1. haornews@gmail.com : admin :
  2. editor@haor24.net : Haor 24 : Haor 24
শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:৫৭ অপরাহ্ন
সংবাদ শিরোনাম ::

শিখা অনির্বানটা জ্বালিয়ে রাখছেন যারা।। মারুফ রসুল

  • আপডেট টাইম :: সোমবার, ১৭ ডিসেম্বর, ২০১৮, ১.১৬ পিএম
  • ৩১৮ বার পড়া হয়েছে

এক
২০০২ সাল। আমরা তখন গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুলের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী। ক্লাসের অনেকের মতোই নবম-দশম শ্রেণির কেবল সমাজ বইটাই নীলক্ষেত থেকে কিনেছিলাম। অন্য কোনো বই না কিনলেও কেবল সমাজ বইটি কিনতে হয়েছিলো কারণ এই বইয়ের ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ’ অধ্যায়ে স্বাধীনতার ঘোষক হিশেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম কেটে সেখানে জিয়াউর রহমানের নাম দেয়া হয়েছিলো। তখন স্বাধীনতার ঘোষক হিশেবে জিয়াউর রহমানকে প্রতিষ্ঠার জন্য তার ছবিসহ ‘আমি মেজর জিয়াউর রহমান….’ লেখা একটি পোস্টারে পুরো ঢাকা শহরের দেয়াল ভরিয়ে ফেলা হয়েছিলো।
তখন মোহম্মদ রাজ্জাকুল হায়দার স্যারের বাসা ছিলো সেন্ট্রাল রোড। স্যারের কাছে আমরা বাঙলা পড়তে যেতাম। একদিন বিকেলবেলা দেখি স্যারের বাড়ির দেয়ালে টাঙানো এই পোস্টার তিনি টেনে টেনে ছিঁড়ছেন আর বলছেন— সাহস থাকলে শূন্যস্থানটা সত্য কথা দিয়ে পূরণ করুক।
রাজ্জাক স্যার ছিলেন আমাদের প্রজন্মের সবচেয়ে জনপ্রিয় শিক্ষক। আমরা কয়েকজন ছিলাম সেখানে। দৃশ্যটি এক লহমায় আমাদের কোথায় যে নিয়ে গিয়েছিলো! সেই ইতিহাস বিকৃতির সময়ে এক রাজ্জাকুল হায়দার স্যার আমাদের ধরে ধরে মুক্তিযুদ্ধের বই পড়াতেন। এ যেনো ছিলো তাঁর আরেক মুক্তিযুদ্ধ।
দুই
২০০৪ সাল। মার্চ মাস। আমরা তখন ঢাকা কলেজে একাদশ শ্রেণির ছাত্র। সকাল-বিকাল ক্যাম্পাসে ছাত্রদল আর ছাত্র শিবিরের মিছিল দেখি। ওই বছরই বইমেলা থেকে ফেরার পথে অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের ওপর মৌলবাদী সন্ত্রাসীরা আক্রমণ করেছিলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন তুমুল প্রতিবাদ চলছে। সে সময়ে ঢাকা কলেজ ক্যাম্পাসে অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ সম্বন্ধে যা-তা লিখে কমলা রঙের লিফলেট বিলি করেছে হিযবুত তাহরীর। মার্চ মাসে ছাত্র শিবির হুমায়ুন আজাদের বিরুদ্ধে মিছিল করেছে। গোটা ক্যাম্পাসে রাজাকার নিজামী-মুজাহিদের ছবিওয়ালা পোস্টার ছিলো। এসব দেখে মন খারাপ হতো। ওই একটা বয়স— মন খারাপ হলে, হতাশ হলে যা হয়…।
তখন আমরা ফিজিক্স পড়তে যেতাম রানা স্যারের কাছে। এলিফ্যান্ট রোডের ভোজ্য তেলের গলিতে স্যার পড়াতেন। সকাল আটটায় যেতাম। এক মিনিট এদিক-ওদিক হবার ছিলো না। স্যারের নিয়ম খুব কড়া। পড়ানোর বাইরে কোনো কথাই সাধারণত স্যার বলতেন না। ক্রমাগত খারাপ নম্বর পাবার কারণে স্যার আমাকে একদিন এর কারণ জিজ্ঞেস করলেন। আমি কী কী বলেছিলাম আজকে আর মনে নেই; তবে স্যার বলেছিলেন তাঁর মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতার কথা। রানা স্যার এখনও বেশ গুছিয়ে সবকিছু করেন। সেদিনও তিনি তাঁর কথা শেষ করেছিলেন আমাকে একটা প্রশ্ন করে— শহিদ জননী জাহানারা ইমামের বাসা কিন্তু এদিকেই, তুমি চেনো? স্যারের বাসা থেকে বের হয়ে আমি সেদিন শহিদ জননীর বাসাটা খুঁজে বের করেছিলাম। আজকে বুঝতে পারি, একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক রানা চৌধুরী সেদিন কী গেরিলা অপারেশনটাই না চালিয়েছিলেন আমার মগজে।
তিন
২০০৬ সালের সম্ভবত আগস্ট মাস। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে সদ্য ক্লাস শুরু হয়েছে। ‘এ’ গ্রুপের ব্যবহারিক ক্লাসের শিক্ষক ছিলেন হোসনে জাহান আপা এবং নাসরীন শামস আপা। আমরা হোসনে জাহান আপাকে খুব ভয় পেতাম। নাসরীন আপা বকাও দিতেন না, ব্যবহারিক খাতায় স্বাক্ষরও করতেন না। হোসনে জাহান আপা যখন খুব শাসন করতেন, নাসরীন আপা তখন আমাদের বাঁচিয়ে দেয়ার কাজটি করতেন।
