আমি সবেমাত্র দ্বিতীয় শ্রেণী পড়া শেষ করেছি,বলতে পারতাম না- “I read in class three’ । যখন কেউ কোন ক্লাসে পড়ো জিজ্ঞেস করবে তখন বলবা ক্লাস থ্রী আর যদি বলে কোন শ্রেণীতে তাহলে বলবা তৃতীয় শ্রেণীতে কথাগুলো শিখিয়ে ছিলেন সদ্য প্রয়াত দাদা নিশিকান্ত দাশ। জন্ম ১৯৬০ ইংরেজীর ৭ জুলাই আমাদের গ্রাম ঘেষা দাঁড়াইন নদীর পূর্ব তীরে শাল্লা উপজেলার হরিনগর গ্রামে। পিতা- ওস্তাদ রাধাকান্ত দাশ ও মাতা সুভদ্রা রাণী দাশের সপ্তম সন্তানের মধ্যে বড় সন্তান উনি। বাড়ীর পূর্ব পরিচিত ছিলো আহল্বাদ সরকারের বাড়ী। এলাকাতে রাধাকান্ত বাইনের বাড়ী হিসাবে পরিচিত।
ওস্তাদ রাধাকান্ত দাশের বড় ভাই বাবু কৃষ্ণকান্ত দাশও দেশ বিভাজনের আগেই ভারতে স্থায়ী নিবাস করে সেখানের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সাথে জড়িত হয়েছিলেন।
একসময়ে হরিনগর গ্রামে অন্যান্য বাড়ী যেমন- ডুলগোবিন সরকারের বাড়ী, গগণ সরকারের বাড়ী, কাঙ্গালী সরকারের বাড়ীর ন্যায় এই বাড়ীটিও খ্যাত ছিলো। যদিও কালক্রমে আজকের নতুন প্রজন্মের কাছে এই বিশেষ পরিচিত পারিবারিক নামগুলো হারিয়ে যাচ্ছে।
লোক মুখে কথিত আছে এক সময় শাল্লা শিল্পকলা একাডেমিতে ওস্তাদ রাধাকান্ত বাবু ২৭ টি বাদ্য যন্ত্রে পারদর্শী ও পন্ডিত রাম কানাই দাশ ১৭ টি তে পারদর্শীকতা দেখিয়ে ছিলেন। আরো উল্লেখ করতে হয় ওস্তাদ রাধাকান্ত দাশের তবলার কেরামতি ও মৃদঙ্গের অনন্য বাজনায় আজকের একুশে পদক প্রাপ্ত পন্ডিত রামকানাই দাশ তখন যাত্রা গানে নৃত্য পরিবেশনা করতেন।
নিশি দাদাও উনার পূর্ব পুরুষদের ন্যায় সংগীত,বাদ্যযন্ত্র,হাতের কারোকাজ,কথা বলার স্টাইল,এক
প্রত্যুতপন্নমতি অদ্ভূত মানুষ ছিলেন। সিংহ রাশির এই মানুষটি চেহারায় থাকতো দীপ্ত হাসির
বহি:প্রকাশ। চরিত্রে ছিলো না বিন্দু মাত্র দোআচলা। যা বলার সাহস নিয়েই বলতে পারতেন এবং
স্পষ্ট করেই বলতে পারতেন।
আমার শুনামতে উনার অনেক দোষ ছিল। এগুলি সঠিক হয়ে থাকলে বলা যায়-দোষ গুণে মানুষ।
উনারও হয়তবা অনেক দোষত্রুটি সীমাবদ্ধতা ছিলো, অনেক ভুল ভ্রান্তি ছিলো।
