শহীদনুর আহমেদ::
২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে হাওরের বোরো ফসলরক্ষা বাঁধের কাজ শেষ না হওয়ায় জরুরি সংবাদ সম্মেলন করেছে হাওর বাঁচাও সুনামগঞ্জ বাঁচাও আন্দোলন। বৃহস্পতিবার সকাল ১১ টায় শহীদজগৎজ্যোতি পাঠাগারে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে জেলার ১১ উপজেলায় পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক নির্মাণাধীন ফসলরকক্ষা বাঁধের কাজের সর্বশেষ পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়। হাওর বাঁচাও সুনামগঞ্জ বাঁচাও আন্দোলন কেন্দ্রীয় কমিটির সহ সভাপতি অ্যাড. স্বপন কুমার দাস রায়ের সভাপতিত্বে সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন সাধারণ সম্পাদক বিজন সেন রায়। লিখিত বক্তব্যে হাওরে ফসলরক্ষা বাঁধ নির্মাণ কাজ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শেষ না হওয়ায় নির্মাণ কাজে নানা অনিয়ম দুর্নীতি তুলে ধরে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। লিখিত বক্তব্যে অভিযোগ করা হয় ফসলরক্ষা বাঁধের পানি উন্নয়ন বোর্ডের অগ্রগতি প্রতিবেদনের সাথে বাস্তবের মিল নেই। পাউবোর অগ্রগতি প্রতিবেদনে ফসলরক্ষা বাঁধ ৮০ ভাগ শেষ হওয়ার কথা বললেও বাস্তবে পরির্দশ করে দেখা যায় কাজ হয়েছে মাত্র ৫০ থেকে ৬০ ভাগ। অধিকাংশ বাঁধের কাজে এখনো মাটি ফেলা বাকি। নীতিমালা অনুযায়ি বাঁধের ৩০ মিটার দুরুত্ব থেকে মাটি উত্তোলন থেকে মাটি উত্তোলন, উচ্চতা অনুযায়ি দ্বিগুন স্লোপ, কম্পেকশন ও দুরমুজ দেয়ার কথা থাকলেও তার কোনো তোয়াক্কা করছেন না সংশ্লিষ্ট পিআইসিরা। সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করা হয় গণশুনানির মাধ্যমে পিআইসি গঠন না করে অসংখ্য অপ্রয়োজনীয় বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। রাজনৈতিক প্রভাব কাটিয়ে এই সকল পিআইসিতে অধিক বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। যার মাধ্যমে সরকারের কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হচ্ছে বলে উল্লেখ করা হয়।
সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার গৌরারং ইউনিয়নের ৩নং ও নং ও রঙ্গাচর ইউনিয়নের ৬নং পিআইসিগুলো পরিদর্শন করে এই পিআইসিগুলোকে অপ্রয়োজনীয় বলে দাবি করছেন তারা। এগুলো হাওরে ফসলরক্ষার কোনো কাজে আসবে না বলে জানানো হয়। কাংলার হাওর উপ-প্রকল্পের ৭নং পিআইসি একটি ছোট ভাঙা বন্ধ করার জন্য ১৬ লক্ষ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এই ভাঙার জন্য ১৬ লক্ষ টাকার কোনো প্রয়োজন নেই বলে জানিয়েছেন তারা। তাছাড়া কোনো বাঁধেই দুরমুজ করা হচ্ছে না। বাঁধে ঘাস লাগানোর কথা থাকলেও রঙ্গারচর ইউনিয়ের ৮নং পিআইসি ছাড়া আর কোথাও ঘাস লাগানো হয়নি। নিয়মানুযায়ী বাঁধের