অনলাইন ডেক্স::
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যবসা ও বিনিয়োগ সহযোগিতা ফোরাম চুক্তির (টিকফা) আগামী বৈঠকে স্থগিত হওয়া জিএসপি সুবিধা পুনর্বহালে অনুরোধ করবে না বাংলাদেশ। তবে তৈরি পোশাকসহ বিভিন্ন খাতে কর্মপরিবেশ উন্নয়ন ও শ্রমিক অধিকার রক্ষাসহ যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া ১৬ দফার অগ্রগতির তথ্য দেশটিকে জানাবে বাংলাদেশ। অন্যদিকে, দুই দিনব্যাপী টিকফা বৈঠকের সময়সীমা আরো দুই দিন বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, মূল বৈঠকের সাইডলাইনে আরো কিছু বৈঠক করতে চায় তারা।
রানা প্লাজা ধসের পর ২০১৩ সালের জুনে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা স্থগিত করার পর ওই বছরের নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে টিকফা চুক্তি স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ। প্রতিবছর দুই দেশের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের বিভিন্ন ইস্যুতে আলোচনার ভিত্তিতে সিদ্ধান্তের পথ নির্ধারণের কথা বলা হয়েছে এই চুক্তিতে। ২০১৪ সালে ঢাকায় ও গত বছর ওয়াশিংটনে টিকফার বৈঠক হয়েছে। প্রতিবছরই দুই দিনব্যাপী এই বৈঠক হয়। এ বছর টিকফার বৈঠক ঢাকায় অনুষ্ঠিত হবে। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বৈঠকের সময়সীমা বাড়িয়ে চার দিন করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের কমার্শিয়াল কাউন্সিলর এস কে আক্তার হোসাইন সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে এক চিঠিতে জানিয়েছেন, টিকফার আগামী বৈঠক ১৩ ডিসেম্বর আয়োজনের অনুরোধ জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। চিঠিতে বলা হয়েছে, দেশটির বাণিজ্য মন্ত্রণালয়খ্যাত ইউনাইটেড স্টেটস ট্রেড রিপ্রেজেন্টেটিভ (ইউএসটিআর) দপ্তরের সহকারী ইউএসটিআর মাইকেল জে. ডিলানি এবং দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক পরিচালক জেবা রেয়াজুদ্দিনের সঙ্গে আক্তার হোসাইন টিকফার আগামী বৈঠক নিয়ে সভা করেছেন। ওই সভায় ডিলানি জানিয়েছেন, টিকফা বৈঠকের জন্য ১৩ ডিসেম্বর উপযুক্ত সময় হতে পারে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা টিকফা বৈঠকের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। গতকাল মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ও ডাব্লিউটিও সেলের মহাপরিচালক শুভাশীষ রায়ের সভাপতিত্বে একটি প্রস্তুতিমূলক সভা হয়েছে। সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া ১৬ দফা শর্ত বাস্তবায়নের সর্বশেষ অগ্রগতির তথ্য পর্যালোচনা করা হয়েছে। কথা হয়েছে শ্রমিক স্বার্থ সুরক্ষা, নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতি বিষয়েও।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন বলেন, আগামী ১৩ ডিসেম্বর ঢাকায় টিকফার বৈঠক হওয়ার কথা। তবে এটি পিছিয়ে ফেব্রুয়ারিতেও চলে যেতে পারে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট আগামী ২০ জানুয়ারি দায়িত্ব নেবেন। বৈঠকটি ফেব্রুয়ারিতে হলেই বাংলাদেশের জন্য ভালো। তাতে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন সরকারের নীতি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে।
