হাওর ডেস্ক ::
সড়কে নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে গত বছর রাজধানীতে রাস্তায় নেমেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবরার আহমেদ চৌধুরী। তুমুল বিক্ষোভের মুখে সরকারের কাছ থেকে এসেছিল দাবি মানার প্রতিশ্রুতি। এর পরও সড়ক দুর্ঘটনায় একের পর এক প্রাণ ঝরছে। গতকাল মঙ্গলবার বাবার সামনেই বাসচাপায় প্রাণ হারিয়েছেন আবরার। রাস্তায় নেমে তাঁর বিক্ষুব্ধ সহপাঠীরা প্রশ্ন তুলেছে—এরপর কে, আর কত প্রাণ ঝরবে?গতকাল সকাল ৭টা ২০ মিনিটে রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় প্রবেশের গেটের সামনে প্রগতি সরণিতে সুভাত পরিবহনের বাসের (ঢাকা মেট্রো ব-১১-৪১৩৫) চাকায় পিষ্ট হয়ে নিহত হন আবরার আহমেদ (২০)। তিনি ছিলেন বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিইউপি) আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র।
আবরারের মৃত্যুর পর বিইউপিসহ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা দায়ী বাসচালকের সর্বোচ্চ শাস্তি, নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করাসহ আটটি দাবি জানিয়ে দিনভর প্রগতি সরণি অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছে তারা। দাবি মানা না হলে আজ বুধবারও সড়ক অবরোধের ঘোষণা দিয়েছে তারা। সারা দেশে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের ক্লাস বর্জন আন্দোলনে একাত্ম হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে তারা।
অভিযুক্ত সুপ্রভাত পরিবহনের বাসের চালক সিরাজুল ইসলামকে (২৫) আটক করেছে পুলিশ।
প্রসঙ্গত, গত বছরের ২৯ জুলাই বিমানবন্দর সড়কে দুই কলেজ শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার ঘটনায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পর পঞ্চম দফায় ‘ট্রাফিক শৃঙ্খলা সপ্তাহ’ চলছে এখন। এরই মধ্যে জেব্রাক্রসিংয়ে তাঁর মৃত্যু হলো।
যেভাবে বাবার সামনে মৃত্যু : প্রতিদিনই বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে করে ক্যাম্পাসে যেতেন বিইউপির শিক্ষার্থী আবরার। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার বাসা থেকে বের হয়ে বসুন্ধরা গেটের সামনে প্রগতি সরণিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে উঠতেন তিনি। গতকালও একইভাবে যাচ্ছিলেন। তাঁর বাবা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আরিফ আহমেদ চৌধুরীও নিজের কাজে ছেলের সঙ্গেই বের হয়েছিলেন। বাসস্টপেজের কাছেই বাবার কাছ থেকে বিদায় নেন আবরার। বাবা দাঁড়িয়ে ছেলের চলে যাওয়া দেখছিলেন। জেব্রাক্রসিং ধরে নিয়ম মেনেই রাস্তা পার হচ্ছিলেন আবরার। রাস্তার একটি লেন পার হয়ে পা রাখেন অন্য লেনে। তখন দ্রুতগতিতে আসা সুপ্রভাত পরিবহনের একটি বাস সামনে দাঁড়িয়ে থাকা আরেকটি বাসকে অতিক্রম করে যাচ্ছিল। বেপরোয়া বাসটি আবরারকে সজোরে ধাক্কা দেয়। ‘ও মা’ বলে চিৎকার করে ছিটকে পড়েন তিনি। কিন্তু বাসচালক গতি না কমিয়ে চাপা দেয় আবরারকে। মুহূর্তেই নিথর হয়ে যান সম্ভাবনাময় এই তরুণ।
প্রত্যক্ষদর্শী, সহপাঠী ও স্বজনরা জানায়, পথচারী ও সহপাঠীদের সঙ্গে আবরারের বাবা রাস্তা থেকে সন্তানের নিথর দেহ তুলে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) নিয়ে যান। এর আগেই না ফেরার দেশে চলে যান আবরার।
বিশ্ববিদ্যালয়ের নথিপত্রে আবরারের বাসার ঠিকানা মালিবাগের নিউ সার্কুলার রোডের ২৫২ নম্বর বাড়ি। তবে সহপাঠীরা জানিয়েছে, ওই বাড়িটি তাঁদের আদি নিবাস। তবে বসুন্ধরার বি-ব্লকে বাবা, মা ও ছোট ভাইয়ের সঙ্গে থাকতেন আবরার।
সহপাঠী টুইংকেল কালের কণ্ঠকে বলেন, খিলগাঁও-বাড্ডা রুটে তাঁদের বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি বাস যায়, ৫ ও ৬ নম্বর। সহপাঠী ওরিসা ও সানিনের সঙ্গে আবরার ৫ নম্বর বাসেই যান। ওই বাসটি তখন এসেছিল। ৬ নম্বর বাসও পরে আসে। অনেক সহপাঠী আবরারকে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখেছে।