উচ্চতা ৫-৬ ফুট, প্রস্থ ১২ ফুট এবং স্লোপ (ঢাল) উচ্চতার দ্বিগুণ হওয়ার কথা থাকলেও কোনটাই করেনি পিআইসির লোকজন। ১, ৬, ৮, ৯নং পিআইসিগুলোতে বাঁধের গোড়া থেকে মাটি উত্তোলন, উচ্চতা অনুযায়ী স্লোপ না দেয়া, দুরমুজ না দেয়াসহ ঘাস লাগানো হয়নি। দিরাই উপজেলার মাছুয়াখালী ও বরাম হাওরে ১নং পিআইসিতে কালো মাটি ব্যবহার করা হচ্ছে, যা নিয়ম বহির্ভূত বলে উল্লেখ করা হয়। দিরাই উপজেলায় ১০১টি পিআইসি’র মাধ্যমে ফসলরক্ষা বাঁধ নির্মাণের কাজ চলছে। নীতিমালা অনুযায়ী কোন বাঁধেই কাজ হচ্ছে না বলে জানান তারা। উপজেলার রফিনগর, ভাটিপাড়া, করিমপুর, জগদল, তাড়ল ইউনিয়নের অধিকাংশ বাঁধ পরিদর্শন করে নির্মাণকাজের নানা অনিয়ম ও উদাসীনতার চিত্র দেখতে পান তারা। ১৯ লক্ষ ৪৮ হাজার টাকা ব্যয়ে রফিনগর ইউনিয়নের কালিকোটা হাওর উপ্রকল্পের ৭৬৫ মিটার কাজ বাস্তবায়নে ৪৫(ক)নং পিআইসির সভাপতির দায়িত্বে রয়েছেন এই ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান রেজুয়ান হোসেন। ৭৬৫ মিটার কাজের এখনও ২০ ভাগই হয়নি। এক-দুশো মিটার করে বন্ধ রয়েছে নির্মাণকাজ। বাঁধের বিশাল অংশে মাটি ফেলানো বাকি থাকায় ভয়ে আছেন কালিকোটা হাওরের কৃষকরা। একই অবস্থায় আছে কালিকোটা উপ-প্রকল্পের ৪৫নং পিআইসি’র সভাপতি রঞ্জন সরকারের কাজ। বাঁধের দীর্ঘ অংশ ফাঁকা পড়ে রয়েছে। যেটুকু কাজ হয়েছে তাতেও স্লোপ, কম্পেকশন ঠিক নেই। কাজ বাকি থাকলেও ইতোমধ্যে ২০ লক্ষ ১৪ হাজার টাকার প্রকল্পের অর্ধেক টাকা উঠিয়ে নিয়েছেন রঞ্জন সরকার। ২৬(ক) নং পিআইসির কাজের অবস্থাও খারাপ। ২০ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা প্রকল্পের বরাদ্দের অর্ধেক টাকা উঠিয়ে নিলেও প্রায় ১ কিলোমিটার কাজের প্রায় অর্ধেকই বাকি। এক তৃতীয়াংশ কাজ বাকি ৪৬নং পিআইসিতে। ২৫নং পিআইসির ৫০১ মিটার প্রকল্পের ডুবন্ত বাঁধের ভাঙ্গা মেরামতে মূল ভাঙ্গা এখনও বাকি। ২৫(ক) নং এর ৮৪৮মিটারের কাজে যাচ্ছেতাই মাটি ফেলানো হয়েছে। ২৬ ও ২৭নং পিআইসির বাঁধে মাটি ফেলা হলেও বাকি রয়েছে দুরমুজ, কম্পেশন ও ঘাস লাগানোর কাজ। ভাটিপাড়া ইউনিয়নের ৯২নং পিআইসি’র মধুরাপুরের ভাঙ্গায় এখনও কাজ শুরু হয়নি। করিমপুর ইউনিয়নের চাপটির হাওর উপ-প্রকল্পের ৫৯ নং ও ৫৯(ক) নং পিআইসি’র কাজ ২৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অর্ধেক বাকি। একটি এস্কেভেটর দিয়ে দুই পিআইসির বাঁধ নির্মাণ কাজ করা হচ্ছে। চাপটির হাওর উপপ্রকল্পের ৮৬নং পিআইসি’র শ্যামের ভাঙ্গা এখনও ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। ভাঙ্গার স্লোপে মাটি পড়েনি। আঁড় দেয়া হলেও ব্যবহার হয়নি বস্তা। ৮৬নং পিআইসি’র কাজ এখনো বাকি রয়েছে। তাড়ল ইউনিয়নের ৪নং পিআইসির বৈশাখী ভাঙ্গায় কাজ অনুপাতে বরাদ্দ বেশি দেয়ার অভিযোগ করেছেন তারা। মাত্র ৫১ মিটার ভাঙ্গা মেরামতের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে প্রায় ২৫ লক্ষ টাকা।
