দিগন্ত বিস্তৃত নীলজল আর মেঘালয়ের মেঘময় সবুজ পাহাড় দেখে আপ্লুত হন দেশ বিদেশের পর্যটকরা। নভোনীলনোয়া এমন প্রকৃতিসুন্দর স্থানে এসে শিল্পী ভাবালুতায় পেয়ে বসে বেড়াতে আসা প্রকৃতিপ্রেমীদের। তাই কেউ গাইতে থাকেন ‘আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ওই, কেউবা হাওরের স্বচ্ছতোয়া নীলঢেউ জলে ভেসে উজালা রাতে বসে কণ্ঠে তুলে নেন ‘এই মোম জোছনায় অঙ্গ ভিজে যায় এসোনা গল্প করি’ অথবা আরো আরো কেউ হিজল করচের ডুবুডুবু বাগের গহীনে হারিয়ে গাইছেন রবি ঠাকুরের ‘এই জোছনা রাতে সবাই গেছে বনে…’ বা নজররুলের ‘হিজল বিছানো বনোপথ দিয়া’সহ প্রকৃতিবন্ধনার নানা গান।
কারো কণ্ঠে বিরহের গান-কবিতা কারোবা কণ্ঠে মিলনের সুর। সময়ের যাতাকলে আটকে থাকা নাগরিক মন একটু ফুরসত পেলেই প্রকৃতির টানে দিচ্ছে একফশলা ছুট…। দেহ মনে লেপ্টে থাকা নাগরিক ধুলো শান্ত নীলজলে অবগাহন করে ধুয়ে মুছে দারুণ প্রশান্তি খুজছে আধুনিক ব্যস্ত মানুষ! সম্প্রতি সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওরের দিকে ছুটে আসা পর্যটকদের মিছিল এসব বার্তাই দিচ্ছে দেশের প্রান্তিক জেলা সুনামগঞ্জবাসীকে। বিশেষ করে ঈদ ও পূজাপার্বনসহ বিভিন্ন ছুটির দিনগুলোতে সপ্তসুন্দরভূমি জমে ওঠে সৌন্দর্য্য পিয়াসীদের উপস্থিতিতে। টাঙ্গুয়ার হাওরসহ এই হাওরঘেষা সাতটি প্রকৃতিসুন্দর স্থান রয়েছে। প্রতিটিরই রয়েছে আলাদা সৌন্দর্য্যরে বৈশিষ্ট। সেগুলো নিয়েই হাওর টুয়েন্টিফোরের বিশেষ পর্যটন আয়োজন।
টাঙ্গুয়ার জীববৈচিত্র:
১৯৯৯ সালে হাওরটির আয়তন ৯ হাজার ৭২৭ হেক্টর ছিল। ২০১৬ সালের সর্বশেষ জরিপে হাওরটির আয়তন দাড়িয়েছে প্রায় ১৫ হাজার হেক্টর। আগে হাওরের সীমানা চিহ্নিত না হলেও গত বছর ১৪৪টি সীমানা পিলার বসিয়ে সীমানা নির্ধারণ করা হয়েছে। শৃঙ্খলার ভেতরে নিয়ে আসা হয়েছে নয়কুড়ি কান্দা ছয়কুড়ি বিল খ্যাত অনন্য জলাশয় গুলোকে।
টাঙ্গুয়ার হাওরের জীববৈচিত্রের রেডডাটা বুক জরিপে দেখা গেছে হাওরে বর্তমানে ১৩৪ প্রজাতির মাছ, ১৯ প্রজাতির স্তন্যপ্রাণী, ২১৯ প্রজাতির দেশি ও পরিযায়ী পাখি, ২৪ প্রজাতির সরিসৃপ, ৮ প্রজাতির উভচর প্রাণী এবং ১০৪ প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে। ১০৯টি জলাশয় কাগজে কলমে থাকলেও ৫২টি জলাশয়ের অস্তিত্বের কথা স্বীকার করেছেন সংশ্লিষ্টরা। রয়েছে একটি ওয়াচ টাওয়ার। কয়েকটি পাখির অভয়াশ্রম। হাজী জয়নাল আবেদিনের লাগানো দেশের সর্ববৃহৎ হিজল করচের বাগান। বর্ষা হেমন্তে হিজল করচের এই জলাবনের সৌন্দর্য্যে মোহিত হন দর্শনার্থীরা। সারি সারি বাগে হারিয়ে যান তারা।