বিইউপি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র মাহির তাজওয়ার বলেন, ‘আমি ৬ নম্বর বাসে ছিলাম। ঘটনার পাঁচ মিনিট আগে আবরারকে তার সহপাঠী নিশিথ কল দিয়ে বাস এসে গেছে বলে জানায়। এরপর দেখি সে রাস্তায় লাশ হয়ে আছে। তখন আংকেলকে (আবরারের বাবা) এখানে দেখি।’
প্রত্যক্ষদর্শী শান্ত-মারিয়াম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র গোলাম কিবরিয়া এবং ফুটপাতের দোকানদার রুবেল জানান, আবরার যখন রাস্তা পার হচ্ছিলেন তখন বাসস্ট্যান্ডে দুটি বাস দাঁড়িয়ে ছিল। এর একটি বাসকে দ্রুতগতিতে অতিক্রম করে সুপ্রভাত পরিবহনের বাসটি। তখন আবরার সামনে পড়ে যান। বাসচাপায় আবরারের মাথা থেঁতলে যায়। লোকজন বাস আটকালে পাশে থাকা পুলিশ চালককে আটক করে। তবে তাঁর সহকারী পালিয়ে যায়।
বিইউপির অতিরিক্ত পরিচালক (জনসংযোগ) মো. জাহাঙ্গীর কবির কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসছিল আবরার। ঘটনার সময় তার বাবা পেছনে ছিলেন।’
আবরারের শ্রেণিশিক্ষক সায়লা সোলায়মান এক পথচারীর বরাত দিয়ে বলেন, ‘সাড়ে ৮টায় ওর ক্লাস ছিল। ও যমুনা ফিউচার পার্কের উল্টোদিকের বাস স্টপেজ থেকে আমাদের বাসে উঠতে যাচ্ছিল।’
সহপাঠীদের অবরোধ : আবরারের মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর সকাল পৌনে ৮টা থেকেই প্রগতি সরণিতে বিইউপি শিক্ষার্থীরা জড়ো হতে থাকে। একপর্যায়ে তারা রাস্তা বন্ধ করে দেয়। তারা সড়কে অবস্থান করে স্লোগান দিতে থাকে। তারা বাসে ভাঙচুর চালায়নি বা আগুন দেয়নি। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে উপস্থিতি।
শিক্ষার্থীরা ঘটনাস্থলে আবরারের রক্তের দাগকে ঘিরে দিনভর ‘জেব্রা ক্রসিংয়ে ভাই মরে প্রশাসন কি করে’, ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিজ’সহ নানা স্লোগানে সড়ক অবরোধ করে রাখে। ‘কয়লার রাস্তা, না রক্তের রাস্তা’, ‘নিজের সিরিয়ালের অপেক্ষা করুন’, ‘আর কত প্রাণ নিবি’—এমন নানা প্ল্যাকার্ড নিয়ে প্রতিবাদ করে শিক্ষার্থীরা। জেব্রাক্রসিংয়ে আবরারের রক্তের দাগের দুই পাশে দুজন শুয়ে পড়ে। বিইউপির শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নর্থ সাউথ, ইনডিপেনডেন্ট, এআইইউবিসহ কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও সড়কে নেমে আসে। এতে কুড়িল থেকে কোকা-কোলা মোড় পর্যন্ত প্রগতি সরণির রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। পুলিশ দুই দিক থেকে বাসসহ সব যানবাহন ঘুরিয়ে দেয়।
সকাল ১১টার দিকে পরিস্থিতি সামাল দিতে ঢাকা উত্তরের মেয়র আতিকুল ইসলাম ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন। তখন বিইউপির অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী তাত্ক্ষণিক লিখিতভাবে ১২ দফা দাবি পেশ করে। তিনি শিক্ষার্থীদের শান্ত করার চেষ্টা করেন এবং আগামী তিন মাসের মধ্যে ঘটনাস্থলে একটি ফুট ওভারব্রিজ নির্মাণের আশ্বাস দেন। কিন্তু শিক্ষার্থীরা সেই আশ্বাস উপেক্ষা করে সড়কে অবস্থান করে বিক্ষোভ চালিয়ে যায়।
শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির মধ্যে দুপুরে কয়েকজন বহিরাগত কয়েকটি বাসে ভাঙচুর চালায় এবং একাটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। খবর পেয়ে শিক্ষার্থীরা ওই আগুন নেভায়। শিক্ষার্থীরা বলে, সুপ্রভাত পরিবহনেরই শ্রমিক এসে বাসে আগুন দিয়েছে। তারা ওই শ্রমিককে আটক করলেও পুলিশ ছেড়ে দিয়েছে।
বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) নবনির্বাচিত ভিপি নুরুল হক নুর ঘটনাস্থলে এসে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেন।
