনটি হয়তো আমার অনেক বাম বন্ধুকে রাগান্বিত করবে। কিন্তু ডান সাইডে বসে এগুলোই আমার সাদা চোখের পর্যবেক্ষন। এই দেশের বাম রাজনীতিতে অনেক নিবেদিত প্রাণ বাম নেতা কর্মীকে দেখেছি, যারা সত্যিকার অর্থেই ফুলটাইম জনতার জন্য কাজ করার আগ্রহ নিয়ে রাজনীতি করেন। তাঁদের মধ্য থেকে কিছু নেতা কর্মী যদি এই রাষ্ট্র পরিচালনার বিভিন্ন অংশে, স্থানীয় সরকার থেকে সংসদ পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে কিছু ভুমিকা রাখার সুযোগ পেতেন, তাহলে সেটা রাজনীতির জন্য খারাপ হতো না। মানুষের কাছে যত বেশি অপশন থাকবে, শাসক দলগুলো ততো বেশি সতর্ক থাকবে।
কিন্তু এই সুযোগটা বামরা যদি নিজেরা তৈরি করতে না পারেন, তাহলে বড়ই দুঃখের বিষয়।
প্রতিটি নির্বাচনে তাঁদের জামানত হারানো দেখতে ভালো লাগে না।
(লেখকের ফেইসবুক টাইম লাইন থেকে নেওয়া)
লেখক: সাংবাদিক, ব্লগার ও অনলাইন এক্টিভিস্ট।