বিশেষ প্রতিনিধি::
নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা ও সমাবেশ শেষ করে এখন প্রতীক্ষায় আছেন আওয়ামী লীগ-বিএনপি জোটের প্রার্থীরা। গত ১০ বছরের সুনামগঞ্জের ৫টি আসনে বড় বড় প্রকল্প গ্রহণ, দৃশ্যমান উন্নয়ন ও কৃষকের ভাগ্যোন্নোয়ন এবং উপকারে নেওয়া নানা প্রকল্প গ্রহণ করে সুসংহত অবস্থানে আছে আওয়ামী লীগ। ঐক্যের শক্তিতে ভোটের মাঠে এগিয়ে থেকে নৌকার জোয়ার তুলে প্রচারণা শেষ করে এখন বিজয়ের প্রহর গুণছে তারা। অন্যদিকে বিএনপি জোটের প্রার্থীরাও ৫টি আসনের দুটিতে ভাগ বসাতে চাচ্ছে। নানা অভিযোগ, মামলা-হামলার কথা বলেও বিজয়ের স্বপ্ন দেখছে তারা। এদিকে শান্তিপ্রিয় সাধারণ ভোটাররা চেয়েছেন শান্তি ও সম্প্রীতির ঐতিহ্যের প্রতিনিধিত্বের এই অঞ্চলে শেষতক শান্তিপূর্ণ ভাবেই যেন ভোটগ্রহণ সম্পন্ন হয়।
সুনামগঞ্জ-১ (তাহিরপুর, ধর্মপাশা ও জামালগঞ্জ উপজেলা) নিয়ে গঠিত আসনটি জেলার বৃহত্তম আসন। ৩ লাখ ৯৯ হাজার ৩৫৯জন ভোটারের এই আসনে জমজমাট প্রচারণা শেষ করেছেন আওয়ামী লীগ প্রার্থী। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির হেভিওয়েট প্রার্থী নজির হোসেনকে বিপুল ভোটে পরাজিত করে বিজয়ী হয়ে সবাইকে চমকে দিয়েছিলেন সর্বকনিষ্ট সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোয়াজ্জেম হোসেন রতন। গত ১০ বছরে হাওর অধ্যুষিত এই এলাকায় রাস্তাঘাট, সেতু ও কালভার্টসহ দৃশ্যমান উন্নয়ন করে আলোচনায় আছেন তিনি। বিশেষ করে সীমান্ত এলাকার সংযোগ উন্নত করতে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর থেকে দেশের সর্ববৃহৎ সেতু যাদুকাটা নদীতে অনুমোদন ও কাজের উদ্বোধন করায় মানুষ তার উপরে খুশি। হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধ নির্মাণের কাজে একজন উচ্চকণ্ঠী নেতা হিসেবে তিনি পরিচিত। তাছাড়া তার উদ্যোগে নির্বাচনী এলাকার নিজস্ব ৩৭টি কার্যালয় প্রতিষ্ঠা করে তৃণমূল নেতৃবৃন্দকে ঐক্যবদ্ধ ও উজ্জীবিত রেখেছে দলের হাই কমা-েরও আস্থা অর্জন করেছেন তিনি। তিনি শুরু থেকেই প্রচারণায় মাঠ গরম করে রেখেছেন। তার সঙ্গে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী সাবেক সাংসদ নজির হোসেনকেও শক্ত প্রতিদ্বন্ধি বিবেচনা করা হচ্ছে। মনোনয়ন জটিলতার কারণে তিনি শুরু থেকে প্রচারণা চালাতে পারেননি, ফলে পিছিয়ে ছিলেন। তাছাড়া প্রচারণার পর থেকেই তিনি আওয়ামী লীগ প্রার্থীর বিরুদ্ধে তার কর্মী-সমর্থকদের বাধা, মামলা ও গ্রেপ্তার হয়রানি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করে আসছিলেন। তবে এখনো জনগণ ভোট দিতে পারলে তিনিই বিজয়ী হবেন এমনটাই জোর দিয়ে বলছেন। সচেতন লোকজন জানিয়েছেন এই আসনে আ.লীগ-বিএনপি প্রার্থীর মধ্যে লড়াইয়ের সম্ভাবনা আছে। এ আসনে অন্যান্য দলের আরো ৩ জন প্রার্থী থাকলেও মাঠে তাদের তেমন সাড়া নেই।
