আমরা অনেক মন্ত্রী দেখেছি এই মন্ত্রীর মতো কাউকে দেখিনি। আমরা এমন মন্ত্রী দেখেছি যিনি একজন সচিবের অশিষ্ট, অসাংবিধানিক ও সকল প্রকার ভব্যতাবিবর্জিত মন্তব্য সকর্ণে শ্রবণ করে টুশব্দটি করেননি, রবীন্দ্রনাথের ভাষায় যাকে বলে ‘নিশ্চুপ’ এবং ইংরেজদের ভাষায় ‘স্পিকটি নট’ থেকেছেন। সেদিন আমরা সুনামগঞ্জবাসী কাতর হওয়ারও কোনও অবকাশ পাইনি, বরং অধিক শোকে পাথর হওয়া ভিন্ন আমাদের কোনও গত্যান্তর ছিল না। ২০১৭ সালের ঘটনা। হাওরাঞ্চলের ফসলডুবি ঘটেছে শতভাগ। পরিস্থিতি সরেজমিনে পরিদর্শনে সুনামগঞ্জে এসেছেন একজন মন্ত্রী, সঙ্গে দুর্যোগ সচিবও। তখন পরিস্থিতির ভয়াবহতার পরিপ্রেক্ষিতে সুনামগঞ্জের সর্বমহলের পক্ষ থেকে সুনামগঞ্জকে দুর্গত এলাকা ঘোষণার জোর দাবি উঠেছিল। মতামতসভায় সচিব বললেন যে : “অপেক্ষা করুন, অর্ধেক মানুষ মারা গেলে সুনামগঞ্জকে দুর্গত ঘোষণা করা হবে, অন্যথায় নয়, এখানে এখনও পর্যন্ত একটি ছাগলও মারা যায়নি, দুর্গত ঘোষণার প্রশ্নই ওঠে না এবং সুনামগঞ্জের মানুষ এতাটাই মূর্খ যে, দুর্যোগ সম্পর্কে তাদের কোনও ‘জ্ঞান’ই নেই, তাই এমন দাবি তোলেছে।” একজন মানুষের হিম্মতের বলিহারি। সচিব বলে কথা। পাশে বসা মন্ত্রী মুচকি হেসে নির্বিকার থাকলেন। আমরা সেদিন মন্ত্রী দেখেছিলাম। এইবার আবার মন্ত্রী দেখলাম। সিলেটের সার্কিট হাউজে সিলেট বিভাগীয় উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন অগ্রগতি পর্যালোচনা সভায় ‘পরামর্শক ব্যয়’-এর যৌক্তিকতা সম্পর্কে সংশ্লিষ্টদের সামনে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এক মন্ত্রী এবং তিনি ‘পরামর্শক ব্যয়’কে সরকারি টাকার ‘অপব্যয়’ বলে অভিহিত করেছেন। প্রতিবেদন পড়ে জানা যায়, প্রকল্প পরিচালকদের উদ্দেশ্য করে তিনি বলেছেন, ‘আপনারা ৩০ লাখ টাকার গাড়ি চড়ছেন ঢাকায় বসে। এসব গাড়ি ঢাকায় ঘোরাফেরা করার জন্য দেওয়া হয়নি। প্রকল্প এলাকায় থাকার জন্য গাড়ি দেওয়া হয়েছে। অথচ আপনারা গাড়ি নিয়ে ঢাকায় ঘুরছেন পরিবার নিয়ে। এটা সাধারণ মানুষের টাকার অপচয় করা। এই অপচয় সহ্য করা হবে না।’ ক্ষুব্ধ এই মন্ত্রীর নাম এম.এ. মান্নান, আমাদের সুনামগঞ্জের সন্তান, পরিকল্পনামন্ত্রী। মন্ত্রী আপনাকে ধন্যবাদ। ধন্যবাদের সঙ্গে অভিবাদন এবং কবোষ্ণ করমর্দন। এমন কথা আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়া আর কেউ তেমন করে বলেন না। এক সময় বলতেন বঙ্গবন্ধু। কিন্তু কথা হলো, কথাগুলোকে মুখে আওড়ালেই চলবে না, বরং কাজে পরিণত করতে হবে। যেহেতু আওয়ামী লীগকে রাজনীতিতে টিকে থাকতে হবে। যেহেতু মানুষকে এইসব মেকলেপন্থী বা মেকলের বাংলাদেশি সাকরেদের কবল থেকে মুক্ত করতে হবে। ভুলে গেলে চলবে না, এইসব ‘পিডি’ (প্রকল্প পরিচালক)-দের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করতে না পারলে বর্তমান বিশ্বের সংঘাতপূর্ণ ও প্রতিযোগিতামূলক পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের মতো বাংলাদেশও একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হবে, যেমন কয়েক বছর আগে পাঁচ পাঁচ বার বাংলাদেশ বিশ্বে সেরা দুর্নীতিবাজ দেশে পরিণত হয়েছিল। অথচ এই দেশের শতকরা পঁচান্নব্বইজন মানুষের কেউই দুর্নীতিবাজ নয় বরং দুর্নীতির শিকার। দেশের মানুষ প্রত্যাশায় ভরপুর হয়ে আপনার মতো মানুষের অপেক্ষায় আছে। যেসব জনবিরোধী মানুষেরা, যারা জনগণের টাকা মেরে জনগণকে কষ্টের আগুনে দগ্ধ করে নিজের জীবনের সুখ কেনে, তাদেরকে ছেড়ে দেবেন না। সাধারণ মানুষকে একটু দয়া করুন। অক্টোবর বিপ্লবের পর রাশিয়াতে এই সব পরগাছাদের বিপ্লবীরা কিন্তু ছেড়ে দেয়নি। জনগণের পক্ষের সকল নীতিকে কাজে পরিণত করা হয়েছিল। আওয়ামী লীগকে নিজের অস্তিত্বকে সংহত করতে হলে নিজের দলের ও দলের বাইরের সকল দুর্নীতিবাজদেরকেই প্রতিরোধ নয়, একেবারেই নির্মূল করতে হবে। নিজের দলে দুর্নীতিবাজ পোষে দুর্নীতির প্রতি শূন্যসহনশীলতা একবারেই অর্থহীন।