1. haornews@gmail.com : admin :
  2. editor@haor24.net : Haor 24 : Haor 24
রবিবার, ১৯ জানুয়ারী ২০২৫, ০৩:১৬ অপরাহ্ন

ইংরেজিপ্রীতির প্রায়োগিকতা ও ঔপনিবেশিকতার কারিন্দা ॥ ইকবাল কাগজী

  • আপডেট টাইম :: রবিবার, ১০ ফেব্রুয়ারী, ২০১৯, ১২.৩৩ পিএম
  • ৩৪৬ বার পড়া হয়েছে

আরবি-ফারসি-উর্দুকে হাতিয়ার করে বাংলাভাষাকে আক্রমণ করার প্রবণতার, বলা যায়, নিবারণÑপ্রশমন ঘটেছে ১৯৭১-য়ে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ভাষাভিত্তিক জাতিরাষ্ট্র (কারও কারও মতে) প্রতিষ্ঠার পর। কিন্তু ধর্মাবরণে মোড়ানো ভাষার আক্রমণ প্রশমিত হতে না হতেই মাইকেলি সময়ের পুরোনো সেই ইংরেজিপ্রীতির ধ্বজাধারীরা এখন উভয় বঙ্গে বাংলাভাষার উপর ইংরেজির ভয়াবহ ভার চাপিয়ে দিতে কোমর বেঁধে লেগেছে। বোঝার উপর শাকের আঁটি হলে কোনো কথা ছিল না। কিন্তু বিষয়টি সে রকম হালকা কীছু নয়। কলকাতার দেশ পত্রিকার সম্পাদকীয়তে বলা হচ্ছেÑ ‘‘আরও দ্বিগুণ উদ্যোগে ইংরেজি শিক্ষার প্রয়োজনের কথা স্বীকার করে নিয়েও মাতৃভাষাকে অবহেলা করার ব্যাপারটা কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। আমাদের দেশে যে একটাই মুশকিল। যারাই ইংরেজিতে কৃতবিদ্য হয়, তাদের প্রায় সকলেই মাতৃভাষা থেকে দূরে সরে যায়। মাতৃভাষা কিংবা স্বদেশি ভাষা থেকে সম্পূর্ণ বি”্যুত হলে মানসিক ভারসাম্যও নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তার একটি প্রমাণ, যারা মাতৃভাষার জন্য আন্দোলন করেন, তাদের প্রতি মাতৃভাষা-অজ্ঞ, শুধু ইংরেজি শিক্ষিত একদল মানুষ ক্রুদ্ধ এবং খড়গহস্ত হয়ে ওঠেন, তারা ভাবেন এই সব আন্দোলন বুঝি ইংরেজির বিরুদ্ধে ! এটা সম্পূর্ণ বোঝার ভুল। ইংরেজি খুব ভাল শিখলেও মাতৃভাষা শেখা যাবে না কেন? সব মানুষই দুটি বা তিনটি ভাষা অনায়াসে শিখতে পারে। আমাদের দেশের গান, নাটক, সাহিত্য, ফিল্মও তো ইংরেজিতে হয়ে যাবে না, বিভিন্ন ভাষার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যও বাঁচিয়ে রাখতে হবে। জাপানিরা কাজের ভাষা হিসেবে ইংরেজি শিখলেও জাপানি ভাষা ত্যাগ করে না, ত্যাগ করলে তারা সমাজ জীবনে অংশ গ্রহণও করতে পারবে না। দু’জন ইংরেজি জানা জাপানি বা চিনে পরস্পরের সঙ্গে কিন্তু ইংরেজিতে কথা বলে না। দুঃখের বিষয়, আমাদের দেশে ইংরেজিনবিশরা নকল সাহেব কেন হতে চান, কে জানে।’’ (…, ইংরেজি ও মাতৃভাষা, সম্পাদকীয়, দেশ, ২৩ ডিসেম্বর ২০০০, ৬৮ বর্ষ ৪ সংখ্যা, পৃষ্ঠা : ৫)।
সিন্দুবাদের ঘাড়ে গ্যাঁট হয়ে বসা ভূতের মতোন বাংলার মাথায় চড়ে বসা ইংরেজির খবরদারিত্ব বা মাতব্বরি যা-ই বলি না কেন মূলত ব্যাপারটা দাঁড়ায়, বংলা ভাষার ভেতরে ইংরেজি ভাষার শব্দ প্রক্ষেপণক্রিয়া অব্যাহত রাখার মাধ্যমে বাংলাভাষীদেরকে স্বভাষা থেকে বিচ্ছিন্ন করার চক্রান্ত পরিচালনা করা। এখানে এই শহর সুনামগঞ্জে সেই ব্রিটিশ আমলে প্রতিষ্ঠিত দুটি বিদ্যালয়ের একটির নামকরণ করা হয়েছিল হাজি মকবুল পুরকায়স্থ উচ্চ বিদ্যালয় (প্রতিষ্ঠা : ০১. ০১. ১৯৩৭) ও অন্যটির বুলচান্দ উচ্চ বিদ্যালয় (প্রতিষ্ঠা : ০১. ০১. ১৯৩২)। এই দুটি বিদ্যায়তনই এ দেশের দুজন জনহিতৈষী মানুষের দানে প্রতিষ্ঠিত, তদানীন্তন ব্রিটিশ সরকারের এতে কোনো অবদান নেই। আমাদের কাছে এই বিদ্যালয় দুটি এইচএমপি হাই স্কুল ও বিসি হাই স্কুল বলে সমধিক পরিচিত। বিদ্যালয়ের বাংলা নামকে ইংরেজিতে প্রতিবর্ণীকরণ করে তার থেকে ‘হাই স্কুল’ বাদে বাকি ব্যক্তি নামের অংশটুকুর মু-মাল (সংক্ষেপায়ণ বা ধননৎবারধঃরড়হ) করে যা পাওয়া গেছে, তার