অনলাইন ডেক্স::
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আজ ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রার্থী হিলারি ক্লিনটন এবং রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের চূড়ান্ত লড়াই হবে। নির্বাচনের আগের দিনটি তারা কাটিয়েছেন বিভিন্ন রাজ্যের প্রত্যন্ত অঞ্চলের ভোটারদের কাছে প্রচারণা চালিয়ে। আগে থেকেই নির্বাচনে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের আভাস দিয়েছিল বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম।
এবারই প্রথম চলতি রীতি ভেঙে নির্বাচন চলাকালে নির্বাচনের অগ্রিম ফলাফল (এক্সিট পোল) জানাতে সমর্থ হবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। এর আগের নির্বাচনগুলোতে ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার পরই কেবল এক্সিট পোল জানা যেত।
আর এবারই প্রথম দেশটিতে কোনো নারী প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৭৮৯ সালে প্রথম নির্বাচনে জর্জ ওয়াশিংটন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। ওই সময় নারীদের কোনো ভোটাধিকারই ছিল না। আজকে নারীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় যুক্তরাষ্ট্রের সামনে এবার প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করার হাতছানি। হিলারি ক্লিনটন নির্বাচিত হলে তিনিই হবেন দেশটির প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট। যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের সামনে সেই সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাহেন্দ্রক্ষণ উপস্থিত।
শেষমুহূর্তে মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন জানিয়েছে, নির্বাচনে হিলারির পাল্লা কিছুটা ভারী থাকলেও, তা যে কোনও দিকে ঘুরে যেতে পারে। জাতীয় পর্যায়ের মতামত জরিপগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ট্রাম্পের চেয়ে কিছুটা ভালো অবস্থানে রয়েছেন হিলারি। বেশ কয়েকটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ অঙ্গরাজ্যেও হিলারি এগিয়ে। তবে তার এই এগিয়ে থাকাটা নির্ধারক ভূমিকা নেবে এমন নয়। ট্রাম্প সমর্থকরা বিপুল পরিমাণে ভোট দিলে, মানে ভোটাধিকার প্রয়োগের ক্ষেত্রে তাদের ব্যাপক অংশগ্রহণ নিশ্চিত হলেই কেবল রিয়েলএস্টেট ব্যবসায়ী ট্রাম্প আগামীদিনের মার্কিন প্রেসিডেন্ট। হতে পারবেন। অথবা হিলারি শিবিরের সমর্থকদের ভোট দেওয়ার পরিমাণ খুবই কম হলে ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হতে পারেন।
শেষ দিনের প্রচারণা
ট্রাম্প-হিলারি উভয়েই নির্বাচনের আগের দিনটিতে বিভিন্ন রাজ্যের প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রচারণা চালিয়েছেন। হিলারি দিনের প্রথম নির্বাচনি সমাবেশ করেন পেনসিলভ্যানিয়া অঙ্গরাজ্যের পিটসবার্গে। সেখানে তিনি বলেন, ‘আমি এখানে উপস্থিত হয়েছি, আপনাদের ভোট দেওয়ার অনুরোধ করতে। আপনাদের নিজেদের জন্য, পরিবারের জন্য এবং নিজেদের ভবিষ্যতের জন্য ভোট দিন।’
অপরদিকে, ট্রাম্প শেষ দিনে পাঁচটি নির্বাচনি সমাবেশে অংশ নেন। তার মধ্যে প্রথম প্রচারণাটি শুরু হয় ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের সারাসোটায়। সেখানে তিনি হিলারিকে ‘মেকি’ বলে উল্লেখ করেন। ট্রাম্প বলেন, ‘তিনি (হিলারি) জিতলে, তা হবে এক বিপর্যয়।’
জরিপে এগিয়ে হিলারি