বেসামরিক বিমান বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয় ২০১৩ সনের ৯ জুলাই প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে টাঙ্গুয়ার হাওর কেন্দ্রিক টেকেরঘাট ও বড়গোপটিলা, যাদুকাটাকে কেন্দ্র করে পর্যটনের জন্য সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণা করেছিল। ওই সময় করপোরেশন টাঙ্গুয়ার হাওর, যাদুকাটা, বড়গোপটিলা ও টেকেরঘাট খনিজ প্রকল্প মিলিয়ে প্রায় ৫০ একর জায়গায় পর্যটন অবকাঠামো নির্মাণের জন্য গেজেট প্রকাশ করে। ২০১৫ সালের ২৫ মে সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসনও বাংলাদেশ পর্যটন করপোশের চেয়ারম্যান বরাবরে এ বিষয়ে একটি পত্রও প্রেরণ করে। ওই পত্রে প্রস্তাবিত ও পর্যটন এলাকা ঘোষিত পর্যটন সম্ভাব্যতা, পর্যটন সুবিধা সৃষ্টির বর্ণনা, প্রকল্পের আর্থিক ব্যবস্থাপনা, জমির বিবরণসহ নানা বিষয় উল্লেখ করে অবকাঠামো নির্মাণের আহ্বান জানানো হয়। এতে প্রস্তাবিত এলাকার ভৌগলিক ও সৌন্দর্যের বর্ণনা, পর্যটক ও জীববৈচিত্র বিষয়ক তথ্য উল্লেখ করে পর্যটন অবকাঠামো নির্মাণের অনুরোধও ছিল। জেলা প্রশাসন টাঙ্গুয়ার হাওরের আশপাশে, টেকেরঘাট এবং বড়গোপটিলায় হোটেল ও রিসোর্ট নির্মাণ, টাঙ্গুয়ার হাওরের জয়পুর গোলাবাড়ি এলাকায় অবকাঠামো উন্নয়ন এবং নৌকা-ট্রলার, স্পিডবোট’র ব্যবস্থা করা, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা, ব্রডব্যা- ইন্টারনেট চালুর উদ্যোগগ্রহণ, নিরাপত্তা, পয়োনিস্কাশন ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য উদ্যোগ গ্রহণের নানা সুপারিশ করে। কিন্তু এখনো পর্যটন উপযোগী কিছু গড়ে ওঠেনি। বিড়ম্বনা নিয়েই মানুষজন আসা যাওয়া করেন।
লাকমাছড়া
এ যেন আরেক বিছনাকান্দি, লোকে এরে ভূস্বর্গও ডাকেন। পাহাড় বেয়ে একটি শুকনো ছড়া বা খাল বাংলাদেশে এসে নেমেছে। বর্ষায় পানি পেয়ে প্রাণ পায় ঝর্ণাটি। উচু পাহাড় থেকে ঝর্ণার মতো নেচে ভাটিতে গান গেয়ে নেমে আসে। টেকেরঘাটের পশ্চিমে ২-৩ কি. দূরেই এর অবস্থান। ভারতীয় অংশে রয়েছে একটি আকর্ষনীয় ঝুলন্ত সেতু। বাংলাদেশ থেকে যাকে পাহাড়ি সেতু ডাকেন ঘুরতে আসা লোকজন। ছড়ার নিচু অংশে বড় বড় কিছু পাথরও রয়েছে। এর খন্ডগুলোও দেখতে নান্দনিক। নীলসবুজ ঘেরা লাকমাছড়াটিও এখন পর্যটকদের টানছে। এর আশপাশের সৌন্দর্য্য ও কয়লা কুড়ানো মানুষগুলোও দেখার মতো। পাহাড়ি সর্পিল বুনোপথ দিয়ে ভারতীয় অংশে গাড়ি চলাচলও করার দৃশ্যেও মোহিত হন। এখানেও জিরোনোর কোন সুযোগ নেই। সৌন্দর্য গিলেই ফিরে আসতে হয়।
টেকেরঘাট খনিজ প্রকল্প ও সিরাজ লেক
