অনলাইন ডেক্স::
ম্যাচের ২৪ মিনিটে কান্না চোখে মাঠ ছেড়ে গিয়েছিলেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো, তার সঙ্গে ম্যাচ শেষের কান্নার কোনো মিল আছে? এর চেয়ে সুখের কান্নাও কি কখনো কেঁদেছেন পর্তুগিজ যুবরাজ? সেই কান্নার মধ্যেই তাকে ইউরো উপহার দিল পর্তুগাল। টানা টান উত্তেজনার খেলায় ১-০ গোলে জয় পেয়ে ইউরো চ্যাম্পিয়ন হওয়ার রোনাল্ডোর দল।
এ তো কান্না নয়, এ বরং দুচোখ ছাপিয়ে যাওয়া সুখের অনুভূতি। সেন্ট ডেনিসে আজ অতিরিক্ত সময়ের একমাত্র গোলে যে ফ্রান্সকে হারিয়ে ইউরোর শিরোপা জিতেছে পর্তুগাল। ঘুচেছে দেশটির প্রথম আন্তর্জাতিক শিরোপার আক্ষেপ, রোনালদোর একটি আন্তর্জাতিক শিরোপা না পাওয়ার দীর্ঘশ্বাস।
ম্যাচটা তাঁর জন্য ইতিহাস লেখার সবচেয়ে সুবর্ণ সুযোগ হয়ে এসেছিল। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর পায়েই ইতিহাস গড়ার স্বপ্ন দেখছিল পর্তুগাল। ইতিহাস পর্তুগাল ঠিকই গড়ল। তবে সেটিতে রোনালদো ছিলেন দর্শক হয়ে। চোট পেয়ে যে ম্যাচের ২৪ মিনিটেই মাঠ ছাড়তে হয় পর্তুগাল অধিনায়ককে। রোনালদোকে বরং ইউরো ‘উপহার’ দিয়েছে পর্তুগাল।
উপহার দিয়েছেন এডার। নির্ধারিত ৯০ মিনিটের পর অতিরিক্ত সময়ের প্রথমার্ধের পরও গোল দেখেনি ম্যাচ, মনে হচ্ছিল টাইব্রেকারেই নির্ধারিত হবে ম্যাচের ভাগ্য। এই সময়ই দৃশ্যপটে এডার। ফ্রান্স বক্সের একটু সামনে বল পেয়েছিলেন। একটু জায়গা করে নিয়ে প্রায় ২০ গজ দূর থেকে যে শট নিয়েছিলেন, সেটি ফ্রান্স গোলকিপার হুগো লরিসকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেল জালে। নিশ্চিত হলো পর্তুগালের ইতিহাস।
অথচ শুরুতে পর্তুগালের ভাগ্যটা কী অন্ধকারই না মনে হচ্ছিল! ম্যাচের ৮ মিনিটেই বল দখলের লড়াইয়ে ফ্রান্সের দিমিত্রি পায়েতের সঙ্গে ধাক্কা লেগে পায়ে চোট পান রোনালদো। পড়ে গিয়ে কাতরাতে থাকেন। হয়তো তখনই বুঝতে পেরেছিলেন আর চালিয়ে যেতে পারবেন না। কিন্তু একটা আন্তর্জাতিক শিরোপার আকাঙ্খা থেকেই হয়তো শুশ্রুষা নিয়ে আবারও ফিরে আসেন মাঠে। পায়ে স্কচটেপ লাগানো। কিন্তু ২৪ মিনিটে দলের আক্রমণে যোগ দিতে দৌড়াতে গিয়ে বুঝলেন, আর চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। স্ট্রেচারে করে ছেড়ে যান মাঠ।
তখন মনে হচ্ছিল, পর্তুগালের তো বটেই, ফুটবলেরই অন্যতম করুণ গল্প হয়ে থাকবে রোনালদোর এভাবে মাঠ ছেড়ে যাওয়ার দৃশ্যটা। কিন্তু ফুটবল এবার আর অতটা নিষ্ঠুর হলো না রোনালদোর প্রতি, পর্তুগালের প্রতি। মাঠে থাকতে পারেননি, কিন্তু শিরোপা মঞ্চে তো ছিলেন।
ঘুচলো রোনালদোর আন্তর্জাতিক শিরোপার আক্ষেপ। ছবি: উয়েফা।ম্যাচে অবশ্য পুরোটা সময়ই পর্তুগাল ছিল দ্বিতীয় সেরা হয়ে। শুরুতেই নানি পর্তুগালকে এগিয়ে নেওয়ার একটা সুযোগ পেয়েছিলেন, কাজে লাগাতে পারেননি। এরপর প্রথম ১৫-২০ মিনিটে বলতে গেলে একের পর এক আক্রমণে পর্তুগিজদের দিশেহারা করে রেখেছিলেন গ্রিজমান-সিসোকোরা। তবে দাপটটাকে গোলে রূপ দিতে পারেননি। সবচেয়ে সুবর্ণ সুযোগ পেয়েছিলেন গ্রিজমানই, তবে ১০ মিনিটেই ফ্রেঞ্চ ফরোয়ার্ডের দুর্দান্ত হেডটাকে কোনোমতে বারের ওপর উঠিয়ে দিয়েছিলেন পর্তুগাল গোলকিপার রুই প্যাট্রিসিও।