বাংলা প্রতিবর্ণীকরণ করে তারপর পাওয়া গেছে বিদ্যালয় দুটির বর্তমান নাম, সহজ কথায় প্রথমে বাংলার ইংলিশায়ন পরে ইংরেজির বাংলায়ন অথবা বলা যায় ভাষাচর্চার ক্ষেত্রে এক ধরনের ঔপনিবেশিক বিচ্ছিন্নতা, কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতে ‘বাংলার মাথায় ইংরেজির চড়ে বস’া আর কি। বর্তমানে বিদ্যালয় দুটির নাম ইংরেজির লিপ্যন্তর বা বাংলালিপিতে লেখার প্রতিরূপ মাত্র। এই নাম দুটির বিবর্তনের ইতিহাস সহজেই প্রমাণ করে আমরা সার্বিক বিবেচনায় ঔপনিবেশিক বিচ্ছিন্নতার বলয় অতিক্রম করবো কি এখনো পুরোপুরি বন্দি হয়ে আছি। অর্থাৎ ইংরেজিনবিশিপনা করতে গিয়ে নকল সাহেব বনে বসে আছি এবং মুক্তির কোনো সচেতন উদ্যোগও আপাতত ব্যাপকভাবে দৃশ্যমান হচ্ছে নাÑ যেমন মুক্তির বসনা ব্যক্ত করা হয়েছে শাবিপ্রবি, নোবিপ্রবি, বাউবি, ঢাপ্রবি, ঢাবি, বাসস ইত্যাদির মতো মু-মালনাম সর্জনের মাধ্যমে, যাকে সীমিত ক্ষেত্রে প্রচেষ্টার উদাহারণ হিসেবে বিবেচনা করা যায় মাত্র। বিশেষ করে শিক্ষিত মহলে দৃশ্যমান আছে ওই ঔপনিবেশিক বিচ্ছিন্নতার বলয়ের সীমা অতিক্রম না করার প্রবণতা এবং এই প্রবণতা বর্তমান সমাজের বিশেষ একটি শ্রেণির মধ্যে প্রবলভাবে সক্রিয় আছে।
ধ্রুব এষ সুনামগঞ্জের সন্তান, তিনি দেশে-বিদেশে বিখ্যাত, দেশের যশস্বী প্রচ্ছদশিল্পী, সাহিত্যিক হিসেবে নামডাক কম নয়, গল্প উপন্যাস কবিতা দেদার লিখে লিখনক্রিয়ায় সব্যসাচীত্বের প্রমাণ রেখেছেন। তাঁর একটা সায়েন্স ফিকশন (মহাশূন্য, সপ্তাহের বাংলাদেশ সাপ্তাহিক, ৮ এপ্রিল ২০১২, বর্ষ ২ সংখ্যা ৪৭, পৃষ্ঠাÑ ৫৯-৬৩) পড়েছি। সব লেখকের লেখা পড়া-হয়ে ওঠে না, এমনটি সম্ভবও নয়, তাঁর লেখা হাতের কাছে পেলেই পড়ি। গল্পটি পড়ে আমার বেশ লাগলো। কল্পবিজ্ঞানের গল্প হিসেবে গল্পটির একটি বৈজ্ঞানিক ত্রুটি (অন্তত আমার মতানুসারে, এখানে বিস্তারিত বলার অবকাশ নেই) থাকা সত্ত্বেও আমার কাছে বেশ চমৎকার লেগেছে, মজাও পেয়েছি। কিন্তু একজন ভাষা সচেতন পাঠকের কাছে গল্পের এই বৈজ্ঞানিক ত্রুটির চেয়েও বাক্যের মধ্যে যখন তখন যত্রতত্র দেদার ইংরেজি শব্দের প্রক্ষিপ্ততা বড় উৎকট-ভজকট বলে পরিলক্ষিত হতে পারে।
গল্প-উপন্যাস বা কবিতা-প্রবন্ধ ইত্যাদির ভাষার মধ্যে অজস্র ইংরেজি শব্দের ব্যবহার বর্তমানে এত বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে যে তা ভাষিক-শৈল্পিক প্রয়োজনের মাত্রাকে অতিক্রম করে অপ্রয়োজনীয় বাহুল্যে পর্যবশিত হয়ে পড়ছে উভয় বঙ্গের কীছু কীছু নয়, প্রায় লেখকের লেখায়। শ্রীএষ তাঁর এই ছোট গল্পটিতে (মহাশূন্য) ১৬২টি ইংরেজি শব্দ (যে সব শব্দ একাধিক বার ব্যবহৃত হয়েছে সেগুলোকে গণনায় একবার করেই ধরা হয়েছে। এবং বলে রাখছি যে, উল্লেখিত শব্দ সংখ্যাটি প্রকৃত সংখ্যার চেয়ে দুয়েকটি কম বেশি হতে পারে।) ব্যবহার করেছেন। আমি বলছি না যে তাঁর গল্পের মধ্যে অপরিহার্য ইংরেজি শব্দ নেই। ‘অপরিহার্য ইংরেজি শব্দ’ সেগুলোই, যে ইংরেজি শব্দগুলো আমরা বাংলাভাষীরা ভাববিনিময়ের ক্ষেত্রে অবিকল্পাবস্থাহেতু ব্যবহার করতে একান্তভাবে বাধ্য। যেমন মন্তাজ (সড়হঃধমব) তেমনি একটি অবিকল্প ইংরেজি শব্দ। অর্থাৎ ইংরেজি শব্দটিকে ভাবপ্রকাশের ক্ষেত্রে জনবোধ্য অথচ অবিকল্পশব্দ হতে হবে, যার বিকল্প-বাংলা-শব্দ নাই বা আমরা বাংলাভাষীরা তৈরি করতে পারিনি কিংবা বিদ্যমান থাকলেও আমরা তেমন ব্যবহার করি না অথবা আমাদের মধ্যে প্রচলিত নয়। বাংলায় প্রচলিত এমন অবিকল্প ইংরেজি শব্দের সংখ্যা অসীম নয়, অবশ্যম্ভাবীভাবে অঙ্গুলিমেয়। আর