সুনামগঞ্জ- (দিরাই-শাল্লা) আসনটি আওয়ামী লীগের আসন হিসেবে পরিচিত। প্রগতিশীল ও সংস্কৃতিমনা জনমানুষের এই আসনটির অসাম্প্রদায়িক চিত্র বদলে গেছে। গত কয়েক বছরে বৃহত্তর সিলেটে জঙ্গি তৎপরতায় যত নাম এসেছে তার শীর্ষরাই এই এলাকার। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এই আসন থেকে সাতবার এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। ২ লাখ ৫০ হাজার ৬৯৭ জন ভোটারের এই এলাকায় এবার আ.লীগ-বিএনপি জোটের সঙ্গে নির্বাচন করছেন আরো চারজন প্রার্থী। এই আসনে সুরঞ্জিত পতœী ড. জয়া সেনগুপ্তা আ.লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে মাঠে আছেন। অর্ধ শতাব্দী ধরে এই আসনে আধিপত্য নিয়ে রাজনীতি করে মৃত্যুতে থেমে গেছেন সুরঞ্জিত। এখনো তার অনেক আস্থাভাজন রাজনৈতিক নেতাকর্মী রয়েছে এলাকায়। তাছাড়া মাঠে তার একমাত্র ছেলে সৌমেন সেনগুপ্ত নীরবে কাজ করে আলোচনার জন্ম দিয়েছেন। তারুণ্যের কাছে জনপ্রিয় সৌমেন তার বাবার তরুণ ভক্তদের সমন্বয় করে এবার মায়ের জন্য প্রচারণা চালিয়ে মাঠ গরম রেখেছেন। মৃত্যুর আগে সুরঞ্জিত হাওর এলাকায় শিক্ষাবিস্তারে মহিলা কলেজ ও টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করে যাওয়ায় হাওরের শিক্ষায় পরিবর্তন এসেছে বলে মনে করেন অনেকে। সুরঞ্জিতের ছায়া নিয়ে প্রচারে মা ও পুত্র নেতাকর্মীদের নিয়ে শুরু থেকেই ছিলেন সরব। তবে তার সঙ্গে শক্ত প্রতিদ্বন্ধী হিসেবে মাঠে আছেন বিএনপি মনোনীত প্রার্থী নাছির উদ্দিন চৌধুরী। চারবারের নির্বাচনে সুরঞ্জিতের সঙ্গে অল্পভোটে জাতীয় পার্টি থেকে (১৯৯৬ সনে) তিনি একবার বিজয়ী হলেও বরাবরই বিজয়ী ছিলেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। তবে তার সঙ্গে প্রচারণায় নেমে সুরঞ্জিতকেও ঘাম ঝরাতে হতো। ঝানু রাজনীতিবিদ সুরঞ্জিত শেষ পর্যন্ত নির্বাচনী বৈতড়ণি পাড়ি দিতেন নিজের ক্যারিশমায়। এবার এই আসনে সচেতন মহল নাছির উদ্দিন চৌধুরীকে শক্ত প্রার্থী বিবেচনা করছেন। বিএনপি নেতাকর্মীদের আশা নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে এই আসনে ধানের শীষই বিজয়ী হবে।