একদম মেঘালয় পাহাড় ঘেষে অবস্থান টেকেরঘাট খনিজ প্রকল্পটি। ১৯৭১ সনে এটি মুক্তিযুদ্ধের টেকেরঘাট সাবসেক্টর কার্যালয় ছিল। বিরাট ক্যাম্পাসে পুরনো যন্ত্রপাতি, রেললাইন, পুরনো বাংলো, যন্ত্রঘর, রিসোর্টসহ নানা স্থাপনা রয়েছে। এক দশক আগে লোকসানী প্রতিষ্ঠান হিসেবে এটি পরিত্যাক্ত করা হলেও এর ভৌগলিক দৃষ্টিনন্দন অবস্থান পর্যটকদের টানে। চুনাপাথর খনির একটি নীলনোয়া স্বচ্ছতোয়া লেক রয়েছে। খনি প্রকল্পের এই লেকের পশ্চিম উত্তরের কোণায় ১৯৭১ সনে সাচনাযুদ্ধে শহিদ সিরাজুল ইসলামকে এখানে সমাহিত করেছিলেন সহযোদ্ধারা। বর্তমানে এই লেকটি শহিদ সিরাজ লেক হিসেবে পরিচিত। পূর্বপশ্চিমমুখি লম্বাটে লেকটিতে শেষ বিকেলে পাহাড়ের স্থির ছায়া খেলা করে অন্যরকম আবহ নিয়ে। দক্ষিণে কৃত্রিম ঘাসের টিলা তৈরি করা হয়েছে। যেখানে বসে পাহাড় ও হাওর দেখে মুগ্ধ হন দর্শনার্থীরা। একটি বিশেষ প্রকল্পের মাধ্যমে বেঞ্চ, ছাউনি ও লেকে কয়েকটি নৌকা প্রকৃতির ব্যবস্থা করে মিনি পার্কের ব্যবস্থা করে দিয়েছে জেলা প্রশাসন। গত দুই বছর ধরে টাঙ্গুয়াঘেঁষা এই স্থানটিতে পর্যটকরা আসছেন দলে দলে। কিন্তু বসার বা রেস্ট নেওয়ার ব্যবস্থা এখনো গড়ে ওঠেনি। চলতি বছর প্রাক্তন জেলা প্রশাসক সাবিরুল ইসলাম বিপ্লব টেকেরঘাট খনিজ প্রকল্পের একটি কক্ষে শহিদ সিরাজের নামে একটি রিসোর্ট করেছেন। যেখানে তিনটি কক্ষ রয়েছে। এখানে জেলা পরিষদের অর্থায়নে একটি দৃষ্টিননন্দন শহিদ মিনার তৈরি হয়েছে। একটি হাসপাতালও প্রতিষ্টিত হয়েছে।
বড়গোপটিলা ও রূপনদী যাদুকাটা
পুরনো কাগজপত্র আর দলিল দস্তাবেজে হালের বারেকেরে টিলাটি বড়গোপটিলা নামে পরিচিত। এক দশক আগ থেকে এটি বারেকের টিলা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। মেঘালয়ের খাসিয়া পাহাড়ঘেঁষা এই টিলার একটি অংশ বাংলাদেশে এবং আরেকটি অংশ ভারতের অধীনে। নিচেই রয়েছে সীমান্ত নদী যাদুকাটা। টিলায় বাংলাদেশ অংশে ৩১২ একর ভূমি রয়েছে। নানা প্রজাতির বৃক্ষশোভিত এই টিলা খাড়া ও ঢালু প্রকৃতির। পূর্বের উচু অংশ থেকে যাদুকাটা নদী ভিন্নরূপে ধরা দেয় পর্যটকদের চোখে। টিলা থেকে অনেকেই সদলবলে পূর্ণিমার গোল চাঁদ দেখেন হল্লা করে। নদীতে শুক্রবার বাদে প্রতিদিন হাজারো শ্রমিক বারকি নৌকায় পাথর ও বালু উত্তোলনসহ কয়লা কুড়ান। সেই দৃশ্যও দেখার মতো। এখানেও পর্যটন উপযোগী ব্যবস্থা নেই। সুনামগঞ্জ শহরে অবস্থান করেই দেখার তৃষ্ণা মেটান পর্যটকরা। প্রতি বছর মধুকৃষেœর তৃতিয়া তিথীতে এখানে বৃহত্তর সিলেটের সবচেয়ে বড় উৎসব বারুণি ¯œান বা বান্নি মেলা বসে। বেশুমার লোকজনরে উপস্থিতি তখন মেলাকে বর্ণাঢ্য করে তোলে।
শাহ আরেফিনের আস্তানা