ব্যবহারিক ক্লাসে মাঝে মাঝেই শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলতেন শিক্ষকগণ। তখন আমরা তাঁদের টেবিলের কাছে গোল হয়ে দাঁড়াতাম। হোসনে জাহান আপাই কথা বলতেন অধিকাংশ সময়ে। একদিন কী বিষয়ে কথা শেষ হবার পরও দু’ একজন দাঁড়িয়েছিলাম। সম্ভবত উপস্থিতি বা খাতায় স্বাক্ষর সংক্রান্ত কোনো বিষয় হবে— আমার মনে নেই। আমাদের এক সহপাঠী তখন পনেরোই আগস্ট প্রসঙ্গে কোনো একটি কটু মন্তব্য করেছিলো।
সেদিন আমি একজন নাসরীন আপাকে দেখেছিলাম। ছেলেটিকে তিনি ডেকে আনলেন। তারপর তিনি তার কথার পক্ষে যুক্তি জানতে চাইলেন। সে খুব ক্যাজুয়ালি— যেনো এটা কোনো ব্যাপারই না— এমন একটি ভাব নিয়ে কথা বলছিলো। আর নাসরীন আপা শান্ত স্বরে ওর কথাগুলো কতোটা অর্থহীন তা প্রমাণ করে যাচ্ছিলেন। তিনি চাইলে দু’টো ধমক দিয়ে ওকে বিদায় করতে পারতেন কিন্তু পুরোটা সময় শান্ত স্বরে ওর সবগুলো কথার জবাব দিলেন, পাল্টা প্রশ্ন করলেন। তারপর কথা শেষ করলেন— তুমি নিজে কি বুঝতে পারছো, তুমি ভুল করেছো। সে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে বলেছিলো— সরি ম্যাডাম। আপা এই কথাটিরও একটি উত্তর দিয়েছিলেন কিন্তু আমি শুনতে পাইনি। যার কথা বলছি, তার কাছেই অনেকদিন পর শুনেছিলাম— আপা বলেছিলেন, ‘সে সরি টু ইউ। নিজে নিজেকে ক্ষমা করতে পারো কি না দেখো’। আমার সেই সহপাঠীই আমাকে বলেছিলো— সে নিজেকে ক্ষমা করতে পারেনি।
চার
এই দীর্ঘ কথাগুলো লিখলাম কারণ— রাজ্জাকুল হায়দার স্যার এখনও ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন, বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেন। রানা চৌধুরী স্যার এখনও তাঁর সহযোদ্ধাদের সঙ্গে তাঁর স্মৃতি, তাঁর যুদ্ধদিনের অভিজ্ঞতার কথাগুলো লেখেন। প্রতি বছর ১৪ জানুয়ারি নাসরীন আপাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে যখন ফোন করি, সব কথার পর আপা জিজ্ঞেস করেন— আজকাল কী লিখছো, কী নিয়ে কাজ করছো।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির একটি ভয়াবহ সময় থেকে এই শিক্ষকদের হাত ধরে আমার মতো অসংখ্য শিক্ষার্থী প্রতি মুহূর্তে একটি আগামী বাঙলাদেশের স্বপ্ন দেখেছে। রাজাকার নিজামী-মুজাহিদের মন্ত্রীত্বের অসহায় সময় থেকে এদের বিচারের রায় কার্যকরের বাঙলাদেশের দিকে আমরা একটু একটু করে হেঁটেছি। প্রতি বছরের চৌদ্দই ডিসেম্বর শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবসকে স্মরণ করতে করতে আমিও ভাবি— সেই অনন্য মানুষগুলো বেঁচে থাকলে আমাদের শিক্ষা-গবেষণা-শিল্প-সাহিত্য— সকল ক্ষেত্রে আরও এগিয়ে যেতে পারতাম। এই হতাশার সময়ে আবারও রাজ্জাক স্যার, রানা স্যার, নাসরীন আপার কথা ভাবি। সারা বাঙলাদেশে এমন অনেক শিক্ষক আছেন, যাঁরা আমাদের মগজে এখনও মুক্তিযুদ্ধ করে চলেছেন। আমার মতো অসংখ্য শিক্ষার্থীকে বিবর্ণ হতাশা থেকে টেনে আনছেন আলোর দিকে…নতুন বাঙলাদেশের দিকে।
এই শিক্ষকদের দস্তখত আমি আমার বুক পকেটে রাখি। কেননা, তাঁদের কাছ থেকেই তো জেনেছি— অন্ধকার গাঢ় হলেও এটুকু ভুলতে নেই যে, শিখা অনির্বানটা জ্বলছেই। বিভ্রান্তির অজস্র পথ থাকলেও ভুলতে নেই— মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পথটিই শাশ্বত।

জয় বাঙলা।

(লেখকের ফেইসবুক টাইম লাইন থেকে নেওয়া)

Print Friendly, PDF & Email

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর
themesbazarhaor24net
© All rights reserved © 2019-2024 haor24.net
Theme Download From ThemesBazar.Com
error: Content is protected !!