ইংরেজি অভিধান থেকে ইচ্ছেমতো যেকোনো শব্দ এনে বাংলা বাক্যের যত্রতত্র বসিয়ে দিলেই শব্দটি কোনো এক জাদুমন্ত্রবলে বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত হওয়ার মতো অবিকল্প ইংরেজি শব্দের যোগ্যতা অর্জন করে ফেলে না বা বাংলাভাষায় কৃতঋণশব্দরূপে মর্যাদা পেয়ে যায় না। শ্রীএষের গল্পেটিতে ব্যবহৃত ইরেজি অবিকল্প শব্দগুলো বাদ দেওয়ার পরও অনেক ইংরেজি শব্দ আছে যেগুলো একাধিক বার, এমন কি অনুসন্ধান করলে হয় তো জানা যাবে যে, ১০ বারেরও বেশি বার ব্যবহার করা হয়েছে। সেগুলোকে, আগেই বলেছি, গণনায় একবার করে ধরেই এই ১৬২টি শব্দ পাওয়া গেছে। যদি অনবধানতাবশত, আবারো বলছি, দুয়েকটি কম-বেশি হয়ে যায়, সে জন্যে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। এই ১৬২টি শব্দের প্রায় শব্দই একাধিক বার ব্যবহৃত হওয়া অনুসারে গল্পটিতে ইংরেজি শব্দসংখ্যা কতটা আমি গণনা করিনি। যেখানে একটিও ইংরেজি শব্দ ব্যবহার না করে সারা জীবন বাংলা ভাষায় গল্প লেখার বিরল ক্ষমতা আছে শ্রীএষের, আমি তাঁকে ভালো করে চিনি/জানি এবং তাঁর ক্ষমতা সম্পর্কে অন্তত আমার কোনো সন্দেহ নেই, এই অসম্ভবকে তিনি ইচ্ছে করলেই সম্ভব করতে পারেন, সেখানে কেন এমন ইংরেজি শব্দের এত অনাবশ্যক ছড়াছড়ি থাকবে তাঁর গল্পের ভেতরে? প্রশ্নটা উঠতেই পারে।
বাংলা ভাষায় ইংরেজি শব্দের এই অপ্রয়োজনীয় প্রক্ষেপ বা অনুপ্রবেশ বাংলা ভাষাকে কতটা প্রদূষিত করছে সেটা নির্ণয়ের আগে এটা নিশ্চিত করে বলে দেওয়া যায় যে, ভাষা-ঔপনিবেশিকতার নিগড়ে আমাদের লেখক-সাহিত্যিকরাও কম-বেশি শৃঙ্খলিত ও ঔপনিবেশিক বিচ্ছিন্নতায় আক্রান্ত, লেখকদের বেলায় যেটাকে ভাষাবিচ্ছিন্নতা বলা যায়। তাঁরা ভুলে যান যে মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁদের চেয়ে নিশ্চয়ই কম ইংরেজি জানতেন না, তিনি ইংরেজি ভাষায় একটি কাব্যও লিখেছিলেন, কিন্তু তাঁর সৃষ্ট বাংলা সাহিত্যে ইংরেজি শব্দের ব্যবহার তো বলতে গেলে প্রায় শূন্যের কোঠায় পড়বে বলে মনে হয়। তাই বলে তাঁর রচনা সাহিত্য পদবাচ্যতা হারিয়ে ফেলেছে এমন তো কীছু নয়। রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার পাওয়ারও একশত বছর পর পর্যন্ত যে ভাষায় সার্থক সাহিত্য চর্চা চলেছে নিরন্তর, ভাষা আরও সমৃদ্ধ হওয়ার সুযোগ মিলেছে, অধিকন্তু আজকাল যখন বাংলা সাহিত্য সকল দুর্বলতা কাটিয়ে উঠে বিশ্বসভায় মাথা উচু করে দাঁড়িয়েছে, জটিল ও উচ্চভাব প্রকাশে তার কোনো জড়তা নেই, বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখার বাংলা পরিভাষা তৈরি হয়ে গেছে। জীবনানন্দ তার কবিতায় ভীষণ জটিল কিন্তু অপরূপ চিত্রকল্প নির্মাণ কৌশলের সামর্থ্য প্রদর্শন করে এ ভাষার ভাব প্রকাশের ক্ষমতা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করে গেছেন, কমলকুমার মজুমদার অনুবাদ অযোগ্য ভাষাশৈলী সৃষ্টি করে গেছেন, তখন কেন ইংরেজির কাছে এই ভিক্ষাবৃত্তি? বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় দিকপাল গল্পকার কিংবা উপন্যাসিকরা এই শৃঙ্খল ভাঙতে পারেন না, তা কিন্তু নয়, তাঁরা এতটাই শক্তিধর যে তাঁরা ইচ্ছা করলেই ইংরেজির প্রতি এই অকারণ মুগ্ধতা ভাঙতে পারেন, এমন কি নতুন ভাষাশৈলী তৈরী করতে পারেন। কমলকুমার মজুমদার, সতীনাথ ভাদুড়ী, অমিয়ভূষণ মজুমদার, শওকত আলী, অখতারুজ্জামান ইলিয়াস, শহীদুল জহির নতুন নিজস্ব ভাষাশৈলী তৈরি করতে পেরেছেন। কিন্তু কেন যে কীছু কীছু লেখকের ইংরেজির প্রতি অকারণ মুগ্ধতা কাটে না তা আমার বোধগম্য নয়, তবে অনুমান করতে পারি, তাঁরা ইংরেজিমনস্ক বিশেষ একটি শ্রেণির মনোরঞ্জনে ব্যস্ত থাকেন এবং লেখক নিজেও ওই বিশেষ শ্রেণিরই প্রতিনিধি। তাঁরা হয় তো ভাবেন, ইংরেজির দ্বারা তাঁরা তাঁদের পাঠক-প্রজার মনোরঞ্জন করতে সক্ষম হয়ে সত্যিসত্যি প্রজার মনোরঞ্জন করতে পারে যে সেই রাজা বনে যাবেন।