৩৬০ আউলিয়ার অন্যতম সঙ্গী গরমপীর খ্যাত শাহ আরেফিনের মাজার রয়েছে যাদুকাটা নদীর পূর্ব তীরে। সীমান্ত ঘেষা ছায়া সুনিবীর এই স্থানে প্রতি বছর ওরস বসে। হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে অসাম্প্রদায়িক সাধক খ্যাত শাহ আরেফিনের মাজারে সবধর্মের মানুষ এসেই সাধন ভজন করেন। বারো মাসই ভক্তরা আসেন মানত নিয়ে। ওরসের সময়ে লোকে লোকারণ্য হয়ে ওঠে এলাকাটি। এক সময় ওরস চলাকালে শাহ আরেফিনের কথিত মাজার ভারতের ঘুমাঘাট সীমান্ত শাহ আরেফিন ভক্তদের জন্য খুলে দিতো ভারত। কিন্তু এখন আর সেই সুযোগ নেই। তাই দূর থেকেই হাত শুন্যে তুলে প্রার্থনা করেন আগত ভক্তবৃন্দ।
জয়নাল আবেদিনের শিমুল বাগান
রক্তরাঙা ফাগুনে আগুন লাগে শিমুল বাগানে। বড়গোপটিলার দক্ষিণের মাহরাম টিলা বা মজা মাহরাম নদীর দক্ষিণ ও যাদুকাটার পশ্চিমপাড়ে বিস্তৃত বালুভূমিতে এই শিমুল বাগটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন হাজী জয়নাল আবেদিন। ৩০০০ হাজার শতক জমিতে প্রায় দেড় দশক আগে তিনি তিন হাজারের মতো শিমুল চারা লাগিয়েছিলেন। রক্তরাঙ্গা এই বৃক্ষের প্রতি তার প্রেমের কারণেই বাগানটি প্রতিষ্ঠিত করলেও এর সৌন্দর্য্যে দেশের মানুষের আকৃষ্ট হওয়াটা দেখে যেতে পারেননি। তবে মানুষজন ঘুরতে এসে তার প্রকৃতিপ্রেমের প্রশংসা করেন। এই শিমুল বাগানটিও পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। ফাগুনে দলে দলে মন রাঙ্গিয়ে যায় মানুষ। নিরব পাহাড় আর স্বচ্ছতোয়া জলের মুগ্ধতায় ফাগুন বাগানটি তখন ভিন্নরকম সৌন্দর্য্য নিয়ে ধরা দেয়।
থাকা খাওয়ার বিড়ম্বনা
সরকারি ছুটির দিনগুলোতে টাঙ্গুয়ার হাওর কেন্দ্রিক এই সপ্তসুন্দরের খুঁজে দেশের নানা প্রান্তের মানুষ আসেন। টাঙ্গুয়ার নীল জলে গতর ভিজিয়ে তারা সীমান্ত ঘেষা অন্য ছয়টি স্থাপনাও ছুঁয়ে আসেন। সেখানে পলকে সময় কাটালেও বিশ্রাম বা আহার বিহারের তেমন ব্যবস্থা নেই। যারা ঘুরতে যান তাদেরকে হয়তো তাহিরপুর নয়তো সুনামগঞ্জ জেলা শহরেই অবস্থান করতে হয়। ভোরে ওঠে হেনন্তে বাইকে এবং বর্ষায় নৌকায় ঘুরতে হয়। থাকার ব্যবস্থা না থাকায় বর্ষায় নৌকায়ই রাত পার করেন তারা। গত বছর টাঙ্গুয়ার নাভিখ্যাত গোলাবাড়িতে একটি টিনশেডের রিসোর্ট প্রতিষ্টিত হয়েছে। তাছাড়া তাহিরপুরে জেলা পরিষদের যে ডাক বাংলো রয়েছে সেগুলোও এখন ব্যবহারের অনুপযুক্ত। তবে সম্প্রতি জেলা পরিষদ প্রায় শতকোটি টাকা ব্যয়ে আধুনিক রিসোর্ট নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছে। এ লক্ষ্যে প্রকল্প তৈরি করছে তারা। তাছাড়া বেসরকারি পর্যায়েও অনেকে রিসোর্ট ও হোটেল-মোটেল করার চেষ্টা করছে।
যাতাতায়াত
জেলাবাসী বিভিন্ন ভাবেই আসতে পারেন। বাইরের পর্যটকরা ঢাকা বা বিভিন্ন স্থান থেকে আগে সুনামগঞ্জ থেকে আসতে হবে। সুনামগঞ্জ থেকে গাড়ি বা নৌকা নিয়ে গন্তব্যে যাওয়া যাবে।