বিশেষ প্রতিনিধি::
টাঙ্গুয়ার হাওর ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত সংশ্লিষ্টরা হাওরের জীব-বৈচিত্র ধ্বংসে স্থানীয় মানুষকে চোর হিসেবে আখ্যায়িত করলেও তারা চোর নন। হাওরের মাছ ধরা বা স্থানীয় সম্পদ আহরণ করা তাদের চিরায়ত উত্তরাধিকার। বিশ্ব ঐতিহ্য রামসার সাইট ঘোষিত হওয়ার আগ থেকেই তারা এই অধিকার উত্তরাধিকারী হিসেবে যুগ যুগ ধরে ভোগ করছে। কাজেই তাদেরকে বাদ দিয়ে এই হাওরে কোন উন্নয়ন বা ব্যবস্থাপনা করা যাবেনা।
রবিবার সকালে সুনামগঞ্জের রামসার সাইট টাঙ্গুয়ার হাওরের জীববৈচিত্র রক্ষায় কার্যকর উদ্যোগ বিষয়ক এক মতবিনিময় সভায় অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এমএ মান্নান প্রথান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন। জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্টিত এই মতবিনিময়সভাটি আয়োজন করে পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থা।
সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক শেখ রফিকুল ইসলামের সভাপতিত্বে ও সংগঠনের সভাপতি কাশমির রেজা এবং টিটু পুরকায়স্থের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত মতবিনিময় সভায় বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন, সুনামগঞ্জ-৫ আসনের সাংসদ মুহিবুর রহমান মানিক, সুনামগঞ্জ-৪ আসনের সাংসদ পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ, সুনামগঞ্জ-মৌলভী বাজার সংরক্ষিত আসনের সাংসদ অ্যাডভোকেট শামছুন্নাহার রব্বানী শাহানা, পরিবেশ দফতরের পরিচালক জাফর সিদ্দিক, সাবেক সাংসদ নজির হোসেন, তাহিরপুর উপজেলা চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান কামরুল প্রমুখ।
অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এমএ মান্নান প্রধান অতিথির বক্তব্যে আরো বলেন, প্রকৃতি প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে। পরিবর্তিত অবস্থায়ই আমাদের খাপ খাইয়ে চলতে হবে। এই পরিবর্তনের ফলে টাঙ্গুয়ার হাওরেরও পরিবর্তন হচ্ছে। এটা মেনে নিয়েই কাজ করতে হবে। কোন বিধিমালা তৈরি করে হাওর রক্ষা করা যাবেনা। স্থানীয় উপকারভোগীদের সঙ্গে নিয়েই তাদের গুরুত্ব দিতে হবে। চোর হিসেবে আখ্যায়িত করে তাদের দূরে ঠেলে দিলে চলবেনা।
মতিবিনময় সভায় সাবেক সাংসদ নজির হোসেন বলেন, আশির দশকে টাঙ্গুয়ার হাওরে প্রচুর গাছের বাগ ছিল। সেই বাগে অনেক বাঘও ছিল। এখন কিছুই নেই। আলম ডহরে একবার জাল ফেলে ৮০ লক্ষ টাকার মাছ ধরা যেতো। বছরে এ হাওরে ৮ হাজার টন মাছ উৎপাদন হতো, এখন ৮ টনও হয়না। তাই এনজিও পরিচালিত এই ব্যবস্থাপনায় টাঙ্গুয়ার হাওরকে আগের অবস্থায় নিয়ে আসা যাবেনা। বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের হাতে তুলে দিলে টাঙ্গুয়াকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব।
সুনামগঞ্জ-৪ আসনের সাংসদ অ্যাডভোকেট পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ বলেন, কোন এনজিও দিয়ে আমাদের সম্পদ রক্ষা সম্ভব নয়। টাঙ্গুয়ার হাওর কো ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম ব্যর্থ হয়েছে। তাই আগের ইজারাদার পদ্দতি দিয়েই এই সম্পদ রক্ষা করতে হবে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক জাফর সিদ্দিক বলেন, টাঙ্গুয়ার হাওরের বর্তমান ব্যবস্থাপনা প্রশ্নবিদ্ধ। এটা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে এবং আন্তর্জাতিক জীববৈচিত্রের এই জলাভূমিতে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হলে পুরোটা সরকারি আওতায় নিয়ে আসতে হবে। বাড়াতে হবে জনবল। টাঙ্গুয়ার হাওরের প্রতিদিনের অবস্থা রেকর্ড করে রাখতে হবে।
তাহিরপুর উপজেলা চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান কামরুল বলেন, টাঙ্গুয়ার হাওরের পরিবেশ আগের জায়গায় নেই। হাওর রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থাপনার নামে প্রকৃতি বিনাশ করা হয়েছে। এখন মাছের ভান্ডার খ্যাত এই হাওরে আছে কেবল মাছ, গাছ আর পর্যটক। তাই এই হাওরকে পর্যটন এলাকা হিসেবে ঘোষনা করে বিধি তৈরির মাধ্যমে হাওরের পরিবেশ বজায় রেখে পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত করে দিতে হবে।
স্থানীয় পরিবেশকর্মী ফেরদৌস আলম বলেন, ২০০৩ সাল থেকে চলে আসা ‘টাঙ্গুয়ার হাওর কো ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম’ ব্যবস্থাপনায় হাওরের জীব-বৈচিত্র বিনাশ করা হয়েছে। এই ব্যবস্থাপনায় সরকারিভাবে হাওরের মানুষকে চোর হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। এটা তাদের জন্য চরম অপমান।
উল্লেখ্য ১৯৯৯ সনে সুনামগঞ্জের তাহিরপুরে অবস্থিত টাঙ্গুয়ার হাওরটি পরিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণার পর ২০০০ সালে সুন্দরবনের পর বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি পায়। এর পর ৬০ বছরের ইজারা প্রথা বিলোপ করে হাওরটি ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ে স্থানান্তরিত করা হয়। ২০০৩ সাল থেকে সুইস দাতা সংস্থা এসডিসির অর্থায়নে আন্তর্জাতিক পরিবেশ সংগঠন আইইউসিএন ও জেলা প্রশাসন যৌথভাবে ‘টাঙ্গুয়ার হাওর কো ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম’ নাম দিয়ে জীব-বৈচিত্র পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার কাজ শুরু করে। কিন্তু গত ১৩ বছরে প্রকৃতি রক্ষার নামে হাওরের প্রকৃতি বিনাশ হয়েছে বলে জেলাবাসী বিভিন্ন ফোরামে বলে আসছেন।