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের একটি লেখায় (রূপ, সানন্দা পুষ্পাঞ্জলি ২০০১, পৃষ্ঠাÑ১৬৪Ñ১৭৪) কম-বেশি ১৮০টির মতো, আর একজন লেখক শঙ্করলাল ভট্টাচার্যর লেখায় (পরকীয়া চিত্রাবলি, সানন্দা পুষ্পাঞ্জলি ২০০০, পৃষ্ঠাÑ ২০৫-২১১) কম-বেশি ৩৮০টির মতো ইংরেজি শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। তাঁদের লেখায় বৈয়াকরণের দেওয়া সংজ্ঞানুসারে কৃতঋণশব্দ বা বাংলায় ‘নিজস্ব শব্দ’ হিসেবে গৃহীত হয়ে গেছে এমন ইংরেজি শব্দের অভাব আছে তা কিন্তু নয়। দুচার পঙক্তি লিখলেই একটা না একটা ইংরেজি শব্দ স্বাভাবিকভাবেই এসে যায়। এই এখনই আমার লেখায় বাংলা ‘পঙক্তি’ শব্দটির স্থলে ইংরেজি ‘লাইন’ শব্দটি এসে গিয়েছিল, তাকে বাক্যের বাইরে রেখে দিতে রীতিমত জোর প্রয়োগ করতে হলো, তাকে বাতিল করে দিয়ে খুঁজেপেতে আনতে হলো পঙক্তিকে, কিন্তু ‘লাইন’কে কিন্তু খুঁজে আনতে হয়নি সে স্বতস্ফূর্তভাবেই মন থেকে এমনিতেই এসেছিল। এ রকম মনের ভেতর ঠাঁই করে নেওয়া সর্বত্র ব্যবহৃত ও সর্বজনবোধ্য ইংরেজি শব্দগুলোই বাংলা শব্দ হয়ে গেছে বলে ধরে নিতে হবে, আমাদের বাংলা অভিধানগুলোও বাংলা ভাষায় আপন করে নেওয়া এমন জনবোধ্য ইংরেজি শব্দগুলোকে নিজের শব্দভুক্তিভুক্ত করতে কোনো কার্পণ্য করেনি, আরবি-ফারসি প্রভৃতি বিভাষার এন্তার শব্দের ক্ষেত্রেই এমন হয়েছে, পৃথিবীর যে কোনো ভাষার ক্ষেত্রে এমনটি হয়ে থাকে আর হওয়াই স্বাভাবিক। ব্যাকরণে এমন সহজবোধ্য ইংরেজি বা অপর ভাষার শব্দের বাংলা হয়ে ওঠা শব্দগুলোই কৃতঋণশব্দ হিসেবে স্বীকৃত। লেখক তিন জনের লেখায় ব্যবহৃত শব্দগুলির নমুনা দাখিল করলে যে কারও সন্দেহ হতে পারে আমি ইংরেজি আভিধান থেকে ইচ্ছে করে সাধারণ পাঠকরা যে সব শব্দ সহজে বুঝতে পারবেন না, ইংরেজিতে শিক্ষিত ছাড়া অন্য কাউকে বুঝতে হলে অভিধান খোলতে হবে, এমন সব শব্দ এখানে সন্নিবেশিত করেছি। পাঠকরা ইচ্ছে করলে যে কোনো বাংলা অভিধান খোলে দেখে নিতে পারেন শব্দগুলোর মধ্য থেকে কোন কোন শব্দ অভিধানে বিদেশি বা কৃতঋণশব্দ হিসেবে গৃহীত হয়েছে, আশা করি পাবেন না। লেখকদের প্রত্যেকের লেখা থেকে মাত্র কয়েকটি করে নির্বাচিত শব্দ উদাহরণ স্বরূপ পাঠকদের বিবেচনার জন্যে উদ্ধৃত করছিÑ পার্পল, সাইকো, হার্টথ্রব, এ্যাবস্টেক্ট (ধ্রুব); পিউরিটান, ম্যাসিভ, র‌্যাম্প, ফিউরিয়াস, ইমিউনিটি (শীর্ষেন্দু); লুকোপ্লাস্ট, অরগ্যাম, রাইম, রিজন, জেরক্স (শঙ্করলাল)। আগেই বলেছি এ শব্দগুলি বিশেষভাবে ইংরেজি শিক্ষিত ছাড়া সাধারণ পাঠকদের সবার বোধগম্য হবে বলে মনে হয় না, তাই এ থেকে এমন একটি প্রত্যয় জন্মে যে, যেনোবা ইংরেজি ভাষার সমস্ত শব্দই বাংলা শব্দের স্বীকৃতি পেয়ে কৃতঋণশব্দ হয়ে গেছে বা ইংরেজি অভিধান থেকে ইচ্ছা মাফিক যে কোনো শব্দ তোলে এনে বাংলা বাক্যে প্রতিস্থাপন করামাত্র তা এমনিতেই বাংলা শব্দপ্রতীকের রূপ লাভ করবে বা বাংলাভাষীদের কাছে বোধগম্য আদি অকৃত্রিম বাংলা শব্দরূপে স্বীকৃত হয়ে যাবে। বাংলা বাক্যে এমন নির্বিচার ইংরেজি শব্দের প্রক্ষেপণ বা প্রবিষ্টকরণকে সমর্থন করার জন্য আর একটি টুটকা যুক্তি এমন হতে পারে যে, মাঝে মাঝে বাংলা বাক্যের মধ্যে দুর্বোধ্য বাংলা