শাল্লা উপজেলার ১১৪টি পিআইসির মধ্যে কাজের অগ্রগতি খুব খারাপ। জেলার অন্যান্য উপজেলার চেয়ে শাল্লায় অনিয়ম দুর্নীতির চিত্র বেশি বলে জানান তারা। উপজেলার হবিবপুর ইউপির বরাম হাওর উপ-প্রকল্পের ১৭নং পিআইসিতে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ২২লাখ ৮৪হাজার টাকা। প্রকল্পের দৈর্ঘ্য দেখানো হয়েছে ১৭৭০ মিটার। একই স্থানে গত অর্থ বছরে বাঁধ নির্মাণের কাজ হয়েছে। যা এখনও দৃশ্যমান আছে। নতুন করে মাটি ফেলার প্রয়োজন না থাকলেও চলতি অর্থবছরে এই অক্ষত বাঁধে চলছে কাজ। যাকে অপ্রয়োজনীয় দাবি করছে সংগঠনটি। এই বাঁধে এবছর মাটি ফেলার কোনো প্রয়োজনই ছিল না বলে জানান তারা। একই ইউনিয়নের ১০নং ও ১২নং ভান্ডাবিল হাওর উপ-প্রকল্পে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ১১লাখ ৭হাজার টাকা। একেও অপ্রয়োজনীয় বলছেন তারা। কেননা গত অর্থবছরের কাজই এখনও দৃশ্যমান। উদগল বিলের ৪২নং প্রকল্পে ২৯৫মিটারের বিপরীতে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ১৮ লাখ ৮৯ হাজার টাকা। এই বাঁধটি গত বর্ষায় না ডুবায় মানুষ বর্ষায় পায়ে হেঁটে দাড়াইন বাজার যেতে পেরেছে বলে জানান তারা। এই বাঁধে এত বিপুল পরিমাণ বরাদ্দের প্রয়োজন ছিল না । অন্যদিকে ভেড়াডহর হাওর ৩৯নং প্রকল্পে ৮৭৪ মিটারের বিপরীতে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ২০লাখ ৭২হাজার টাকা। বাঁধটি ডুমরা গ্রাম হতে মুক্তারপুর ব্রিজ পর্যন্ত। বাঁধটি হাওরের ফসলরক্ষায় কোনো কাজে লাগবে না বলে জানান তারা। আটগাঁও ইউপির কালিকোটা হাওরের ৬৫নং প্রকল্পে ৮৭০মিটারের বিপরীতে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ২৩ লাখ ৭০হাজার টাকা। এই বাঁধে অতিরিক্ত বরাদ্দ দেয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। এসব লুটপাট করার জন্যই করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন তারা। ছায়ার হাওরের ৭৫নং প্রকল্পের কোনো প্রয়োজন ছিলো না বলে জানান তারা। তাহিরপুর উপজেলায় পিআইসি রয়েছে ৬৬টি। মাটিয়ান হাওরে আশেপাশে মাটি সংকট রয়েছে। মাটি কাটার যে মেশিন ২টি রয়েছে যার দু’টিই নষ্ট। যার ফল স্বরূপ পিআইসি’র ৩৮, ৪৬ এবং ৪৭-তে কাজ হয়েছে মাত্র ২০ শতাংশ। প্রতিটি কাজেই নানা অনিয়ম-দুর্নীতির পাওয়া গেছে বলে জানান তারা। জামালগঞ্জ উপজেলায় ২৬, ৩৫, ৪২, ৪৪, ৫১ এবং ৫২নং পিআইসির বাঁধগুলোতে কাজ হয়েছে ৩০ এবং ৪০ শতাংশ। অনেক পিআইসি গঠিত হয়েছে ভিন্ন ইউনিয়ন ও ওয়ার্ডের লোক দ্বারা। দিরাই উপজেলাধীন জামালগঞ্জের পাগনার হাওরের ৪৭নং পিআইসির অবস্থা খুব খারাপ। তাছাড়া নেত্রকোণা জেলার খালিয়াজুড়ির উপজেলাধীন ৫ ও ৬নং পিআইসির