বিশেষ প্রতিনিধি::
জ্বিনের নামে সাড়ে তিন কোটি টাকার শিরনি দিলে বিনিময়ে জ্বিন ১৫ শ কোটি টাকা মিলবে-এই সরল অপবিশ্বাসে স্বজাতীয় প্রতারক চক্রের কাছে প্রতারিত হয়েছেন জগন্নাথপুরের এক ব্যবসায়ী। ১৫ শ কোটি টাকার লোভে সাড়ে তিন কোটি টাকা দিয়ে প্রতারিত ব্যবসায়ী এখন আইনের আশ্রয় নিয়েছেন। টাকার বদলে প্রতারক চক্র তাকে পুরনো কাগজ, কাপড় ভর্তি ৫টি বড় ড্রাম ও ২ টি বড় ট্রাংক দিয়ে চম্পট দিয়েছে। প্রতারণার বিষয়টি বুঝতে পেরে ক্ষতিগ্রস্থ ব্যবসায়ী কথিত জ্বিন চক্র ও জ্বীনের বাদশার বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের পর জ্বিনের বাদশাকে সপরিবারে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। প্রতারক চক্র সাড়ে ৩ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনা পুলিশের কাছে ও আদালতের কাছে স্বীকার করেছে।
পুলিশ জানায়, নেত্রকোণা জেলার কেন্দুয়া থানার পুটবটতল গ্রামের প্রতারক মাওলানা হাফিজ কামরুল ইসলাম নিজেকে নানা কৌশলে জ্বিনের বাদশা পরিচয় দিতো। তাকে এ কাজে সহযোগিতা করতো তার পিতা আব্দুল কাদির ও মা রানু বেগমসহ স্থানীয় একটি চক্র। তারা নানাস্থানে জ্বিনের বাদশা দিয়ে প্রতারণা করেছে। কামরুল দীর্ঘদিন ধরে সপরিবারে জগন্নাথপুর উপজেলার সৈয়দপুর-শাহারপাড়া ইউনিয়নের ঈশাণকোণা গ্রামে যুক্তরাজ্য প্রবাসী রহমত আলীর বাড়িতে থাকতো। এখানে থেকে সে কবিরাজিসহ নানাভাবে সাধারণ মানুষদের প্রতারণা করতো। ধর্মীয়ভাবে মোহাচ্ছন্ন করে অনেক পরিবারকেই সর্বস্বান্ত করেছে এই কথিত জ্বিন চক্র। পরিবারের সবাই এই প্রতারণায় তাকে সহযোগিতার পাশাপাশি স্থানীয় কিছু দুষ্কৃতিকারীও তাকে সহযোগিতা করতো বলে পুলিশ জানিয়েছে।
জানা গেছে, জগন্নাথপুর উপজেলার পাটলি ইউনিয়নের মকরমপুর গ্রামের বাসিন্দা মাস্টার মৃত আবদুল খালিকের ছেলে জগন্নাথপুর বাজারের ব্যবসায়ী মাওলানা ইমরান আহমদ জিনের বাদশার মাধ্যমে ১৫ শ কোটি টাকা পাওয়ার লোভে সাড়ে ৩ কোটি টাকা খুইয়ে এখন দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন।
মামলা সূত্রে জানা যায়, ২০১৮ সালে জগন্নাথপুর উপজেলার সৈয়দপুর গোয়ালগাঁও গ্রামের হাফিজ মাওলানা এনামুল হাসানের মাধ্যমে জিনের কথিত বাদশা হাফিজ মাওলানা কামরুল ইসলাম চক্রের সাথে পরিচয় হয় জগন্নাথপুরের মাওলানা ইমরান আহমদের। ওই চক্র তাকে বিরাট অংকের টাকার লোভ দেখায়। এই প্রলোভনে পড়ে ১৫ শ কোটি টাকার লোভের আশায় মাওলানা ইমরান আহমদ প্রতারচক্রের হোতা হাফিজ মাওলানা কামরুল ইসলামকে কয়েক দফায় সাড়ে ৩ কোটি টাকা দেন। বিনিময়ে কিভাবে জ্বিনের বাদশা তাকে ১৫ শ কোটি টাকা দিবে তাও বাতলে দেয়া হয়। প্রতারক কামরুল সাড়ে তিন কোটি টাকা পেয়ে ৫টি তেলের ড্রামে ও ২টি বড় ট্রাংক কিনে। এগুলোর ভেতরে পুরনো কাগজ, কাপড়, বস্তা ভরে সেগুলো