সুনামগঞ্জ-৩ (জগন্নাথপুর-দক্ষিণ সুনামগঞ্জ) আসনে আ.লীগ মনোনীত প্রার্থী অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এমএ মান্নাকে সবচেয়ে নির্ভার প্রার্থী ভাবছেন দুই দলের সমর্থকরাই। ২ লাখ ৯২ হাজার ৪৭১ জন ভোটারের এই আসনে আরো চারজন প্রার্থী আছেন। গত এক দশকে স্বাধীনতার পরে জেলায় সবচেয়ে বেশি উন্নয়ন হয়েছে এই আসনে। দুর্গম গ্রামগুলোতে এখন গাড়ি নিয়ে পৌঁছা যায় সহজেই। প্রতিটি গ্রামেই নির্মিত হয়েছে অসংখ্য কালভার্ট। মেডিকেল কলেজ অনুমোদন, রাজধানী ঢাকার সঙ্গে বিকল্প যোগাযোগের জন্য রাণীগঞ্জ সেতু নির্মাণ, দুটি উপজেলায় শতভাগ বিদ্যুতায়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ কৃষিসহ নানা উন্নয়নমূলক কাজের কারণে শুরু থেকেই তিনি শক্ত প্রার্থী হিসেবে বিবেচিত। আ.লীগের সমর্থক নন এমন একটি বড় গোষ্ঠীও তার সততা ও কাজকে পছন্দ করেন। একজন সজ্জন রাজনীতিবিদ হিসেবে সব মহলে রয়েছে তার গ্রহণযোগ্যতা। টানা দুই মাস তিনি নির্বাচনী এলাকায় চষে বেড়িয়েছেন এবার। প্রতিটি গ্রামেই কর্মীসভা ও গণসংযোগ করেছেন। এই আসনে বিএনপি জোট থেকে প্রার্থী করা হয়েছে জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের নেতা মাওলানা শাহীনুর পাশা চৌধুরীকে। বিএনপি নেতাকর্মীরাও তাকে দুর্বল প্রার্থী হিসেবে ভাবছেন। যে কারণে প্রচারণায় বিএনপির শীর্ষ নেতাদের তার সঙ্গে দেখা যায়নি। তাছাড়া নানা অনিয়ম, দুর্নীতিসহ বিভিন্ন অভিযোগের কারণে ইমেজ সংকটে রয়েছেন তিনি। সম্প্রতি প্রতারণার অভিযোগে তার উপর আদালত গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করার পর তিনি আদালতে বাদীর অনুকুলে ১০ লক্ষ টাকা দিয়ে জামিন নিয়েছেন। এই আসনে এমএ মান্নানের সঙ্গে ধানের শীষ প্রতিদ্বন্ধিতা গড়ে তোলতে পারবেনা বলে সচেতন মহলের ধারণা।
সুনামগঞ্জ-৪ (সদর-বিশ্বম্ভরপুর) আসন এবারও মহাজোটের শরিক দল জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দিয়েছে আ.লীগ। এ আসনে মোট মোটার ২ লাখ ৮৯ হাজার ৩০ জন। শুরুতে এ আসনে মহাজোট প্রার্থী এডভোকেট পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ একক প্রচারণা শুরু করলেও শেষ দিকে এসে ঐক্যবদ্ধ আওয়ামী লীগ তার পক্ষে নিরলস প্রচারণা চালিয়েছে। প্রতিটি গ্রামে লাঙ্গলের জোয়ার তুলেছেন তারা। মাঠ গরম করে প্রচারণা শেষ করে এখন নির্ভার হয়ে কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন মিসবাহ। সচেতন মহল এই আসনে তাকেই বিজয়ে এগিয়ে রাখছেন। তার সঙ্গে বিএনপি জোট ভারাক্রান্ত বয়সী এডভোকেট ফজলুল হক আছপিয়াকে প্রার্থী করলেও শুরু থেকেই মাঠে প্রচারণায় পিছিয়ে ছিলেন তিনি। গত দুটি জাতীয় নির্বাচনেও বিএনপির এই প্রার্থী মহাজোট প্রার্থীদের সঙ্গে পরাজিত হয়েছিলেন। এবারও বয়সের কারণে সব জায়গাতেই যেতে পারেননি তিনি। যদিও তিনি একাধিকবার তার কর্মী সমর্থকদের হয়রানি, মামলা হামলার অভিযোগ করে আসছেন।
