শামস শামীম:
১৯৭১ সনে দেশমাতৃকার ডাকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করায় মুক্তিযোদ্ধা বজলুল মজিদ চৌধুরী খসরু, মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ান ও মালেক হুসেন পীরকে ত্যাজ্যপুত্র করেছিলেন তাদের পিতারা। পাকিস্তানীদের এদেশীয় দোসররা খানসেনাদের মাধ্যমে তাদের ত্যাজ্যপুত্র করতে বাধ্য করেছিল। পরিবারের উপর জুলুম নির্যাতনের ভয়ে পিতারাও আদরের সন্তনকে তখন ত্যায্যপুত্র করেছিলেন। তারপরও তাদের পিতাদের ক্যাম্পে ডেকে নিয়ে ধমক দেওয়া হয়েছিল। মানসিক শাস্তি দেওয়া হয়েছিল।
মুক্তিযোদ্ধা বজলুল মজিদ চৌধুরী খসরু তখন সরকারি কলেজের ছাত্র। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান থেকেই রাজপথে সক্রিয় তিনি। বাম আন্দোলনের সক্রিয় কর্মীও ছিলেন। প্রতিরোধ যুদ্ধের শুরু থেকেই দেশের পক্ষে আন্দোলন সংগ্রামে তার উপস্থিতি ছিল। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে সেলা সাবসেক্টরে যুক্ত হন। ৬নং ব্যাচের এই যোদ্ধা মাঠে যুদ্ধ করার পাশাপাশি অফিসিয়াল কাজ করেন দক্ষতার সঙ্গে। মুক্তিযোদ্ধা বজলুল মজিদ চৌধুরী খসরু জানান, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের খবরে স্থানীয় স্বাধীনতাবিরোধীরা তার পরিবারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে থাকে। কিভাবে পরিবারের উপর প্রতিশোধ নেওয়া যায় এবং তার পিতাকে সামাজিকভাবে লাঞ্চিত করা যায় সেই চেষ্টা করতে থাকে। এক পর্যায়ে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর কানে তোলে বিষয়টি। তারা তার পিতা লক্ষীপুর গ্রামের সম্ভ্রান্ত পরিবারের বাসিন্দা মফিজুর রহমান চৌধুরীকে ডেকে নেয়। পুত্রকে ধরিয়ে দিতে নির্দেশ দেয়। কিন্তু তিনি ধরাছোয়ার বাইরে থাকায় বাধ্য করে তাকে ত্যাজ্যপুত্র করতে। পিতা মফিজুর রহমান চৌধুরী পাকিস্তানীদের হাত থেকে পরিবারকে বাঁচাতে ছেলেকে লিখিতভাবে ত্যাজ্যপুত্র করতে বাধ্য হন। তারপরও পিতাকে মানসিকভাবে অশান্তি দিয়েছিল হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা।
মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ান ছিলেন তখন দশম শ্রেণির ছাত্র। ছিলেন ছাত্রলীগের মহকুমা কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। শহরতলির বাসিন্দা হিসেবে প্রতিরোধ যুদ্ধ থেকেই সক্রিয় ছিলেন। তার পিতা আব্দুল হেকিম তালুকদার ছিলেন জেলার সম্মানীত ব্যক্তি। ছিলেন গৌরারং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান। একজন নামডাকি বিচারক হিসেবে তার প্রসিদ্ধি ছিল। ২০ মে বাড়ি থেকে পালিয়ে মায়ের কাছ থেকে দোয়া নিতে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। এই খবরে স্থানীয় স্বাধীনতাবিরোধী ও তাদের দোসররা ক্ষুব্দ হয়। স্থানীয় সরকারের অংশ হিসেবে তার পিতাকে কিভাবে অপদস্থ করা যায় সেই তৎপরতা শুরু করে। ডেকে আনে পিটিআই টর্চার সেলে। তাকে মানসিকভাবে অপমান করে। ছেলেকে ধরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেয়। কিন্তু ছেলে তার আয়ত্বের বাইরে থাকায় তিনি কথা রাখতে না পারায় তাকে প্রাণেহত্যার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। পরে স্বাধীনতাবিরোধী কয়েকজন লোক পাকিস্তানীদের মাধ্যমে ছেলে আবু সুফিয়ানকে ত্যাজ্যপুত্র করার আহ্বান জানায়। পরিবার ও নিজেকে বাচাতে তিনি সেই সুযোগ নেন। প্রাণপ্রিয় ছেলেক লিখিতভাবে ত্যাজ্যপুত্র করেন। আবু সুফিয়ান প্রথম ব্যাচের অগ্রপথিক মুক্তিযোদ্ধা।
মুক্তিযোদ্ধা মালেক হুসেন পীরও ছিলেন দশম শ্রেণির ছাত্র। ছিলেন রাজনীতি সচেতন কিশোর। তিনি ছাত্রলীগের রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন। শহরের বাসিন্দা হিসেবে রাজনৈতিক সব ঘটনাই তাকে ছুঁয়ে যেতো। প্রত্যক্ষ করতেন ঘটনাগুলো। সেই সচেতনতা থেকেই দেশের পক্ষে নিজেকে নিয়োজিত করেন। প্রতিরোধ যুদ্ধ থেকেই সম্পৃক্ত ছিলেন তিনি।
মালেক হুসেন পীরও ২০ মে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। প্রথম ব্যাচের গেরিলা যোদ্ধা ছিলেন তিনি। ছেলে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করায় পিতা মছব্বির হোসেন পীরকে বাধ্য করে ছেলেকে ফিরিয়ে দিতে। বারবার চাপ সৃষ্টি করেছিল তারা। তাকে মানসিক অশান্তিতে রেখেছিল পাকিস্তানী হানাদার ও তাদের এ দেশীয় দোসররা। এক পর্যায়ে পরিবার বাঁচাতে বাধ্য হয়ে ছেলে মালেক হুসেন পীরকে লিখিতভাবে ত্যায্যপুত্র করেছিলেন তিনি। ত্যায্যপুত্রের সেই লিখিত স্মারক এখনো সংরক্ষণ করে রেখেছেন মালেক হুসেন পীর। এই স্মারকটি তিনি ঢাকায় মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরে দান করে দিয়েছেন।