শব্দের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়, তখন তো অভিধান খোলে শব্দটির অর্থ সন্ধান করার কষ্ট স্বীকার করতে কোনো কার্পণ্য করা হয় না, শিবনারায়ণ রায়ের কোনো লেখা পড়তে গিয়ে যেমন প্রায়শ অভিধানের দ্বারস্থ হতে হয়, শুধু তাই নয় এমন কি মাঝেমধ্যে সংস্কৃত ব্যাকরণের মহারণ্যে প্রবিষ্ট হয়ে শব্দার্থকে গরুখোঁজা করে মরতে হয়, সেভাবে না হয় বাংলা বাক্যের মধ্যে ব্যবহৃত ইংরেজি শব্দের অর্থটা মাঝেমধ্যে ইংরেজি অভিধান খোলে দেখে নিতে হবে, তাতে মহাভারত অশুদ্ধ হবে না। এমন হলে তো সব লেঠা চুকে যায়, কোনো সমস্যাই আর সমস্যা থাকে না। অর্থাৎ বাংলাভাষীদের কাছে বাংলা আর ইংরেজি অভিধানের মধ্যে আর কোনো ইতর বিশেষ থাকবে না, উৎকৃষ্ট মুড়িঘণ্ট বা খিচুড়ির মতো বাংলা ইংরেজির একটি মহাভাষাঘন্ট হস্তামলক হয়ে যাবো। আর প্রকারান্তরে বাঙালিরা ইংরেজি শিখে দ্বিভাষিক জাতি না হয়ে হয়ে উঠবে বাংলিশ/বাংরেজি জাতি। ইংরেজি শিক্ষার ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রণোদনা চালিয়ে বাংলাদেশে দ্বিভাষিকতা সর্জনে বর্তমানে প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। দ্বিভাষিকতার সংজ্ঞার্থ হলো দুইটি আলাদা ভাষা আলাদাভাবে ব্যাকরণসম্মতভাবে শেখা ও ব্যবহারিক জীবনে সামাজিক-সাংস্কৃতিক যোগাযোগ সংঘটনের উপায়রূপে অলাদা আলাদাভাবে ভাবপ্রকাশে সক্ষমতা অর্জন অর্থাৎ দ্বিভাষিকতা বোঝাতে ভাষা দুইটিকে একটির সঙ্গে আর একটির মিশ্রণ ঘটানো বা দুইটি ভাষার একটি সম্পৃক্ত দ্রবণ বোঝায় না। আলোচ্য লেখকদের গল্পের ভাষায় লেখকরা বাংলাবাক্যে ইংরেজি শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে সচেতনভাবে যে বাংরেজি দ্রবণ তেরি করছেন প্রকৃতপ্রস্তাবে তা একটি বাংলা-ইংরেজির উত্তম দ্রবণ।
এমতাবস্থায় সাধারণ্যে দুর্বোধ্য এই সব ইংরেজি শব্দের ব্যবহার নিয়ে সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন উঠতে পারে যে, পাকিস্তানি আমলে ‘বাংলা বিনাশের চক্রান্তরূপে’ পূর্বাঞ্চলে ঔপনিবেশিক ব্যবস্থায় ব্যবহৃত বিভিন্ন অস্ত্রের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর অস্ত্র ভাষাবিচ্ছিতাকে প্রয়োগ করা হয়েছিল, এই লেখকরাও কি সচেতনভাবে তাই করছেন? অবশ্য দুটিতে বেশ কীছু তফাত আছে। কর্মটি তখন করা হয়েছিল আরবি-ফারসি-উর্দু শব্দ প্রক্ষেপণ বা প্রবিষ্টকরণের মাধ্যমে আর এখন করা হচ্ছে ইংরেজি শব্দ প্রবিষ্টকরণের দ্বারা। তখন কর্মের মুখ্যকর্তা ছিল ঔপনিবেশিকতার প্রত্যক্ষ প্রতিভূ বিভাষী পাকিস্তানি স্বৈরাচার, আর এখন কর্মের কর্তা ভাষাবিচ্ছিন্নতাব্যাধিতে আক্রান্ত বাংলাভাষী সাহিত্যিকরা, তাঁরা কেউ বহির্দেশীয় ও বিভাষী নন।
বিশেষ একটি প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে গদ্য লেখকদের পক্ষে একজন জীবনানন্দের মতো বা একজন বিষ্ণু দের মতোন উত্তর দেওয়া কীছুতেই সঙ্গত হবে না। কবি বলতেই পারেন আমার কবিতা কেউ বুঝলে বুঝুক বা নাই বুঝুক আমি কবিতা লিখবই। কিন্তু মনে রাখতে হবে কবির এই সগর্ব ঘোষণার মধ্যে বিভাষা প্রবসনের আপদ আদৌ নেই। মাতৃভাষার শব্দরাশি ব্যবহার করেই কবি তাঁর অনির্বচনীয় অবধারণকে ব্যক্ত করেন বা তাঁর কাব্যিক জটিলতার প্রচ্ছন্নতা সর্জন করে অপরূপ চিত্রকল্প তৈরি করেন। তাই দুর্বোধ্য হওয়ার অধিকার যেমন কবির আছে সাধারণত গল্পকার কিংবা ঔপন্যাসিকের সে অবকাশ সচরাচর তেমন নেই। আর তারা যদি সে রকম কেউ হতে চান তাঁদরেকে অবশ্যই একমেবাদ্বিতীয়ম টমাস মান বা কমলকুমার মজুমদার হতে হবে। আর মান-কমলদের মতো