সুনামগঞ্জ-৫ (ছাতক-দোয়ারা) আসনে আ.লীগ ৫ম বারের মতো মনোনয়ন দিয়েছে জননেতা মুহিবুর রহমান মানিক এমপিকে। এই আসনে মোট ভোটার ৪ লাখ ১৫ হাজার ৯৫৪ জন। এবারও সচেতন মহলে মানিক শক্ত প্রার্থী হিসেবে বিবেচিত। তৃণমূলের জনিপ্রয় এই নেতার প্রতিটি গ্রামেই রয়েছে পরীক্ষিত শত শত কর্মী। বিশেষ করে এই আসনে আ.লীগের গত তিন যুগের কোন্দলের অবসান ঘটায় তার অবস্থান আরো সুসংহত হয়েছে বলে মনে করেন বোদ্দা মহল। তার সঙ্গে বিএনপি প্রার্থী মিজানুর রহমান চৌধুরীও মাঠে প্রচারণা চালিয়েছেন জোরে সোরে। দক্ষিণ ছাতকের এই প্রার্থী আঞ্চলিকতাকে জাগিয়ে তুলে বৈতড়ণি পাড়ি দিতে চান এবার। এই আসনটিতেও বিএনপির নেতাকর্মীরা বিজয়ের স্বপ্ন দেখলেও পর্যবেক্ষক মহল মনে করছেন শেষ পর্যন্ত নৌকার নির্বিরোধ প্রার্থী মুহিবুর রহমান মানিকই বিজয়ী হবেন।
হাওর বাঁচাও সুনামগঞ্জ বাঁচাও আন্দোলনের সহ-সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ান বলেন, বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ছাড়া আমাদের জেলার সবদলের প্রার্থীরাই শান্তির্পূর্ণভাবে তাদের প্রচারণা শেষ করেছেন। আমরাও আশা করি শেষ পর্যন্ত আমাদের সবগুলো আসনে শান্তিপূর্ণভাবেই নির্বাচন সম্পন্ন হবে।
জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও তাহিরপুর উপজেলা চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান কামরুল বলেন, আমাদের সুনামগঞ্জ-১ আসনসহ কোন আসনেই আমাদের প্রার্থীরা নির্বিগ্ন প্রচারণা চালাতে পারেননি। আমাদের অফিস ভাংচুর করা হয়েছে। নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার ও মামলা দেওয়া হয়েছে। তাই নির্বাচন নিরপেক্ষ হবে এটা আমরা আশা করছিনা। নির্বাচন সুষ্ঠু হলে ৫টি আসনের মধ্যে সবগুলোতেই বিজয়ের সম্ভাবনা থাকলেও সুনামগঞ্জ-১ ও সুনামগঞ্জ-২ আসনে আমাদের প্রার্থীদের বিজয় ঠেকানো সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করেন তিনি।
সুনামগঞ্জ-৪ আসনে মহাজোট মনোনীত প্রার্থী এডভোকেট পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ বলেন, এবার সুনামগঞ্জ-৪ আসনে লাঙ্গলের জোয়ার তুলে প্রচারণা শেষ করেছেন মহাজোট নেতৃবৃন্দ। তারা এখন বড় ব্যবধানে বিজয়ের অপেক্ষায় আছেন। কারণ গত দুটি জাতীয় নির্বাচনেও বিএনপি প্রার্থী মহাজোট প্রার্থীর সঙ্গে বড় ব্যবধানে পরাজিত হয়েছিলেন। এবার আরো বেশি ব্যবধানের ভয়ে তিনি এখন নানা অভিযোগ তুলছেন।