সমাজমানসতা বলে একটা কথা আছে। কথাটা আমজনতার বোধগম্য নাও হতে পারে। কিন্তু কথাটার নিহিতার্থ সবটাই আমজনতার মনের বাস্তবতাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। এই সমাজমানসতা দেশকালপাত্র ভেদে ভিন্ন ভিন্ন। আইএসযোদ্ধার বউর ব্রিটিশ নাগরিকত্ব বাতিলের কারণে ওই বউটি ইংল্যাণ্ড ফিরতে পারেনি এবং তার শিশুপুত্রটি মারা গেলে ইংল্যান্ডের লোকেরা সরকারের সমালোচনায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। ওই শিশুটির করুণ পরিণতির জন্য দায়ী করা হয়েছে সরকারকে। তাঁরা বলছেন, সরকারের দায়িত্ব ছিল শিশুটিকে নিয়ে আসা ও তাকে সুরক্ষা দেওয়া। যেহেতু মায়ের নাগরিকত্ব বাতিল হলে শিশুর নাগরিকত্ব বাতিল হয়ে যায় না। এখানে প্রধান বিবেচ্য বিষয় হলো, নাগরিকের অধিকার খর্বিত হয়েছে। যা কোনওভাবেই সঙ্গত নয়। এটিই হলো ইংল্যান্ডের মানবিকতা কিংবা সমাজমানসতা।
গত ১৪ মার্চের দৈনিক সুনামকণ্ঠের একটি সংবাদপ্রতিবেদন থেকে জানা যায় বাসাবাড়িতে ঝিগিরি, দিনমজুরি ইত্যাদি হাড়ভাঙা খাটুনি খেটে উপার্জিত আয়ের টাকায় যাত্রী রানি দত্ত নামের এক মহিলা জনৈক মালিকের কাছ থেকে দুই শতক জায়গা কিনে তাতে ঘর করে থাকতেন। কিন্তু ওই মালিক অন্য একজনের কাছে যাত্রী রানির বাসার জায়গাটি আবার একজনের কাছে বিক্রি কর দেন এবং দ্বিতীয় ক্রেতা জেনেশুনে জায়গাটি ক্রয় করে সন্ত্রাসী কায়দায় যাত্রী রানির ঘর ভেঙে দিয়ে তাকে উৎখাত করেন। জায়গা বুঝে পেতে দাবি নিয়ে গেলে দ্বিতীয় ক্রেতা যাত্রী রানির গায় হাত তোলতে কার্পণ্য করেননি। পত্রিকায় লেখা হয়েছে, ‘২০১৮ সালের ২৮ মার্চ জায়গা বুঝে পেতে লাল মিয়ার ছেলে কবীরের কাছে গেলে কবীর তাকে রাস্তায় ফেলে বেদম মারপিট করেন। এ ঘটনায় মামলা হলেও প্রভাবশালীদের আত্মীয় হওয়ায় কবীর রেহাই পায়। এখন সব সময় তাকে হুুমকি ধামকি দিয়ে যাচ্ছে তারা। জায়গা জমি চাইলে খুন করবে এমন হুমকি দিচ্ছে বলে যাত্রী জানান।’ এই মামুলি বর্ণনটি যতোই মামুলি হোক না কেন, তাতে বর্ণিত ঘটনার সামগ্রিক পরিপ্রেক্ষিতটি চূড়ান্ত বিবেচনায় যে-কোনও সচেতন ও বিবেকবান মানুষের কাছে সমাজমানসতার দর্পণ হয়ে ওঠে অনায়াসে এবং প্রকারান্তরে এই সহজ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, সমাজ-সরকার সাক্ষীগোপালের ভূমিকা পালন করে চলেছে।
একটি শিশুর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে নাগরিক অধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি ব্রিটিশদের চিন্তাজগতে তোলপাড় সৃষ্টি করে। আর বাংলাদেশে যাত্রী রানির দখলচ্যুতি, দখলের অধিকার পেতে গেলে উত্তমমতো উত্তমমধ্যমের অধিকারী হওয়া, কিংবা কোনও একটি কিশোরীকে দিনের পর দিন আটকে রেখে ধর্ষণ, এমন কি প্রয়োজনে খুন করা, ধর্ষক মাওলানার পক্ষে ফতোয়া জারি করেও লোকে পার পেয়ে যায়। এইরূপ জঘন্য সব প্রকরণে নাগরিক অধিকার লঙ্ঘিত হওয়ার পরও সামাজিক বিচার ও আইনের আওতা মুক্ত থেকে দিব্যি দিনযাপন করে অপরাধীরা। সমাজ তাদের সকল অপকর্ম মেনে নেয় কিংবা সহ্য করে এবং প্রধানমন্ত্রী দুর্র্নীতি ও সন্ত্রাসকে শূন্যসহনশীলতা প্রদর্শনের প্রত্যয় ব্যক্ত করেন প্রতিনিয়ত এবং তাঁর দেশের প্রশাসন ও লোকেরা তার নির্দেশকে শূন্যসহনশীলতা প্রদর্শন করে। এরই নাম অবাক বাংলাাদেশ।
আমরা অধিক কীছু বলতে চাই না। প্রশাসনকে কেবল বলি, এই যাত্রী রানির দিকে একটু সদয় দৃষ্টি নিক্ষেপ করুন। এই শ্রমজীবী মহিলা তার পরিশ্রমের পারিতোষিক দিয়ে কেনা জায়গার দখল হারিয়ে তা ফিরে পেতে আবার সেই পরিশ্রমের পারিতোষিক মামলার পেছনে ব্যয় করে করে পেটের ভাত জোটাতে পারছেন না। কথায় বলে ‘কম ঠেলায় বিলাই গাছো উঠে না’। জীবনের চাপ (ঠেলা) তাকে ইজিবাইকের ড্রাইভারের আসনে তোলে দিয়েছে। পরিশেষে সমাজের কাছে প্রশ্ন রাখছি, এই যাত্রী রানির যাপিত জীবনকে নরক করে দেওয়ার অপরাধের কি কোনও প্রতিকার হতে পারে না?
লেখক: কবি, প্রবীণ সাংবাদিক, কলামনিস্ট ও গবেষক।