বিকেল ৫টা ৪০ মিনিটের দিকে পুলিশ, ওই এলাকার কাউন্সিলর ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অনুরোধে আন্দোলন স্থগিত করে রাস্তা থেকে চলে যায় শিক্ষার্থীরা। এ সময় বিইউপি শিক্ষার্থীদের পক্ষে মাঈশা নূর জানান, দাবি আদায় না হলে আজ বুধবার সকাল ৮টায় তাঁরা ফের রাস্তায় নামছেন। এ সময় তিনি সারা দেশের শিক্ষার্থীদের তাঁদের আন্দোলনের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার আহ্বান জানান।
শিক্ষার্থীদের আট দফা : প্রথমে ১২ দফা দাবি উত্থাপন করলেও পরবর্তী সময়ে আট দফা দাবি জানায় শিক্ষার্থীরা। তাদের দাবিগুলো হলো ১. পরিবহন সেক্টরকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে হবে এবং প্রতি মাসে বাসচালকের লাইসেন্সসহ সব প্রয়োজনীয় কাগজপত্র চেক করতে হবে। ২. আটক চালক ও সম্পৃক্ত সবাইকে দ্রুত সময়ের মধ্যে সর্বোচ্চ শাস্তির আওতায় আনতে হবে। ৩. আজ থেকে ফিটনেসবিহীন বাস ও লাইসেন্সবিহীন চালককে দ্রুত সময়ে অপসারণ করতে হবে। ৪. ঝুঁকিপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় সব স্থানে আন্ডারপাস, স্পিড ব্রেকার এবং ফুট ওভারব্রিজ নির্মাণ করতে হবে। ৫. চলমান আইনের পরিবর্তন করে সড়ক হত্যার সঙ্গে জড়িত সবাইকে সর্বোচ্চ শাস্তির আওতায় আনতে হবে। ৬. দায়িত্ব অবহেলাকারী প্রশাসন ও ট্রাফিক পুলিশকে স্থায়ী অপসারণ করে প্রয়োজনীয় আইনিব্যবস্থা নিতে হবে। ৭. প্রতিযোগিতামূলক গাড়ি চলাচল বন্ধ করে নির্দিষ্ট স্থানে বাসস্টপ এবং যাত্রীছাউনী করার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। ৮. ছাত্রদের হাফ পাস (অর্ধেক ভাড়া) অথবা আলাদা বাস সার্ভিস চালু করতে হবে।
আশ্বাসে সন্তুষ্ট নয় শিক্ষার্থীরা : সারা দিন দফায় দফায় সমঝোতার চেষ্টা করে পুলিশ। শেষে বিকেল ৫টার দিকে ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (ট্রাফিক উত্তর) মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ, যুগ্ম কমিশনার (ক্রাইম) শেখ নাজমুল আলম এবং স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর জাকির হোসেন বাবুল শিক্ষার্থীদের বুঝিয়ে রাস্তা থেকে সরে যেতে বলেন। দ্রুত দাবি মানা হবে বলে জানান তিনি।
তবে শিক্ষার্থীরা এমন আশ্বাসে সন্তুষ্ট হতে পারছে না। শাতিল হাসান নামের এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমাদের বারবার আশ্বস্ত করা হয়। আমরা আর মানছি না। আমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।’
এদিকে আবরারের মৃত্যুর ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) আন্দোলনের চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন। গতকাল এক বিবৃতিতে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে সংশ্লিষ্টদের ব্যর্থতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি।
প্রিয় ক্যাম্পাস থেকে শেষ বিদায় : ‘মাত্র তিন মাসে বিশ্ববিদ্যালয়ে সবার মন জয় করে ফেলেছিল আবরার। সে অনেক ভালো ছাত্র হওয়ায় আমরা তাকে সিজিপি-৪ বলে ডাকতাম। কারণ আমরা জানতাম, সে বেস্ট রেজাল্ট করবে।’ আবরারের জন্য হাহাকার করে বলছিলেন তাঁর সহপাঠী রাকিব হাসান। সহপাঠীরা জানায়, বসুন্ধরার প্রে-পেন ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল থেকে আবরার ‘এ’ এবং ‘ও’ লেভেল পাস করে। দুটি পরীক্ষায় সে সর্বোচ্চ ফল অর্জন করে।
বিকেল ৪টার দিকে বনানীর সামরিক কবরস্থানে আবরারের দাফন সম্পন্ন হয়। এর আগে দুপুর দেড়টার দিকে মিরপুর সেনানিবাসের মধ্যে বিইউপি এডিবি গ্রেড গ্রাউন্ড মাঠে তাঁর প্রথম জানাজা হয়।
ছেলের দাফনের সময় বিলাপ করে মূর্ছা যাচ্ছিলেন আবরারের মা ফরিদা ফাতেমী। বলছিলেন, ‘কখনো একা ছাড়তে চাইতাম না। ও বলত, আম্মু তুমি যদি আমাকে একা চলাফেরা করতে না দাও, তবে আমি ইনডিপেনডেন্ট হব কিভাবে? আমাদের একা ফেলে চলে গেলি কিভাবে? আমি কিভাবে তোকে ছাড়া থাকব…?’
আবরারের চাচা মাসুদ আহমেদ চৌধুরী বলেন, আবরার কমিশনার র্যাংকে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীতে নিয়োগ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিল। তার ইচ্ছা ছিল সেনাবাহিনীর ডাক্তার হওয়া।