“আমাদের গেছে যে দিন একেবারেই কি গেছে–কিছুই কি নেই বাকি।” আছে। সেই আগের মতনই কিছু কিছু রয়ে গেছে।বয়স,জরা,ব্যাধি,মৃত্যু,সংসার-বন্ধন,যাতনা,বেদনা কোন কিছুর কাছেই হার মানেনি,আমাদের আড্ডা বিলাস। আড্ডা প্রবন মানুষেরাই নাকি সুনামগঞ্জের প্রাণ।স্থান কাল পাত্রের হয়তো পরিবর্তন ঘটেছে।বদলেছে ধরন।
রেষ্টুরেন্টের আড্ডা-সেতো সার্বজনীন।দেশবন্ধুতে বারোয়ারী আড্ডা।এক কালের বুধোর স্টল ছাত্রদের দখলে।২০ ফেব্রুয়ারী সারারাত খোলা। প্রভাতফেরীর প্রস্ততি আর ফুল সংগ্রহের গোপন পরিকল্পনা নেয়া হতো এখান থেকেই। আধপুড়া পরটার গন্ধে ম ম রাতের পুরান কলেজ পয়েন্ট। অনিদ্রার ক্ষুধাপেটে কড়া ভাজা রুটি আর ডাবল চিনির চা কি মোক্ষম রসদই না ছিলো।সুনামগঞ্জ ডেইরী বুড়োদের। সকালসন্ধ্যা গড়গড়ার নলে মুখ ভর্তি ধূয়া টেনে রাজনীতি সমাজনীতির কতনা গুঢ় তত্বে মশগুল থাকতেন শহরের প্রবীন নাগরিকেরা।এমন পবিত্র দৃশ্য এখনও চোখে ভাসে।
লন্ড্রির আড্ডা সুনামগঞ্জের ব্যাতিক্রমী বৈশিষ্ট।আর কোন শহরেই নাকি লন্ড্রীতে এমন নিয়মিত আড্ডা নেই।স্বপ্না লন্ড্রী,মায়া লন্ডী,অঞ্জলি লন্ড্রী সরগরম আড্ডাবাজদের নিত্য জমায়েতে।ফার্মেসীর ভারভারিক্কি আড্ডাও ছিলো জমজমাট।মেডিকেল হলের বারান্দা,আলেয়া ফার্মেসীর হেলান বেঞ্চ,ন্যশনাল ফার্মেসীর একচিলতে বারান্দায় মুখোমুখি জুড়া চেয়ারে ঠাসাঠাসি করে বসতেন সিনিয়র রাজনৈতিক নেতারা। রাতে বিবিসির বাংলা সংবাদ শেষে যে যার পথ ধরতেন। রাধারমন বাবুর দোকানের সামনে খোলা জায়গায় চেয়ার পেতে বসতেন গন্যমান্যরা।
স্কুল পাট চুকিয়ে বাড়ির চৌহদ্দী আর পাড়ার সীমানা পেড়িয়ে আমাদের আড্ডার প্রথম ভূবন ইসলামিয়া লাইব্রেরীর কাঠের পাটাতনের বারন্দা।মালিক কাম সেলস্ ম্যান অমায়িক সহিষ্ণু ইউনুছ ভাই বয়স নির্বিশেষে ছাত্র আর সকল ছাত্রসংগঠনের কাছেই গ্রহনযোগ্য।কলেজে বা রাস্তায় দলবাজি, ঝগড়া বিবাদ এমনকি মারামারির ঘটনা ঘটিয়ে লাইব্রেরীর বারান্দায় এসে একে অন্যের চায়ের কাপে ভাগ বসাতো।সন্ধ্যার পর বসতো সাংবাদিক দের আড্ডা।সিনিয়রদের বসার জায়গা দিতে বেচারা মালিককেও স্হানচ্যূত হয়ে কাজ সারতে হতো।সাংবাদিক সমিতি এবং প্রেসক্লাবের কার্যালয়ও এই ঘরটিতে।একটি স্টিলের ট্রাংক সমিতির পৃথক অস্থিত্ব নিয়ে এক কোনে পড়ে থাকতো।চর্মশিল্পী সমিতির সভার স্থানও লাইব্রেরীর বারান্দা।আর পৃষ্ঠপোষক ইউনুছ ভাই।
আজ অনেক প্রতিষ্টানই নেই। আড্ডার মধ্যমণিরাও অতীত।আমরা ক’জনা আছি অতীত বর্তমানের যুগসূত্র হয়ে। সুযোগ পেলেই আড্ডায় বসি দাসব্রাদার্স,সূচনা পেপার হাউসে।রসঘন আড্ডায় তুমুল হাসির টনিক নেই।জিলিপি খেতে খেতে কাগ্ জের ঘরের ছ,সাত জনের নিরীহ আড্ডা থেকেইতো জুবিলী বিদ্যালয়ের ১২৫ বছর পূর্তির ঐতিহাসিক উৎসবের সূচনা। এখনও বন্ধুর বাড়িতে নেমতন্ন এড়াই না কেউই।বন্ধুপত্নীর রান্নার প্রসংশা আর গৃহকর্তার আপ্যায়নের তারিফ করতে করতে দ্বিতীয় নিমন্ত্রন নিশ্চিন্ত করি।মধুমেহ গ্রস্থদের মিষ্টি খাওয়ার ব্যাপারে গোপনীয়তা রক্ষা করি।বিয়েতে যাই।রোগশয্যায় যাই।বিস্মৃত প্রায় বন্ধুর সাথে হঠাৎ সাক্ষাতে পুলকিত হই। দুপুরে বৌভাতের খাবার খেয়ে দুই ঘন্টার রাস্তায় দুইবার গাড়ি থামিয়ে একবার কফি আরেকবার ঠান্ডা পানে আমাদের অনীহা জাগেনি।
আজকালকার প্রজন্মের মনোজগতে কি পরিবর্তন ঘটিয়ে দিচ্ছে হাইটেক প্রযুক্তি। ইন্টারনেট ফেসবুকে নিমগ্ন হয়ে কি বড় অন্তর্মুখি হয়ে পড়ছে ওরা।প্রসারিত মনের উদার আড্ডা কি সংকুচিত হয়ে পড়েছে।আড্ডার প্রাণরস হতে বঞ্চিত হয়ে ওরা কি রুক্ষশুষ্ক হয়ে পড়বে।
মানুষের সাথে মানুষের সংস্পর্শের বড় বেশী প্রয়োজন।প্রযুক্তি যেন সে বন্ধন ছিন্ন না করে।সমাজটা যেনো যান্ত্রিক না হয়ে পড়ে।সময় নষ্ট করার কিছু সময় যেনো থাকে।