তবে ২৪ মিনিটে রোনালদো মাঠ থেকে উঠে যাওয়ার পর আশ্চর্যজনকভাবে ফ্রান্সের খেলার গতিও অনেকটা কমে যায়। অবশ্য এর ব্যাখ্যা দেওয়া যায় এভাবে, অধিনায়ককে হারিয়ে শোকের বদলে পর্তুগিজরা আরও বেশি চোয়ালবদ্ধ প্রতিজ্ঞা নিয়ে মাঠে ঝাঁপিয়ে পড়ে। অন্য দিকটা ফুটবলীয়, রোনালদোর বদলে কারেসমা মাঠে নামায় পর্তুগাল ফিরে যায় ৪-১-৪-১ ফর্মেশনে। আগের চেয়ে মিডফিল্ডে একজন বেশি হওয়ায় সিসোকো-পগবাদের নিয়ে গঠিত ফ্রান্সের মিডফিল্ডের সঙ্গে বরং সমান তালে লড়ে গেছে পর্তুগাল।
দ্বিতীয়ার্ধে গল্পটা একটু ভিন্ন। ফ্রান্স এই অর্ধেও দাপট ধরে রেখেছে, কিন্তু সুযোগ এসেছে দুই দলেরই। এর মধ্যে ম্যাচের সবচেয়ে দুর্দান্ত সুযোগটা পেয়েছিলেন গ্রিজমান। কিন্তু মাত্র ৬ গজ দূর থেকে করা হেডটাকে জালে জড়াতে পারেননি অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ ফরোয়ার্ড। যেমনটি পারেননি জিরুও, ৭৮ মিনিটে মাঠ ছেড়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ আগেও সুযোগ পেয়েছিলেন জিরু। কিন্তু কিছুটা দুরূহ কোণ থেকে নেওয়া তাঁর শটটা জড়ায় জালের এক পাশে। পুরো ম্যাচে দুর্দান্ত খেলতে থাকা সিসোকোর শটও ঠেকিয়ে দেন পর্তুগাল গোলকিপার।
ফ্রান্স গোলকিপার লরিসেরও অলস বসে থাকার উপায় ছিল না। প্রতি–আক্রমণের কৌশল নিয়ে পর্তুগালও যে লড়ে গেছে চোখে চোখ রেখে। ৮০ মিনিটে নানির ক্রস তো প্রায় ঢুকেই যাচ্ছিল পোস্টে, কিন্তু লরিস ঠেকিয়ে দেন। দুই মিনিট পর বক্সের বাইরে থেকে নেওয়া নানির দুর্দান্ত শটটাও চলে যায় বারের একটু ওপর দিয়ে।
তবে ম্যাচটাকে ৯০ মিনিটেই শেষ হতে দেয়নি গোলপোস্ট। ঠিক ৯০ মিনিটেরই সময় পর্তুগাল বক্সে জায়গা করে নিয়ে শট নিয়েছিলেন বদলি হিসেবে নামা ফ্রেঞ্চ স্ট্রাইকার আন্দ্রে পিয়েরে জিনিয়াক। কিন্তু তাঁর শট পর্তুগালের ডিফেন্ডার ও গোলকিপারকে ফাঁকি দিয়ে গিয়ে লাগে পোস্টে। ইউরোর ইতিহাসে এই প্রথম কোনো ফাইনাল ৯০ মিনিটে গোলশূন্য থাকল।
১০৭ মিনিটে পর্তুগালেরও বাধা হয়ে দাঁড়ায় গোলবার। বক্সের একটু বাইরে থেকে রাফায়েল গুরেইরোর ফ্রি কিক ফরাসি রক্ষণকে ফাঁকি দিলেও গিয়ে লাগে বারে। তবে ভাগ্য ঠিকই পর্তুগালের দিকে চেয়ে হাসল মিনিট দুয়েক পর। এডারের পায়ে ভর করে।
গোলটা হয়তো রোনালদোর পায়ে হলেই বেশি মানাত। কিন্তু রোমাঞ্চের শহরে ফুটবল আজ রোনালদোর জন্য অন্য রকম এক প্রেমগাথা লিখে রেখেছিল। মাঠে না থাকলেও এই ম্যাচে বেশ ভালোভাবেই তো ছিলেন পর্তুগাল অধিনায়ক! অতিরিক্ত সময় শুরু হওয়ার আগ মাঠে এসে প্রত্যেক সতীর্থকে জড়িয়ে ধরে প্রেরণা দিয়ে গেছেন। পর্তুগাল গোল করার পর তো রীতিমতো ‘কোচ’ই বনে গেলেন, ডাগআউটে দাঁড়িয়ে নির্দেশনা দিতে থাকলেন সতীর্থদের।
ফাইনালে মাঠে না থেকেও যোগ্য অধিনায়কের মতোই দলকে অনুপ্রেরণা জুগিয়ে গেছেন রোনালদো। সবচেয়ে বড় ব্যাপার, ম্যাচের বিরতিতে পর্তুগাল কোচ ফার্নান্দো সান্তোসও নাকি খেলোয়াড়দের উদ্বুদ্ধ করেছেন এই বলে, ‘চলো, রোনালদোর জন্য শিরোপাটা জিতি!’
পর্তুগাল জিতেছে, তাতে উদ্যাপনেও নেতৃত্ব দিয়েছেন রোনালদো। কে বলবে, ফাইনালে তিনি ছিলেন না। হয়তো এত দিন ধরে পর্তুগালের ফুটবলকে একা টেনে নিয়ে আসার পর এই উপহারটা রোনালদোর প্রাপ্যই ছিল। ইউরো উপহার দিয়ে রোনাল্ডোকে সম্মানটিও দিল দল।