তালাবদ্ধ করে পালিয়ে যায়। নির্দেশনা মতে প্রতারিত মাওলানা ইমরান আহমদ ড্রাম-ট্রাক ভেঙ্গে দেখেন সেগুলোতে টাকার বদলে পুরনো কাগজ, পুরনো কাপড় ও বস্তা ভর্তি। তখন তার বোধোদয় হয় তিনি প্রতারিত হয়েছেন। সাথে সাথে সচেতন কিছু মানুষের সহায়তা চাইলে তারা তাকে আইনের আশ্রয় নেওয়ার পরামর্শ দেন। গত ২৩ এপ্রিল প্রতারিত ব্যবসায়ী মাওলানা ইমরান আহমদ প্রতারক চক্রের হোতা কথিত জ্বিনের বাদশা হাফিজ মাওলানা কামরুল ইসলামসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে সাড়ে তিন কোটি টাকা প্রতারণার মাধ্যমে হাতিয়ে নেওয়ার মামলা করেন। মামলার পর বিষয়টি তদন্ত করে সত্যতা পাওয়ায় জগন্নাথপুর পুলিশ অভিযানে নামে। জগন্নাথপুর থানার ওসি হারুনুর রশিদ চৌধুরীর নির্দেশে এসআই হাবিবুর রহমান পিপিএম একদল পুরিশ নিয়ে নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া থানার পুট বটতল গ্রাম প্রতারকের বাড়িতে অভিযানে নামেন। বৃহষ্পতিবার রাতে অভিযান চালিয়ে জিনের বাদশা হাফিজ কামরুল ইসলাম ও তার মা-বাবাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরে প্রতারণার শিকার মামলার বাদী মাওলানা ইমরান আহমদের বাড়ি থেকেও প্রতারক চক্রের ড্রাম ও ট্রাকগুলো উদ্ধার করা হয়। গ্রেপ্তারকৃতদের কাছ থেকে থেকে উদ্ধার করা হয়েছে এসব তেলের ড্রাম ও টাংকের তালার চাবি।
গ্রেপ্তারের পর প্রতারক চক্র পুলিশকে প্রতারণা ও সাড়ে ৩ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছে। প্রতারিত ব্যবসায়ীর কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিয়ে স্থানীয় একটি চক্রও সহায়তা করেছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
এদিকে প্রতারক চক্রকে গতকাল শুক্রবার সুনামগঞ্জ আদালতে প্রেরণ করা হয়েছে। আদালতেও প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে প্রতারণার বিষয়টি স্বীকার করেছে বলে পুলিশ জানিয়েছে।
প্রতারিত মাওলানা ইমরান আহমদ বলেন, আমাদের স্বজাতি মাওলানা হাফিজ কামরুল ইসলামের কথায় আমি লোভে পড়ে সাড়ে তিন কোটি টাকা প্রদান করি। আদতে নানা কৌশলে কামরুলই ছিল জ্বিনের বাদশা। আমাকে নিঃস্ব করে সাড়ে তিন কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পর আমার বোধোদয় হয়। পরে আমি মামলা দায়ের করলে পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করে।
জগন্নাথপুর থানার ওসি মোহাম্মদ হারুনুর রশীদ চৌধুরী বলেন, জ্বিনের বাদশা পরিচয় দিয়ে এই প্রতারক চক্র আরো প্রতারণা করেছে। সর্বশেষ সাড়ে তিন কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। টাকা হাতিয়ে নেওয়ার প্রমাণ মিলেছে এবং প্রতারক চক্র পুলিশ ও আদালতের কাছেও স্বিকারও করেছে। তিনি বলেন, এই প্রতারণায় একটি গ্যাং জড়িত। তাদেরকেও আইনের আওতায় আনতে কাজ চলছে।