মামুন,ফেরদৌস, বিজয়, জুয়েল, রুদ্র/
তোরা কি জানিস জীবনের সর্বশেষ চিঠির নাম অনু হোসেন। বন্ধুত্বের সর্বশেষ লম্বা নদীটির নাম অনু হোসেন। সময়ের সর্বশেষ নিষ্পাপ বকুল পৃথিবীকে টা টা দিয়ে চলে গেছে ভোর ৫ টা ২২ মিনিটে। অনু হোসেন চলে যাওয়ার পরও দীর্ঘদিন আমাদের চারপাশে চালতা ফুলের সৌরভ ছড়াতে ছড়াতে ঘুরতে থাকবেন। পরিচিতদের দীর্ঘশ্বাস আর উচ্চারণগুলো গুণতে থাকবেন। অনেক নীরবে একটা মরমী হাসির মাধুর্য ছড়িয়ে অনু ভাই বন্ধুত্বের উপস্থিতি ধরে রাখবেন। আমিন ভাইয়ের ভ্রমণ, আড্ডা, গানলামি, বাচ্চামির ভেতরে অনু ভাই ঠিক ঠিক ম্যাজিক রিয়ালিজমের মতো বেঁচে থাকবেন। কারো আত্মাই পৃথিবীতে ফুরিয়ে যায় না। আত্মাগুলো কবরের ফুল নয়; আত্মাগুলো দেহ বদল করে কিংবা আত্মাগুলো আত্মায় মিশে যায়। অনু ভাইয়ের গৌরবর্ণ আত্মা বাংলাদেশের মাটিতে হাঁটতে থাকবে।
লেখালেখির সামান্য সূত্রে অনু ভাইয়ের সাথে আমার পরিচয়। কবি ফেরদৌস মাহমুদ তখন দৈনিক ডেসটিনি পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক। ফেরদৌসকেও তখন চিনি না। কিন্তু ‘সপ্তসিন্ধু’ নামের সাহিত্য পাতাটার খুব ভক্ত ছিলাম। ঢাকায় খুব কমই যাওয়া হয়। একদিন কী কারণে যেন ডেসটিনি অফিসে গিয়েছিলাম। সেখানেই অনু ভাইয়ের সাথে পরিচয়। অনু ভাই এই পত্রিকার ফিচার সম্পাদক ছিলেন। আমার মনে হতো পত্রিকাটি অনু ভাই চালান। সে দিন ফেরদৌসের অফ ডে ছিলো। কিন্তু অনু ভাই যে ভাবে রিসিভ করলেন, কথা বললেন, আপ্যায়ন করলেন- মনে হলো উনার ছায়ায় আশ্রয় নিতেই আমি ঢাকায় এসেছি। মানুষের সাথে মেশামেশিতে আমার সংকোচের শেষ। কিন্তু তিনি এক আশ্চর্য মানব নিকেতন। আমাদের জেনারেশনের প্রত্যেকটা বন্ধু সম্পর্কে উনি খোঁজ রাখেন, শুধু অগ্রজের দৃষ্টিতে নয়; সমালোচকের সজাগ পর্যবেক্ষণে সবার লেখার স্টাইল ও আদর্শের খোঁজ রাখতেন তিনি। সাহিত্যের কথা, কবিতার কথা বলতে বলতে তিনি শুন্যের প্রায় সবাইকে বিশ্লেষণ করে যাচ্ছিলেন। আমার মতো মফস্বলবাসীকে দিয়ে লিখিয়েছিলেন অনেক গদ্য। সত্যি কথা বলতে সপ্তসিন্ধুতে আমি যে পরিমান লিখেছি; অন্যকোন পত্রিকায় এতো লেখা লিখিনি।
‘শিল্পের চতুষ্কোণ’ নামে অনু ভাইয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ আছে। এই গ্রন্থটা সম্পর্কে যতো রিভিউ আর আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে সব নিয়ে তিনি এই গ্রন্থটা রিপ্রিন্ট করতে চেয়েছিলেন। যতীন স্যার দৈনিক যুগান্তরে এই বইটি সম্প্ররকে একটি আলোচনা লিখেছিলেন। অনু ভাই আমাকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন আমি যেন স্যারের কাছ থেকে এই লেখাটা সংগ্রহ করি। কিন্তু স্যার এই লেখাটা সম্পর্কে কোন ইনফর্মেশন দিতে পারেন নি। আমিও লেখাটা যোগার করে দিতে পারিনি।
ফেরদৌস মাহমুদকে খুব পছন্দ করতেন। ফেরদৌসের মতো একটা মেধাবী ছেলের চাকরি হচ্ছিলো না দেখে খুব আক্ষেপ করতেন। তিনি বাংলা একাডেমির সংকলন বিভাগে কাজ করছিলেন। আব্দুল মান্নান সৈয়দের রচনাবলীর মতো একটা বড় কাজ তিনি নিশ্চুপে, নিঁখুত কলমে, কোলন ক্যান্সারের জার্ম নিয়ে করে গেছেন।
আজ ভোর ৫ টা ২২ শে চলে গেছেন। আজ বইমেলা উদ্বোধন। অনু ভাইকে ছাড়া বাংলা একাডেমিতে সবাই প্রবেশ করবে। মামুন, আপনিও মেলা থেকে লাইভ করবেন। আপনার হাত কাঁপবে, চোখ ভিজবে, লাইভ চলতে থাকবে।আবৃত্তিশিল্পী মাহি ভাই হয়তো বলবেন অনুভাই নেই।
ছবি তোলাতে খুব সংকোচ আমার। তাই,অনু ভাইয়ের সাথে আমার কোন ছবি নাই। হয়তো আছে অন্য কারো কাছে। কিন্তু অনু ভাইয়ের কিছু সিগনেচার আমার কাছে আছে। আমি জীবনে খুব কম মানুষের সিগনেচার নিয়েছি। আজ মনে হচ্ছে মানুষের সিগনেচার রেখে দেয়া দরকার। ভাগ্যিস অনু ভাইয়ের দুএকটা সিগনেচার আমার আছে। জীবনের এটাই সঞ্চয়।
(লেখকের ফেইসবুক টাইম লাইন থেকে নেয়া)