প্রান্তিক জনপদ হলেও সুনামগঞ্জের রয়েছে ছাত্র আন্দোলনের এক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। কিন্তু কালচক্রের ঘূর্ণাবর্তে তার উপর ক্রমশ জমতে থাকে বিস্মৃতির ধুলো। বিগত কয়েক বছর ধরে আমরা অন্বেষণ করে যাচ্ছি সেই হারানো অতীতের। সময়ের ধূলা ঝেড়ে ঝেড়ে পৌঁছতে চেষ্টা করছি শিকড়ে।
প্রাইমারি সোর্স থেকে আমরা উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছি যে, ১৯০৮ সালের ১৪ আগস্ট জুবিলী স্কুলের ছাত্রদের হাতে সূত্রপাত হয় সুনামগঞ্জের ছাত্র আন্দোলনের। বিলাতি পণ্য বর্জনের স্বদেশী আন্দোলনের ঢেউ এসে লেগেছিল প্রান্তিক এই জনপদেও।
এরপর অসহযোগ ও খেলাফত আন্দোলন, আইন অমান্য আন্দোলন, কুইট ইন্ডিয়া আন্দোলন এবং পাকিস্তান আন্দোলনে সুনামগঞ্জের ছাত্রসমাজ রাজপথ উত্তান করে তুলেছিল। নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের পাশাপাশি গড়ে উঠে বিপ্লবী গুপ্ত সংগঠন। ১৯৩৫ সালে কলকাতায় গঠিত হয়েছিল সিলেট জেলা কমিউনিস্ট পার্টি। সুনামগঞ্জের বিপ্লবী গুপ্ত সংগঠনের সদস্যরাই এতে মূখ্য ভূমিকা পালন করেন। ৬-সদস্য বিশিষ্ট সিলেট জেলা কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদকসহ চারজনই ছিলেন সুনামগঞ্জের, যার মধ্যে তিনজনই তখনও ছাত্র। পরবর্তীকালে এই সংগঠনই সুরমা উপত্যকায় বামপন্থী আন্দোলনের বিস্তার ঘটায়। একপর্যায়ে সুনামগঞ্জ পরিচিতি লাভ করে বামপন্থী আন্দোলনের সূতিকাগার হিসাবে।
তারপর সুরমায় প্রবাহিত হয়েছে বিপুল জলরাশি। সুনামগঞ্জের ছাত্রসমাজ ভাষা আন্দোলন, ৬২’র ছাত্র আন্দোলন, ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, মহান মুক্তিসংগ্রাম, স্বৈরাচার-বিরোধী আন্দোলনসহ সময়ের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ বাঁকে রাজপথ প্রকম্পিত করে তুলে।
সুনামগঞ্জের অতীতে নানা সময় সক্রিয় ছোটবড় প্রতিটি ছাত্রসংগঠনের তথ্য আমরা সংগ্রহের চেষ্টা করে যাচ্ছি। এক্ষেত্রে আমরা কেবল স্মৃতিচারণমূলক কথার উপর নির্ভর না করে অনুসন্ধান করছি তৎকালীন লিখিত ডকুমেন্টের।
ব্রিটিশ আমলের ছাত্র আন্দোলনের অনেক তথ্য-উপাত্ত প্রাথমিক উৎস থেকে সংগ্রহ করতে সক্ষম হলেও, পাকিস্তান আমল ও স্বাধীনতা-পরবর্তী কিছু কিছু সময় রয়ে গেছে অনুদ্ঘাটিত। তবু হাল ছেড়ে না দিয়ে আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
এরই ধারাবাহিকতায় বছর দু’য়েক আগে আমরা খোঁজে পেয়েছি সুনামগঞ্জে ছাত্রলীগের জন্মকথা। ইতিপূর্বে আমরা লিখেছি যে, ৩০ মে ১৯৬৩ খ্রি. তারিখে অনুষ্ঠিত এক সভায় সুনামগঞ্জ মহকুমা ছাত্রলীগের জন্ম হয়। দেওয়ান শামসুল আবেদীন ও আব্দুল আহাদকে যুগ্ম-আহ্বায়ক করে ১১ সদস্য বিশিষ্ট সুনামগঞ্জ মহকুমা ছাত্রলীগের সংগঠনী কমিটি গঠিত হয়। পরবর্তীতে আব্দুর রহীম চৌধুরী (শায়েস্তাগঞ্জ) ও দেওয়ান শামসুল আবেদীন সুনামগঞ্জ মহকুমা শাখার যথাক্রমে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