কোনো কাজ শুরু হয়নি। এই পিআইসিগুলোর কাজ সঠিকভাবে না হলে জামালগঞ্জের ফসল তলিয়ে যাবে বলে জানান তারা। তাছাড়া বাঁধের কাছ থেকে মাটি তোলা দিচ্ছে। যার ফলে বাঁধগুলো বেশি দিন টিকবে না। ছাতক উপজেলার নাইন্দার হাওরের ১, ২, ৩নং পিআইসির কাজ ধীরগতিতে হচ্ছে। তাছাড়া কাজের অনিয়মের কারণে চাউলের হাওরের পিআইসি ৭নং বাঁধে ফাটল দেখা দিয়েছে। ধর্মপাশা উপজেলার ৮৭টি হাওরে ৪০ শতাংশ কাজ হয়েছে। যার মধ্যে চন্দ্রসোনার তালে ২০ শতাংশ হয়েছে। দোয়ারাবাজার উপজেলার হাওরের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধ পাহাড়ী নদী খাসিয়ামারা’র ডান তীর। বাম তীরও কম ঝুঁকিপূর্ণ নয়। এই দুই ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধ উঁচু করার জন্যই ৪ টি প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটিকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৪৪ লাখ টাকা। প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির দায়িত্বশীলরা বাঁধের কাজ করেছেন বাঁধের নীচের খাসিয়ামারা নদীর বালি দিয়ে। এছাড়াও জগন্নাথপুর ও বিশ্বম্ভরপুর উপজেলায় ফসলরক্ষা বাঁধের নানা অনিয়ম-দুর্নীতির খবর পাওয়া গেছে বলে জানান সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। এই দ্ইু উপজেলায় একাধিক অপ্রয়োজনীয় বাঁধ গ্রহণ করায় সরকারের বিপুল অর্থ অপচয় ও আত্মসাত করা হচ্ছে। বাঁধের গোড়া থেকে মাটি উত্তোলন, উচ্চতা অনুযায়ী স্লোপ না দেয়া, কম্পেকশন না করা, বাঁধে দুরমুজ না দেয়াসহ বাঁধে বিভিন্ন অনিয়ম লক্ষ করা গেছে বলে জানা তারা। তাছাড়া প্রায় অধিকাংশ বাঁধে এখনও কাজ শেষ হয়নি। এতে সংশ্লিষ্ট হাওর অরক্ষিত রয়েছে এবং নদীতে পানি বাড়লে হাওরগুলোতে পানি ঢোকার আশঙ্কা রয়েছে বলে জানান তারা।
হাওরের এমন অবস্থায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। অনতিবিলম্বে হাওরের বোরো ফসলরক্ষা বাঁধ নীতিমালা অনুযায়ী সমাপ্ত করতে সংশ্লিষ্টদের প্রতি তাগাদা দেন তারা। অন্যথায় হাওরে বিপর্যয় ঘটলে এর দায় সংশ্লিষ্টদের নিতে হবে হবে বলে হুশিয়ারি দেন তারা। নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ না হওয়ার প্রতিবাদে আগামী শনিবার জেলার প্রতি উপজেলা ও ইউনিয়ন ব্যাপী মানববন্ধনের ডাক দিয়েছে সংগঠনটি। সংবাদ সম্মেলনে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, সংগঠনের উপদেষ্ঠা বিকাশ রঞ্জন চৌধুরী, রমেন্দ্র তালুকদার, চন্দন রায়, সহসভাপতি সুকেন্দু সেন, যগ্ম সাধারণ সম্পাদক সালেহীন চৌধুরী শুভ, সাংগঠনিক সম্পাদক মাসুম হেলাল, এমরানুল হক চৌধুরী, একে কুদরত পাশা, সিনিয়র সদস্য রবিউল ইসলাম, স্বপন কুমার রায় কোষাধ্যক্ষ প্রদীপ পাল, বাঁধ বিষয়ক সম্পাদক ওবায়দুল হক মিলন, জনসংযোগ সম্পাদক শহীদনুর প্রমুখ।