হতে পারলেই কেবল তারা দুর্বোধ্য হবার অধিকার পাবেন, অন্যথায় নয়। তবে মনে রাখতে হবে যে বাংলা বাক্যের কাঠামোর ভেতরে জোরপূর্বক ‘ইংরেজি পা-িত্যের স্বকীয় ভা-ার থেকে’ সুন্দর সুন্দর অসীম ভাবার্থধর শব্দ তুলে এনে বাক্যের ভেতরে প্রক্ষেপণ করে দিলে তা বাংলা ভাষায় অর্থহীন বিদেশি শব্দের প্রবিষ্টকরণ বলে বিবেচিত হবে সহজেই, বাংলা ভাষায় আলাদা কোনো ভাষাশৈলী তৈরি করবে না, সেটা কেবল তৈরি হতে পারে বাংলা ভাষার আন্তর-শক্তির উজ্জীবন ঘটিয়েই। পাকিস্তান আমলে বাংলার সঙ্গে আরবি-ফারসি-উর্দু শব্দের মিশ্রণ ঘটিয়ে একটি আলাদা ভাষা তৈরির সচেতন প্রচেষ্টা চলেছিল। অদ্ভুত ছিল সে ভাষা, সে ভাষারীতির দ্বারা কোনো আলাদা ভাষাশৈলী তৈরি না হলেও ভাষাকে প্রদূষিত করার যথার্থ ও পরিপূর্ণ সম্ভব্যতা পরিলক্ষিত হয়েছিল। সে ভাষা সম্পর্কে হুমায়ুন আজাদ বলেনÑ ‘‘বাঙলা বিনাশের চক্রান্তরূপে ওই গোষ্ঠী একরকম ‘পাকিস্তানি বাঙলা’ বিকাশেরও চেষ্টা করেছিল। এই ‘পাকিস্তানি বাঙলা’র চেহারা এমন : গোজাশতা এশায়েতে আমরা অতীতে বাঙলা ভাষার নানা মোড় পরিবর্তনের কথা মোখ্তাসারভাবে উল্লেখ করেছিলাম। বাংলা ভাষা মুসলমান বাদশাহ্ এবং আমীর-ওমরাহদের নেক নজরেই পরওয়ারেশ পেয়েছিল এবং শাহী দরবারের শান-শওকত হাসিল করেছিল। (মাহে-নও, ১ : ৭, ১৯৪৯)।’’ (হুমায়ুন আজাদ, বাংলা ভাষার শত্রু মিত্র, অগামী প্রকাশনী, দ্বি.স. ফেব্রুয়ারি ১৯৯৯, পৃষ্ঠাÑ ২৩)।
আজ একবিংশ শতকের প্রথম দশকের সিঁড়ি ডিঙ্গিয়ে বলতে হচ্ছে, ছিলাম ভাষা-উপনিবেশিক বিচ্ছিন্নতার যে তিমিরে সেই তিমিরে ফিরিয়ে নেবার ফাঁকতাল খোঁজছেন আমাদেরই কতিপয় যশস্বী সাহিত্যিক। শেষ পর্যন্ত তাঁদের কাছে সশ্রদ্ধচিত্তে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করছে, আদপে তারা কি ‘জান্তে কিংবা অজান্তে’ উপনিবেশিক বিচ্ছিন্নতার কারিন্দা? এ প্রশ্নের যথাযথ উত্তর বা জুতসই একটি মীমাংসা দিয়ে গেছেন আমাদের এক যশস্বী প্রাবন্ধিক আব্দুশ শাকুর। স্বকৃত নোমান এক প্রবন্ধে আবদুশ শাকুর সম্পর্কে লিখেছেনÑ ‘‘যেমন ‘ফ্লাট’কে তিনি (আবদুশ শাকুর) লিখতেন ‘মহল’, কথাসাহিত্যিক না লিখে লিখতেন ‘কথাকার’। জিজ্ঞেস করলাম, ফ্লাট সর্ববাঙালির কাছে পরিচিত একটি শব্দ। বাংলা ভাষায় ফিউশন হওয়া এই ইংরেজি শব্দটি ব্যবহার করলে আসুবিধা কী? উত্তরে তিনি বললেন, বাংলা ভাষায় শব্দটি ফিউশন করেছে কারা? নিশ্চয়ই লেখকরা ! সেই লেখক দলিল লেখক হোক, কেরানি, পুস্তক লেখক বা কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক হোক। জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে শব্দটি হয় তো মুখে মুখে ব্যবহার করত ইংরেজি ভাষার আগ্রাসনের শিকার সাধারণ মানুষ। কিন্তু লেখক তার লেখনীর মাধ্যমে শব্দটিকে স্বীকৃতি দিলেন বলেই তো বাঙালিসাধারণ এটিকে অতিউৎসাহের সঙ্গে ব্যবহার করছে। লেখকরাই ভাষার গতিপ্রকৃতি নির্ধারণ করেন। আমি একজন লেখক, জেনেশুনে একটি ইংরেজি শব্দকে অকারণে আমার লেখায় কেন ফিউশন করব? এই স্বাধীনতা ভাষা আমাকে দেয় না। দেখ, ফ্লাট শব্দটি লেখা কতটা কঠিন। প্রথমে ‘ফ’, ফ-এর সঙ্গে ‘ল’ সংযুক্ত, তারপর ‘্য’, তারপর ‘া’, তারপর ‘ট’। ঘোরানো-প্যাঁচানো এই জটিল শব্দটি কেন আমি ব্যবহার করব? বাংলা ভাষায় মাত্র তিনটি অক্ষরে সহজ-সাবলীর ‘মহল’ শব্দটিকে আমি কেন উপেক্ষা করব? এই উপেক্ষা ঔপনিবেশিক প্রভাবিত হীনম্মন্যতার বহিঃপ্রকাশ বলে আমি মনে করি।’’ (স্বকৃত নোমান, কথাকারের সঙ্গে : আবদুশ শাকুর, মাসিক উত্তরাধিকার, নবপর্যায়ে ৫০তম সংখ্যা, বাংলা একাডেমি ঢাকা, ভাদ্র ১৪২০, নভেম্বর ২০১৩, পৃষ্ঠাÑ ১২১Ñ১২২)।