উনার জীবন চলাটাই ছিলো এই সাধারণ সমাজ ব্যবস্থার প্রতিকূলে। তাঁর জীবনে কৃত্রিমতার কোন লেশ ছিলো না। ছিলেন স্বপ্ন বিলাসী। জীবনে যা ভালবেসেছেন তাই করেছেন। সমাজের কুপ্রথাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সমাজের শ্রেণীকরণ (বড়লোক-ছোটলোক) ভেঙ্গে জীবন সঙ্গিনীকে বেঁচে নিয়ে ছিলেন। সাধারণ সমাজ ব্যবস্থায় ওদেরকে আমরা অমানুষ হিসাবে দেখি। যেমন বিশিষ্ট ছবি নির্মাতা শক্তি সামন্ত, মধু চরিত্রটিকে (নায়ক উত্তম কুমার) তাঁর ‘অমানুষ’ ছবিতে যেভাবে চিত্রিত করেছেন। আসলেও কি তাই ? নিশ্চয় নয়। ওদের মুনুষত্ব্য সমাজ দেখতে পায় না।
অপরদিকে সমাজে বিভিন্ন শ্রেণী পেশার অনেকেই আছেন যারা বাইরে এক ভিতরে আরেক। জিজ্ঞেস করলে দেখবেন সবাই সাধু। কারন ওরা দ্বিমুখী চরিত্রের অধিকারী। কিন্তু নিশিদাদা সেরকম ছিলেন না উনার চরিত্র একমুখী, চরিত্রে কোন লোকচুরি ভাব ছিলো না। কারো বিষয়ে মন্দ গেয়ে বেড়ানো দূরের কথা নিশিদাদার চিন্তায়ও কখনো পাইনি। আর এসব কারনেই সমাজে অদৃশ্যে, হৃদয়ের কোনে, নিশিদাদার স্থান নিশি দাদাদের স্থান।
নিশিদাদার সাথে আমার কোন রক্তের সম্পর্ক নেই তবে আত্মিক সম্পর্কটা অনেক। উনি আমার বড়দিদি-বড়দাদার চেয়েও বড়। উনার ছোট মেজো বোন আমার বড়দিদির ক্লাসমেট ছিলো তাছাড়া উনার বাবা ও আমার বাবা সংগীত প্রিয় ছিলো বিধায় আমাদের বাড়িতে ছিলো উঠা-বসা। দেখা হলেই সর্বপ্রথম পড়াশুনার কথা জিজ্ঞেস করতেন। প্রাণখুলে করতেন আদর যা চুল পরিমাণ কোন খাদ থাকতো না। আমার পড়াশুনা জীবনের উপজেলা সেন্টার পরীক্ষা (৫ম শ্রেণীর) ভালো ফলাফল নিজ গ্রামের বড় ভাই রুনু দাদা ( রণদা ) আমাকে রাস্তায় পেয়ে বলতে না বলতে ঘরে এসে দেখি নিশিদাদা আমাদের ঘরে হাজির। বিষয় উপজেলাতে প্রথম স্থান অধিকারের খবর। সেদিনের আন্তরিকতার খবর এখনও চোখে ভাসছে। গতকাল যখন বড়দাকে ভিডিও কল দিয়ে নিশিদাদার খবর নেই তখন অশ্রুসিক্ত নয়নে বলে ‘অয়য়ো যা শুনেছস ঠিক’।
নিশিদাদা আর নেই। পরে কলটা আমিও কেটে দেই বুঝতে পারলাম বুকের মাঝে কে যেন আঘাত করেছে। উল্লেখ্য গত ৬ জুন জলাতংক রোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। আজ নিশিদাদার চরনে প্রণাম করে বলতে ইচ্ছে করছে-
দাদা দ্যাখো- আজ তোমার স্নেহাস্পদ থ্রী; ফাইভ পাস করে বিশ্ববাজারের মান সম্মত চাকুরীর বাজারে ডুকেছে। আজ বলতে পারি ` read in class three I have passed class two Dada’
লেখক: সুশান্ত দাস, যুক্তরাজ্যপ্রবাসী। সাবেক ছাত্র ইউনিয়ন নেতা।