ছাত্রলীগের কমিটি গঠিত হলেও সাংগঠনিক অবস্থা ছিল ভীষণ নাজুক। সুনামগঞ্জের তৎকালীন ছাত্ররাজনীতিতে পূর্বপাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (ইপসু)-এর ছিল একাধিপত্য। ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দের প্রাণান্ত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও সংগঠনটির কার্যক্রম ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে পড়ে। তার কয়েকবছর পর অর্থাৎ ৭ম দশকের শেষভাগে মুজিবুর রহমান চৌধুরী (ফেনারবাক, জামালগঞ্জ), সুজাত চৌধুরী (দিরাই), আবুল লেইস (ছাতক), সুনামগঞ্জ কলেজের প্রমুখ ছাত্রনেতাগণ সাংগঠনিক তৎপরতা জোরদার করতে সচেষ্ট হন। সেই সময়ের অনেক ঘটনা, সাংগঠনিক কমিটি ইত্যাদি নিয়ে সাবেক ছাত্রনেতাদের মধ্যে রয়েছে মতানৈক্য। তৎকালীন অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতা প্রয়াত হয়েছেন, যাঁরা বেঁচে আছেন বয়সের ভারে তাঁদের অনেকের স্মৃতিশক্তি দুর্বল হয়ে এসেছে। পাওয়া যাচ্ছে না এ-সংক্রান্ত দলিলদস্তাবেজ।
কিন্তু গতকাল ১৯৬৯-৭০ সালের সুনামগঞ্জ মহকুমা ছাত্রলীগের কার্যকরী সংসদ সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট পেয়েছি।
পূর্বপাকিস্তান ছাত্রলীগ, সুনামগঞ্জ মহকুমা শাখা ১৯৭০ সালের ২৩ এপ্রিল স্থানীয় বি.ডি. হলে প্রবেশিকা পরীক্ষার্থী ছাত্রছাত্রীদের সম্মানার্থে একটি সম্বর্ধনা সভার আয়োজন করে।
এই উপলক্ষ্যে ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে ছাত্রনেতা মইন উদ্দীন ও আবুল লেইছ কর্তৃক একটি নিমন্ত্রণপত্র প্রকাশিত হয়। সুনামগঞ্জের গুলিস্তান প্রেস থেকে উক্ত নিমন্ত্রণপত্রটি ছাপা হয়।
উক্ত সম্বর্ধনা সভায় প্রধান অতিথির আসন অলঙ্কৃত করেন আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল হক। উল্লেখ্য, ৭০ এর সাধারণ নির্বাচনে ছাতক-জগন্নাথপুর নির্বাচনী এলাকা থেকে তিনি এমএনএ নির্বাচিত হন।
এছাড়া উক্ত সভায় যোগদান করেন পূর্বপাকিস্তান ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় সংসদের সহ-সভানেত্রী ও কেন্দ্রীয় সংগ্রাম পরিষদের সদস্যা রাফিয়া আখতার ডলি এবং কেন্দ্রীয় সংসদের প্রাক্তন প্রচার সম্পাদক অনলবর্ষী বক্তা স্বপন কুমার চৌধুরী। সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিত হয় বিচিত্রা অনুষ্ঠান, যাতে সংগীত পরিবেশন করেন ঢাকা বেতার ও টেলিভিশন শিল্পী মিস্ মিনী হক, আবদুর রহিম ও স্থানীয় শিল্পীবৃন্দ।
নিমন্ত্রণপত্রের শেষ পৃষ্ঠায় সুনামগঞ্জ মহকুমা ছাত্রলীগের ১৯৬৯-৭০ সালের কার্যকরী সংসদের নেতৃবৃন্দের নামও ছাপা হয়। কমিটিটি নিম্নে উল্লেখ করা হলো:
সভাপতি – মো: মজিবুর রহমান চৌধুরী
সহ-সভাপতি:
১. রবীন্দ্র কুমার দাশ তালুকদার
২. রেবেকা সুপ্রিয়া দাশ
৩. শাহানা চৌধুরী
৪. আব্দুল হেকিম
সাংগঠনিক সম্পাদক – তালেব উদ্দীন আহমেদ
দফতর সম্পাদক – উদয়শঙ্কর চক্রবর্তী
ক্রীড়া সম্পাদক – প্রাণেশ চন্দ্র রায়
পাঠচক্র সম্পাদক – আকিকুর রেজা চৌধুরী
সমাজসেবা সম্পাদক – আবদুল কাহির চৌধুরী
সাধারণ সম্পাদক – (অবসরপ্রাপ্ত) সুনীল সমাজপতি
ভারপ্রাপ্ত – সফিকুল চৌধুরী
সহ-সম্পাদক:
১. আব্দুছ ছবুর
২. রতন কুমার দাশ
৩. নাসরিন বেগম
৪. নূর মিয়া
প্রচার সম্পাদক – আলী আসগর
কোষাধ্যক্ষ- আফজালুর রহমান
প্রমোদ সম্পাদক – হিরণ খান
সাহিত্য সম্পাদক – আবদুল হান্নান
চিঠিটিতে কমিটির সাধারণ সদস্যগণের নাম উল্লেখ করা হয়নি।
লেখক: কল্লোল তালুকদার চপল
সদস্য, সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগ।