শামস শামীম ::
সুনামগঞ্জের হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধে বর্ষার আফালে আঘাত লাগে এমন ১০০টি বাঁধের বিশেষ অংশে গেল বছর জিও টেক্সটাইল ব্যবহার করেছিল পানি উন্নয়ন বোর্ড। এবার পানি নেমে যাওয়ার পর সেই বাঁধগুলো প্রায়ই অরক্ষিত রয়ে গেছে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন বাঁধের স্লোভে পরীক্ষামূলক জিও টেক্সটাইল ব্যবহারে বেশ সুফল মিলেছে। এসব বাঁধের কেবল উপরের অংশ থেকে বন্যায় মাটি সরে যাওয়া বা নিজ থেকে কেটে দেওয়ায় ছাড়া এসব বাঁধের বড় কোন সমস্যা হয়নি বলে জানিয়েছে পাউবো। হাওরের ঝুঁকিপূর্ণ ৮০০ কি.মি. বাঁধের সম্পূর্ণ অংশে এভাবে জিও টেক্সটাইল ব্যবহার করলে দীর্ঘমেয়াদী সুফল মিলবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। আর এতে খরচ হবে প্রায় ২০০ কোটি টাকা।
জিও টেক্সটাইল ব্যবহারে সরকারের অর্থ অপচয়ের পাশাপাশি বাঁধও টেকসই হবে বলে মত দিয়েছেন পাউবো’র প্রকৌশলীরা। যাতে স্থানীয় মানুষজনও সারা বছর সহজে যোগাযোগ করতে পারবে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন বাঁধে আলাদাভাবে জিও টেক্সটাইল ব্যবহারে খরচ পড়বে মাত্র ২০০ কোটি টাকা। তবে এ কারণে বাঁধ সুরক্ষিত থাকায় প্রতি বছরই ফসলরক্ষা বাঁধের ব্যয় কমবে। এতে সরকারের মোটা অংকের টাকা রক্ষা পাবে।
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, হাওর মাস্টার প্লান অনুযায়ী দেশের সবচেয়ে বেশি হাওর ৯৫টি হাওর রয়েছে সুনামগঞ্জে। এর মধ্যে হাওরের প্রায় ১৪০০ কি.মি. ফসলরক্ষা বাঁধ রয়েছে। ১৪০০ কি.মি. বাঁধের মধ্যে ৮০০ কি.মি. হচ্ছে সম্পূর্ণ ঝুঁকিপূর্ণ। বিস্তৃত হাওরের মাঝ দিয়ে দেওয়া এসব বাঁধে বর্ষায় বড় আঘাত হানে। হাওরের উত্তাল আফালে তখন ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয় নির্মিত ফসলরক্ষা বাঁধের। আর প্রতি বছরই সরকার মোটা অংকের বরাদ্দ দিয়ে এসব বাঁধ নিয়মিত পুনঃনির্মাণ ও পুনঃসংস্কার করে। ২০১৭-২০১৮ অর্থ বছরে সুনামগঞ্জেই সবচেয়ে বৃহৎ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল প্রথম বারের মতো। ৯৫৬টি প্রকল্পে প্রায় ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয়েছিল এসব বাঁধ। ফসল তোলার পর স্বাভাবিক বন্যায় এসব বাঁধের প্রায় সবগুলোই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বরাবরের মতো। যা পুনঃনির্মাণ ও সংস্কারের জন্য এবছরও আরো ৯৩ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে সরকার।
পানি উন্নয়ন বোর্ড পওর বিভাগ-১ সূত্রে জানা গেছে, পরীক্ষামূলক জিও টেক্সটাইলে এবার ভালো সুফল মিলেছে। গত বছর অন্তত ১০০টি প্রকল্পের ভাঙ্গা অংশে জিও টেক্সটাইল ব্যবহার করা হয়েছিল। বন্যার পরে হাওরের পানি নেমে যাওয়ায় দেখা গেছে যে বাঁধগুলোর বিশেষ অংশে জিও টেক্সটাইল ব্যবহার করা হয়েছিল সেগুলো অক্ষত আছে। কেবল উপরের অংশের দেড় ফুটের মতো মাটি সরে গেছে। তবে নৌ চলাচল ও মৎস্য আহরণের সুবিধার্থে যেসব অংশ কেটে দেওয়া হয়েছিল সেসব অংশই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
পাউবো’র সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, প্রতিটি বাঁধের দুইদিকের স্লোভের ৭-৮ ফুট নিচ থেকে ব্যবহার করা হয়েছে জিও টেক্সটাইল। পরে উপরের অংশের দেড় ফুট মাটি দেওয়া হয়েছে। জিও টেক্সটাইলের ভেতর দিয়ে ঘাসও গজিয়েও বাঁধ টেকসই হয়েছে। এসব অংশের ঢেউয়ে উপরের অংশের মাটি সরে গেছে। এবার ওই উপরের অংশে মাটিসহ যে অংশ প্রয়োজনে ভাঙা হয়েছিল সে অংশেই মাটি দেওয়া হবে। এতে সরকারের অর্থ সাশ্রয় হবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
হাওর আন্দোলনের নেতা ও হাওর গবেষক নির্মল ভট্টাচার্য্য বলেন, হাওরে সবসময়ই ভিন্নধারার পরিবেশ বিরাজ করে। প্রকৃতির খেয়ালের উপর নির্ভরশীল হাওরের গতিপ্রকৃতি বুঝেই প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা উচিত। জিও টেক্সটাইল যদি পরিবেশ সম্মত ও টেকসই হয় তাহলে এটার দিকে যাওয়া যেতে পারে।
হাওরের কৃষি ও কৃষক রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক চিত্তরঞ্জন তালুকদার বলেন, হাওরের পরিবেশ ও প্রকৃতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে কৃষকদের অংশিদারিত্বের ভিত্তিতে এখনো তেমন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়নি। আমাদের দাবি পরিবেশ ও প্রকৃতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন। যাতে আমাদের কৃষি ও কৃষক উপকৃত হন। জিও টেক্সটাইল যদি আমাদের ফসলরক্ষায় সুফল বয়ে আনে তাহলে বাঁধের সুরক্ষায় জিও টেক্সটাইল ব্যবহার করা যেতে পারে।
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পওর বিভাগ-১) এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আবু বকর সিদ্দিক ভূঁইয়া বলেন, আমরা গত বছর অন্তত ১০০টি প্রকল্পের ভাঙা অংশে জিও টেক্সটাইল ব্যবহার করেছিলাম। বন্যার পর পানি চলে যাওয়ায় দেখা গেছে বেশিরভাগই অক্ষত আছে। কেবল উপরের দেড় ফুট অংশের মাটি সরেছে। তিনি বলেন, আমাদের ৩৭টি হাওরের প্রায় ৮০০ কি.মি. বাঁধ হলো ঝুঁকিপূর্ণ। এই অংশে জিও টেক্সটাইল ব্যবহার করতে হলে আমাদের অন্তত ২০০ কোটি টাকা ব্যয় হবে। তবে প্রতি বছর আমাদের ফসলরক্ষা বাঁধে যে বরাদ্দ দেওয়া হয় তা কমবে। এতে সরকারের মোটা অংকের অর্থ সাশ্রয় হবে। ফসলরক্ষার সঙ্গে মানুষের চলাচলও সহজলভ্য হবে।