কিন্তু ভজকট একটা থেকেই গেল। বাংলায় ইংরেজি শব্দ বর্জনের ভাষ্য বা বিবৃতি রচনা করতে গিয়ে ইংরেজি ‘ফিউশন’ শব্দটির বাংলা প্রতিশব্দ পাওয়া গেল না, বিষয়টা কারো পক্ষে মেনে নেওয়া সমীচীন হবে কি? তাও এমন একজন পাঠকের পক্ষে যিনি ‘জেনেশুনে একটি ইংরেজি শব্দকে অকারণে’ একজন লেখকের নিজের লেখায় ব্যবহারের আপত্তির বিষয়ে অবগত হয়েছেন এবং স্মর্তব্য যে, পাঠকের এই অবগতি (অকারণে বাংলাভাষার বাক্যে ইংরেজি বা ব্যাপক অর্থে অবাংলা শব্দ ব্যবহার অসঙ্গত) আবদুশ শাকুরের মতো বাংলা ভাষায় অকারণে ইংরেজি শব্দ ব্যবহারের ঘোর বিরোধী একজন লেখকের বিবৃতিতে প্রবসিত হয়েছে। এখানে লেখক স্বকৃত নোমান স্বয়ং ‘ফিউশন’ শব্দটিকে কথোপকথনের মধ্যে প্রথম প্রয়োগ করেছেন বা গলিয়ে দিয়েছেন। অর্থাৎ এখানে বাংলাবাক্যে ফিউশনবিরোধী কথাবার্তায় একটি ফিউশন ঘটেছে। এতে সহজেই বোধোদয় হয় যে, যেখানে দুজন ভাষাসচেতন সাহিত্যিক মানুষের কথোপকথনে বাংলা ভাষায় ইংরেজির ফিউশন ঘটে, সেখানে বাংলাভাষায় ইংরেজির ফিউশনকে ঠেকানো চাট্টিখানি কথা নয়। প্রকৃতপ্রস্তাবে আমরা বাঙালিরা ইংরেজির বিশ্বগ্রাসী সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন থেকে বেরিয়ে আসতে পারছি না, ইংরেজি আমাদের মধ্যে একটি প্রচ্ছন্ন ভাষাবিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করে রেখেছে। প্রমাণ হিসেবে স্বকৃত নোমানকে (সবিনয়ে ক্ষমা প্রার্থী শ্রদ্ধেয় স্বকৃত নোমানের কাছে, আবদুশ শাকুর ফিউশন শব্দটি হয় তো ব্যবহার করতেন না যদি না অনবধানতাবশত শব্দটির অবতারণা আপনি না করতেন। স্বীকার করে নিয়ে।) তো হাতের কাছেই মিললো, সেটা থেকে যখন স্বকৃত নোমানের মতো সম্পন্ন লেখকেরা বেরিয়ে আসতে পারছেন না আমরা সাধারণরা তো কোন ছার। তা ছাড়া আরবি থেকে বাংলাভাষাদেশে আগত এবং প্রবসিত বহুরূপী ‘মহল’ শব্দটিকে নিয়ে যে কারো আপত্তি থাকতে পারে। এর একাধিক অর্থ আছে। মহল বলতে সমাজ, সংঘ, শ্রেণি যেমন বুঝি তেমনি বুঝি গৃহ, ঘর, বাড়ির অংশ বা ক্ষেত্র বিশেষে তালুক বা জমিদারির অংশ বিস্তৃত ভুসম্পত্তিও বুঝতে পারি। সুতরাং ‘ফ্লাট’ শব্দটির বাংলা অনেকার্থবোধক ‘মহল’ ব্যবহার না করে আলয়, আবাস, ভবন, সদন, নিলয়, গৃহ, ঘর ইত্যাদি বাংলা শব্দ থেকে পছন্দসই যে কোনো একটাকে ব্যবহার করা কি বেশি সঙ্গত নয়?
স্বীকার করছি আমি অধম ইংরেজিতে একবারেই ক-অক্ষরগোমাংস। তবু ‘ফিউশন’ শব্দটি কর্ণকোহরে প্রক্ষিপ্ত হলেই এটমবোমা আর এটমবোমার বিস্ফোরণের ভয়াবহ প্রসঙ্গ মনে পড়ে যায়। প্রায়োগিক পদার্থবিদ্যার সঙ্গে শব্দটির আত্মীয়তা খুব। এটি কী করে বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে নিজের সম্পৃক্ততাকে পাকাপোক্ত করতে চায় সেটা আমার একেবারেই বোধাগম্য নয়। দায়সারা গোছের একটি গরুখোঁজা করে যা পেলাম তাতে মনে হলো ‘ফিউশন করেছে’ মানে গলিয়ে দিয়েছে যদি হয়, তবে এই শব্দটির অনায়াসে বাংলা করা যায় একীকরণ বা প্রক্ষিপ্ততা । আবদুশ শাকুর যদি ‘বাংলা ভাষায় শব্দটি ফিউশন করেছে কারা?’ না বলে ‘বাংলা ভাষায় শব্দটি সংমিশ্রণ করেছে কারা? বা ‘সংমিশ্রণ করেছে’-এর স্থানে ‘মিশিয়ে দিয়েছে’ বলতেন, তা হলে কি ভাব প্রকাশে ঘাটতি দেখা দিত, না কি ভাববিনিময়ের কার্যসিদ্ধি হতো না, কথোপকথনকারী দুজনের মধ্যে ভাষিক সংযোগ স্থাপনে কোনোরূপ বিঘœ ঘটতো? আমাদের বাংলা একাডেমির ইংরেজি-বাংলা অভিধানে শব্দটির বাংলা অর্থ করা হয়েছেÑ ‘গলন, একীভবন, সংমিশ্রণ’। অন্যদিকে কলকাতার সাহিত্য সংসদ ইংরেজি-বাংলা অভিধানে শব্দটির বাংলা অর্থ করা হয়েছেÑ ‘গলন, গলাইয় বা গলিয়া মিশ্রণ, একীকরণ বা একীভবন’। একটি কথা স্পষ্ট যে, ইংরেজি ফিউশন শব্দের বাংলা নেই বা জুতসই বাংলা করা যাবে না এমন যুক্তি উত্থাপন করে শব্দটিকে বাংলা ভাষায় অপরিহার্য শব্দ হিসেবে (চেয়ার, টেবিল-এর মতো) গ্রহণের কোনো যৌক্তিকতা নেই, অপরদিকে যদি কেউ আবদুশ শাকুরের মতো ‘ফ্লাট’ শব্দটিকে বাতিল করে দিয়ে ‘মহল’ (< আ. মহুল) শব্দটিকে ছাড়পত্র দেবার সমীচীন সিদ্ধান্ত থেকে বিরত থাকেন তবে সেটা সর্বার্থে ভাষাবিচ্ছিন্নতার উদ্দেশ্যপ্রণোদিত দালালি ভিন্ন অবশ্যই অন্য কীছু হবে না। আর এ কথাটি মনে রাখা অত্যন্ত জরুরি যে, একজন বাঙালির পক্ষে ভাষাবিচ্ছিন্নতাকে অনুমোদন করার অর্থ হলো বাঙালি জাতিসত্তা থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করা। হতে পারে তা সচেতন বা অসচেতন প্রকরণে। তা যেভাবেই হোক, ভাষাবিষয়ে এমন ভ্যবিচার নির্বিচারে মেনে নেওয়াটা খাঁটি বাঙালির পক্ষে সর্বার্থে অযৌক্তিক বা যে কোনও বিবেচনায় অসমীচীন। শেষ বিচারে তাঁরা দু‘জনই, আবদুশ শাকুর ও স্বকৃত নোমান, যাঁদের দু‘জনেরই লেখার ভক্ত আমি, আমার পক্ষেই থাকবেন, এটা অনিবার্য। কারণ ‘ভাষাবিচ্ছিন্নতার উদ্দেশ্যপ্রণোদিত দালাল’-কে তাঁদের দু‘জনের কেউই বরদাস্ত করবেন না, জানি। সেই সঙ্গে প্রিয় ধ্রুব ও শীর্ষেন্দু কিংবা শংকরলাল তাঁদেরকেও চাই সঙ্গে এবং অন্য সকল সাহিত্যসাধককে। বাংলা ভাষাকে পবিত্র রাখা, সইে সঙ্গে বিকশিত ও সমৃদ্ধ করার সার্বিক দায়িত্ব আমাদের সকলের। এ কথাটা মনে রাখতে হবে, ভুলে গেলে চলবে না। ভুলে গেলে চলবে না যে, রবীন্দ্রনাথ ইংরেজি ইন্টারন্যাশনাল, আটলান্টিক ও স্প্যাসিফিকের বাংলা যথাক্রমে সার্বজাতিক (আন্তর্জাতিক নয়), অতলান্তিক ও প্রশান্ত (প্রশান্ত মহাসাগর) করে দিয়ে গেছেন, সেই কবে। বিভাষাকে স্বভাষায় রূপান্তরের শক্তিমত্তা বাংলা ভাষার কতটা রবীন্দ্রনাথসহ তাাঁর উত্তরসূরিরা প্রতিনিয়ত তার সার্থক প্রমাণ উপস্থিত করেছেন, তাঁদের সৃষ্টিসম্ভারের পরতে পরতে। হুমায়ুন আজাদ ইংরেজি ‘ইমেজ’ শব্দের বাংলা করেছেন ‘ভাবমূর্তি’ কিংবা অতিসম্প্রতি ‘ইন্টারনেট’ শব্দের বাংলা লেখা হচ্ছে ‘আন্তর্জাল’। এমন উদাহারণ ইচ্ছে করলেই হাজির করা যায় হাজারটা। তা ছাড়া উভয় বঙ্গে ইতোমধ্যে জ্ঞানের বিভিন্ন বিশেষায়িত শাখা-প্রশাখার পারিভাষিক বাংলাকাষ তৈরি হয়ে গেছে। তো ভাংলাভাষায় সাহিত্যসাধকদের ভাবপ্রকাশের হীনতাগ্রস্ত হওয়ার কোনওই অবকাশ নেই। যদিবা কারও পক্ষে সত্যিকার অর্থে অবকাশ মেলে, তা তাঁর ভিক্ষাবৃত্তি পরিহার করতে না পারার অন্তর্গত দুরারোগ্য ব্যাধি কিংবা তার স্বীয় দাসমানসতার প্রবল প্রভাবকে অতিক্রম করতে না পারার দুর্বলতা। তখন অবশ্যই তাকে উপনিবেশিকতার কারিন্দার ক্যারিসমা প্রকাশের অপবাদ সইতেই হবে, এর কোনও অন্যথা হবে না, যতদিন পর্যন্ত রবীন্দ্র-নজরুল-সুকান্ত-জীবনানন্দের উত্তরসূরিরা বাংলাভাষায় কথা বলবে, সাহিত্যসাধনা করবে। স্বদেশ আক্রান্ত হলে যেজন শত্রুর পক্ষাবলম্বন করে বা দাাঁড়িয়ে মজা দেখে, তার নাম ইতিহাসের পৃষ্ঠায় বিশ্বাসঘাতক হিসেবে লেখা থাকবেই, লোকে তাকে রাজাকার বলবেই। লেখক: কবি, সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক ও গবেষক।

Print Friendly, PDF & Email

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর
themesbazarhaor24net
© All rights reserved © 2019-2024 haor24.net
Theme Download From ThemesBazar.Com
error: Content is protected !!