সিএনএন-এর নির্বাচনি জরিপে হিলারি চার পয়েন্টে এগিয়ে রয়েছেন। বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের জরিপের ওপর ভিত্তি করে জাতীয় পর্যায়ের ওই জরিপটি প্রস্তুত করে হয়েছে। এতে দেখা যায়, হিলারি পেয়েছেন ৪৬ শতাংশ ভোটারের সমর্থন, অপরদিকে ট্রাম্পের পক্ষে সমর্থন রয়েছে ৪২ শতাংশের। অপরদিকে লিবারটেরিয়ান পার্টির গ্যারি জনসনের প্রতি সমর্থন রয়েছে ৩ শতাংশ ভোটারের আর গ্রিন পার্টির জিল স্টেইনকে সমর্থন জানাচ্ছেন ২ শতাংশ।
সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলোতে যেসব অঙ্গরাজ্যে ডেমোক্র্যাট প্রার্থীরা জয়ী হয়েছিলেন, তাতেও হিলারির অবস্থান ভালো। সেই সঙ্গে নির্ধারক অঙ্গরাজ্যগুলোর মধ্যে কয়েকটিতেও হিলারি জয়ী হবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
তবে মিশিগানের মতো অঙ্গরাজ্য, যেখানে ১৯৮৮ সাল থেকে কোনও রিপাবলিকান প্রার্থী জয়ী হননি, সেখানে ট্রাম্পের অবস্থান অনেক পোক্ত। আর তা ডেমোক্র্যাটদের জন্য চিন্তার কারণ। ট্রাম্প ক্রমাগত হিলারির সঙ্গে ব্যবধান আরও কমিয়ে আনছেন। ট্রাম্প শিবির শেষ মুহূর্তে জোর তৎপরতা চালাচ্ছে বলে জানা গেছে।
মিশিগানে হিলারি শিবিরের তৎপরতা তুলনামূলক কম ছিল। তাদের তৎপরতা বেশি ছিল ফ্লোরিডা, নেভাদা এবং নর্থ ক্যারোলিনায়।
ওহাইও, নর্থ ক্যারোলিনা এবং ফ্লোরিডায় তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার আভাস পাওয়া গেছে। ট্রাম্পকে নির্বাচনে জিততে হলে এই অঙ্গরাজ্যগুলোতে জয়ী হতে হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
ফ্লোরিডা এবং নেভাদায় আগাম ভোটে হিস্পানিকদের সমর্থন পেয়েছেন হিলারি। তবে কৃষ্ণাঙ্গদের নিরঙ্কুশ সমর্থন তিনি পাননি, যেমনটা ২০০৮ এবং ২০১২ সালের নির্বাচনে বারাক ওবামা পেয়েছিলেন।
সিএনএন-এর জরিপ অনুসারে হিলারির পক্ষে রয়েছে ২৬৮টি ইলেক্টোরাল ভোট আর ট্রাম্পের পক্ষে ২০৪টি ইলেক্টোরাল ভোট। হোয়াইট হাইসের টিকেট পেতে একজন প্রার্থীকে অন্তত ২৭০টি ইলেক্টোরাল ভোট পেতে হবে।
যেসব প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ অঙ্গরাজ্য বিজয়ী নির্ধারণ করবে, তার মধ্যে নর্থ ক্যারোলিনায় ট্রাম্পের ৪৩ শতাংশের বিপরীতে হিলারির রয়েছে ৪৫ শতাংশের সমর্থন। ফ্লোরিডায় উভয় প্রার্থীর সমর্থন ৪৫ শতাংশ। পেনসিলভ্যানিয়ায় হিলারি পাঁচ পয়েন্টে এগিয়ে থাকলেও সেখানে ট্রাম্পের সমর্থন বাড়ছে।
কয়েক সপ্তাহ আগে নিউ হ্যাম্পশায়ারে ট্রাম্প অনেক পিছিয়ে থাকলেও, গত সপ্তাহে ট্রাম্প-হিলারির সমর্থন যথাক্রমে ৪১ এবং ৪৪ শতাংশ।
শেষ মুহূর্তের প্রাপ্তি
ট্রাম্পের জন্য আশাবাদী হওয়ার আরেক কারণ হলো, মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ও প্রভাবশালী রিপাবলিকান নেতা পল রায়ান দলীয় প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পকে আবারও সমর্থন জানিয়েছেন। পূর্বের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে ট্রাম্পের প্রচারণায় অংশ নেওয়ার কথাও জানিয়েছেন তিনি।
উল্লেখ্য, দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার সময় ট্রাম্পের প্রচ- বিরোধিতা করলেও এক পর্যায়ে সেখান থেকে সরে এসে রায়ান জানান, তিনি নিজের দলীয় প্রার্থীকেই ভোট দেবেন। ট্রাম্পের প্রচারণাতেও অংশ নিচ্ছিলেন তিনি। তবে একপর্যায়ে গত মাসের (অক্টোবর) শুরুতে ট্রাম্পের ২০০৫ সালের এক নারীবিদ্বেষী ভিডিও প্রকাশের পর রায়ান বলেছিলেন, তিনি আর ট্রাম্পের প্রচারণায় থাকবেন না। এবার সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার ঘোষণা দিলেন তিনি।
অপরদিকে, নির্বাচনের একেবারে শেষ মুহূর্তে এসে মার্কিন তদন্ত সংস্থা ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই) হিলারিকে চলতি বছরের মধ্যে দ্বিতীয়বারের মতো দায়মুক্তি দিলো। এতে হিলারির প্রচারণায় খুব সামান্যই প্রভাব পড়ছে বলে মনে করা হচ্ছে।
উল্লেখ্য, হিলারি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালে ২০০৯-২০১৩ সাল পর্যন্ত ব্যক্তিগত সার্ভার থেকে ইমেইল আদান-প্রদান করেছিলেন। দীর্ঘ সময় ধরে আদান-প্রদান করা ইমেইলগুলোতে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয়েরও উল্লেখ ছিল। যুক্তরাষ্ট্রে সরকারের নিয়ন্ত্রিত চ্যানেল ছাড়া ক্লাসিফায়েড তথ্য আদান-প্রদানের ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এ ধরনের অনিরাপদ চ্যানেলের মাধ্যমে অতি গোপনীয় ইমেইল ফাঁস হওয়াকে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি বলে মনে করে মার্কিন সরকার। খবরটি প্রকাশ হওয়ার পর ঘটনার তদন্তে নামে এফবিআই। গত ২৯ জানুয়ারিতে সংস্থাটির অনুরোধে হিলারির ২২টিরও বেশি ইমেইলকে ‘অতি গোপনীয়’ বলে ঘোষণা করে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতর। আর জুলাই মাসে প্রথম ধাপের তদন্ত শেষ করে এফবিআই জানিয়েছিল হিলারিকে অভিযুক্ত করা হচ্ছে না। ২৮ অক্টোবর এই ডেমোক্র্যাট প্রার্থীর বিরুদ্ধে এফবিআই নতুন করে তদন্ত শুরুর ঘোষণা দেয়। এর ৮ দিনের মাথায় জুলাইয়ের সিদ্ধান্ত অপরিবর্তিত রাখার ঘোষণা আসে এফবিআই-এর তরফ থেকে।
৮ নভেম্বরের নির্বাচনের মাত্র দুই দিন আগে এফবিআই প্রধান জেমস কোমি ঘোষণা দেন, ‘হিলারি ক্লিনটন পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালে তার কাছে আসা এবং তার পাঠানো সব ই–মেইল আমরা তদন্ত করেছি। গত জুলাইয়ে হিলারি ক্লিনটনের বিষয়ে নেওয়া সিদ্ধান্ত আমরা পরিবর্তন করছি না।’
এই ঘটনায় ট্রাম্প অভিযোগ করেন, রাজনৈতিক চাপে এফবিআই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তিনি বলেন, ‘হিলারি নিজেও জানেন, তিনি অপরাধী। আর তা এফবিআই জানে, জনগণও জানে।’
এক্সিট পোলের নতুন ইতিহাস
১৯৮০ সালে জিমি কার্টারের সময়কাল থেকে ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার আগে মার্কিন নির্বাচনের অগ্রিম ফলাফল (এক্সিট পোল) প্রকাশ করা হতোনা। কিন্তু এবার সেই ব্যবস্থার পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে বলে জানিয়েছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম পলিটিকো।
ওবামা এবং বুশ প্রশাসনের প্রচারণা দলের সদস্যদের দ্বারা গঠিত ‘ভোটকাস্টার’ নামক একটি প্রতিষ্ঠান ভোটের দিন সকাল থেকেই ওই এক্সিট পোল পরিচালনা করবে।
যেখানে এপি, এনবিসি, সিএনএন, এবিসি-র মতো প্রখ্যাত সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিদের মোবাইল ফোন ছাড়া এক আবদ্ধ কক্ষে বসে ভোট শেষের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। সেখানে এবার ভোটের আগে থেকেই মানুষের কাছে পৌঁছে যাবে ভোটারদের অভিমত। তবে এই ব্যবস্থা ভোটারদের মধ্যে বিপরীত প্রভাবও ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
ভোটারকাস্টারের প্রধান সাংবাদিক সাশা আইসেনবার্গ বলেন, ‘ভোটকেন্দ্রে কেমন মানুষ হয়, তার ওপর নির্বাচনের ফলাফল নির্ভর করবে।’