গত দুই বৈঠকেই বাংলাদেশের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ১৬ দফা শর্ত বাস্তবায়নের অগ্রগতির তথ্য তুলে ধরে জিএসপি সুবিধা পুনর্বহালে জোর দাবি জানায়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদল প্রতিবারই বাংলাদেশের অগ্রগতিতে সন্তোষ প্রকাশ করে বলে, ‘আরো অগ্রগতি অর্জন করতে হবে।’ টিকফা বৈঠকের বাইরেও বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতসহ দেশটির বিভিন্ন পর্যায়ের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকে জিএসপি সুবিধা পুনর্বহালের ওপর জোর দিলেও যুক্তরাষ্ট্র একই কথা শোনাচ্ছে বারবার। ফলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ সরকার মনে করছে, আদতে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে জিএসপি সুবিধা দেবে না। সরকারের ধারণা, ১৬ দফা শর্ত বাস্তবায়ন করার পরও শুধু রাজনৈতিক কারণে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জিএসপি পুনর্বহাল করতে রাজি হচ্ছে না। এ অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও জিএসপি পুনর্বহালের বিষয়টি মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে নির্দেশনা দিয়েছেন বলে জানা গেছে।
টিকফার বৈঠকে জিএসপি সুবিধা পুনর্বহালের জন্য বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তেমন কোনো অনুরোধ জানানো হবে না উল্লেখ করে বাণিজ্যসচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন আরো বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া ১৬ দফা শর্ত আমরা বাস্তবায়ন করেছি। কিন্তু যখনই আমরা জিএসপি পুনর্বহালের কথা বলি, তখনই তারা ‘আরো অগ্রগতি করতে হবে’ উল্লেখ করে নতুন নতুন শর্তারোপ করছে। অর্থাৎ, বাংলাদেশের জিএসপি পুনর্বহালে যুক্তরাষ্ট্র আন্তরিক নয়। তাই টিকফার বৈঠকে আমাদের পক্ষ থেকেও জিএসপি পুনর্বহালের অনুরোধ করার ইচ্ছা নেই।”
মাস কয়েক আগে জিএসপি পুনর্বহালে যুক্তরাষ্ট্রের নিত্যনতুন শর্তের কথা বলতে গিয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ জাতীয় সংসদে বলেছেন, ‘জিএসপির জন্য যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া শর্ত রোজ কেয়ামত পর্যন্ত শেষ হবে না।’ বাণিজ্যমন্ত্রী বিভিন্ন সময় স্পষ্ট করে বলেছেন, জিএসপি সুবিধা পুনর্বহাল করা হলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে স্বাক্ষরিত টিকফা চুক্তি ফলপ্রসূ হবে না।
টিকফার আগামী বৈঠকে বাংলাদেশের আলোচনার বিষয়বস্তু কী? এমন প্রশ্নে বাণিজ্যসচিব বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশের আসলে চাওয়ার কিছু নেই। তারা যেখানে জিএসপি সুবিধাই পুনর্বহাল করছে না, সেখানে শুল্কমুক্ত-কোটামুক্ত সুবিধাও দেবে না। তবে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের প্রধান বাজার। বৈঠকে বাংলাদেশের রপ্তানি খাতসহ সার্বিক বাণিজ্য খাতের অগ্রগতির চিত্র আমরা যুক্তরাষ্ট্রের সামনে তুলে ধরব।’
টিকফার বৈঠক নিয়ে প্রস্তুতি সভা সম্পর্কে জানতে চাইলে শুভাশীষ বসু বলেন, ‘১৩ ডিসেম্বর ঢাকায় টিকফার বৈঠক হবে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের এজেন্ডাগুলো এখনো আমাদের কাছে আসেনি। আমরা বরাবরের মতোই বাংলাদেশের অগ্রগতির তথ্য তুলে ধরব।’
বাংলাদেশ রপ্তানিকারক সমিতির (ইএবি) সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী বলেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প ব্যবসায়ী থেকে প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন। আশা করি, তিনি বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের সমস্যা অনুধাবন করে জিএসপি সুবিধা পুনর্বহাল করবেন। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বিদায়ী পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির ঢাকা সফরকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশটির বাজারে শুল্কমুক্ত ও কোটামুক্ত যে রপ্তানি সুবিধা চেয়েছেন, আমরা সে সুবিধা আদায়েও চেষ্টা অব্যাহত রাখব।’