গত ১৫ জুলাইয়ের দৈনিক সুনামকণ্ঠে একটি ছবি ছাপা হয়েছে। মোটে সাতজনের। এই সাতজনের একজন ছাত্রী, উচ্চমাধ্যমিকে উঠেছেন মাত্র। তিনি গরিব । চিত্রবিবরণীতে বলা হয়েছে, ‘এবারের এসএসসি পরীক্ষায় সে জিপিএ ৪.৯৫ পেয়েছে। তাঁর বাবা অসুস্থ, মা বিভিন্ন জায়গায় কাজ করেন। সুদে টাকা এনে মেয়েকে সুনামগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজে ভর্তি করেছেন মা। রিমা আক্তারের বই কেনার সামর্থ(্য) নেই। গৌরবের মুক্তিযুদ্ধ-এর পক্ষ থেকে তার সকল বই কিনে দেওয়া হয়েছে।’ এই ছবিটি ছাত্রীটির হাতে বই তোলে দেওয়ার ছবি। যাঁরা বই দিচ্ছেন তাঁরা সবাই সর্বমহলে পরিচিত এবং স্ব স্ব ক্ষেত্রে সমুজ্জ্বল ব্যক্তি ও এই শহরের সম্মানিত বিশিষ্টজন। এখানে তাঁদের নাম করার প্রয়োজন বোধ করছি না। কিন্তু তাঁদেরকে তাঁদের এই হিতৈষী কাজের জন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি এবং সেই সঙ্গে বলছি, এই ধন্যবাদ শুকনো সৌজন্যবোধ থেকে উৎসারিত নয়, এতে কোনও কৃত্রিমতা নেই, এই ধন্যবাদ আন্তরিকতার রসে সিক্ত।
রিমা সুদে ধার করা টাকায় বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন, বিদ্যালয়টি সরকারি, রিমার বই কেনার টাকা নেই, বই কিনে দিয়েছেন গৌরবের মুক্তিযুদ্ধ। এরপর কেউ যদি এই রিমাকে বাংলাদেশের প্রকৃত অবস্থারই প্রতীকরূপে প্রতিপন্ন করতে আগ্রহী হয়ে উঠের, তাঁকে কি খুব একটা দোষারোপ করা সঙ্গত হবে ? স্বাধীনতার দুই বছর কম অর্ধশতাব্দী অতিক্রম করেছে দেশ। একটি দেশকে উন্নতির চূড়ায় নিতে যেতে পঞ্চাশ বছর লাগে না। পার্শবর্তী দেশ মালয়েশিয়া তা প্রমাণ করেছে। মালয়েশিয়া তার জনসম্পদকে জনশক্তিতে পরিণত করতে পেরেছে, বাংলাদেশ পারেনি। বাংলাদেশর স্বার্থান্বেষীরা রাষ্ট্রের স্থপতিকে হত্যা করেছে, স্বাধীনতার পূর্বকালে প্রত্যাবর্তনের ব্যর্থ চেষ্টা করতে গিয়ে জনসম্পদকে বেকার বানিয়ে আপদ তৈরি করেছে, অধিকাংশ মানুষকে গরিব রেখে দিয়েছে, শিক্ষার উন্নতি করেনি, শিক্ষাকে দামি পণ্য বানিয়ে দিয়েছে, প্রশাসনের চেয়ারগুলোকে নিলামে বিক্রয়যোগ্য পণ্য করে তুলেছে, মানুষের জন্য কাজের ক্ষেত্র তৈরি করেনি। বাস্তব অবস্থা এমন যে, রিমার বিদ্যালয়ে ভর্তি সরকারি সেবার অন্তর্ভুক্ত নয়, তাঁর বাাব-মার দারিদ্র্য নিরসন সে-সরকারি সেবার তালিকায় নেই । কিংবা একজন মেধাবী ছাত্রীর পড়াশোনার দায়িত্ব রাাষ্ট্র নিতে পারেনি, সরকারি বিদ্যালয়ে তার ভর্তি বিনা পয়সায় সম্ভব হয়নি। মনে হচ্ছে রিমার মুখটা বুঝি একটা আয়না। যে-আয়নায় বাংলাদেশের মুখ দেখা যায়।
এটাই দেশের সাধারণ চিত্র। মুক্তবাজার অর্থনীতি মুনাফা লুণ্ঠন করতে গিয়ে দেশের এই অবস্থা করেছে, দেশকে একটি কল্যাণরাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলা যায়নি। ইদানিংকার অবস্থা বিবেচনায় মনে হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশকে একটি সমৃদ্ধির স্বপ্নপূরণের অভিমুখে যাত্রাপর করে দিয়েছেন। দেশ একটি কল্যাণরাষ্ট্র হিসেবে গড়ে উঠার দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে। তারই ইঙ্গিত পাই তিনি যখন বলেন : সরকারি সেবা নিতে সাধারণ মানুষ যেন বঞ্চিত না হয়, তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের জীবনমান যেন উন্নত হয়, দারিদ্রসীমা থেকে তারা যেন উঠে আসতে পারে, সবার ক্রয় ক্ষমতা যেন বৃদ্ধি পায়।
লেখক: কবি, গবেষক ও সিনিয়র সাংবাদিক।