স্টাফ রিপোর্টার::
সকাল থেকেই সুনামগঞ্জ জেলা শিল্পকলা একাডেমি প্রাঙ্গণ শিশু-কিশোরদের কলকাকলীতে মুখরিত। ‘আমরা কারা, শান্তির পায়রা’, ‘আজকের খেলাঘর, আগামী দিনের বাংলাদেশ, ‘বাল্যবিবাহ বন্ধ কর’, ‘শিশু নির্যাতন বন্ধ কর’ এসব স্লোগানে পুরো এলাকাজুড়ে বিরাজ করছে এক উৎসবের আমেজ। এমন উৎসব মুখর পরিবেশে শুক্রবার সকালে শিল্পকলা একাডেমিতে শুরু হয় সুনামগঞ্জ জেলা খেলাঘর আসরের সম্মেলন ২০১৯। জেলার বিভিন্ন উপজেলার খেলাঘর সদস্যরা সমবেত হন এই উৎসবে। শিশুদের নাচ, গান, আবৃত্তি আর অতিথিদের কথামালায় সম্মেলন অনুষ্ঠান ছিল বর্ণাঢ্য। সম্মেলনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় নবপ্রজন্ম গড়ার অঙ্গীকার করা হয়।
জাতীয় সঙ্গীত ও পতাকা উত্তোলনের মধ্যদিয়ে শুরু হয় উদ্বোধনী পর্ব। সম্মেলনের উদ্বোধন ঘোষণা করেন কেন্দ্রীয় খেলাঘরের প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যাপক ডা. মো. আবু সাঈদ। পরে শিশু-কিশোরদের অংশগ্রহণে শহরে বের করা হয় বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা। শোভাযাত্রাটি বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে আলোচনা সভায় মিলিত হয়।
সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন সুনামগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ ও বিরোধী দলীয় হুইপ অ্যাড. পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ। তিনি তাঁর বক্তব্যে বলেন, খেলাঘর শিশুদের একটি প্রাচীন সংগঠন। আমাদের অনেকে শিশুদের প্রসঙ্গে কথা বলেছেন, শিশু নির্যাতনের কথা বলেছেন। আমি আমার শৈশব বলতে যা বুঝি, আজকের শিশুদের সেই শৈশব নেই। আজকে শিশুদের শৈশবকে আমরা হত্যা করেছি। তুহিনকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছে, সেইভাবে সকল শিশুদের শৈশবকে হত্যা করা হয়েছে। আমরা শৈশবে স্কুল থেকে বেরিয়ে এসে বাসায় বই খাতা রেখে সন্ধ্যা পর্যন্ত পাড়ার ছেলেদের সাথে খেলাধুলা করতাম। এই সময় অভিভাবকদেরও সমস্যা ছিল না। কিন্তু বর্তমানে আমরা এমন হয়েছি, আমরা ছেলে-মেয়েকে বাড়ির ভিতরেই পড়াতে চাই, খেলাতে চাই। আমার ছেলেরা মাঠে গিয়ে খেলাধুলা করবে তা এখন আর নেই। আমরা অভিভাবকরাও অসুস্থ হয়ে যাচ্ছি। অসুস্থ প্রতিযোগিতার মধ্যে লিপ্ত হয়ে পড়েছি। সবাই মনে করেন তার সন্তান সবার সেরা হবে। কিন্তু পরিবারের ইচ্ছা তাদের ছেলে হবে ডাক্তার কিন্তু ছেলের ইচ্ছা হবে ফুটবলার। কিন্তু পরিবারের বাধার মুখে পড়ে ছেলেটির উপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে অভিভাবকদের ইচ্ছা পূরণে। তাই একজন মানুষের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে কাজ করানো হলো ওই মানুষটাকে হত্যা করা।
জেলা খেলাঘরের সভাপতি বিজন সেন রায়ের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক অ্যাড. এনাম আহমেদের পরিচালনায় অনুষ্ঠিত সভায় বক্তব্য রাখেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আহাদ, বীর মুক্তিযোদ্ধা মতিউর রহমান, কেন্দ্রীয় খেলাঘরের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক রুনু আলী, সম্পাদকম-লীর সদস্য মাহবুবুর রহমান, মৌলভীবাজার খেলাঘরের সভাপতি মাহবুবুর রহমান, হবিগঞ্জ খেলাঘরের সভাপতি বাদল রায়, জেলা খেলাঘরের সহ-সভাপতি অ্যাড. অলক ঘোষ চৌধুরী, বিধান চন্দ্র দেব, শাহাদাত হোসেন, রূপা পাল প্রমুখ। স্বাগত বক্তব্য রাখেন জেলা শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক রাজু আহমেদ।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে এমপি মিসবাহ আরো বলেন, শিশুদের উপর জোর করে কিছু চাপিয়ে দিবেন না। শিশুকে তার ইচ্ছার মর্যাদা দিতে শিখতে হবে। তার মধ্যে সাংস্কৃতিক ও খেলাধুলা চর্চা অবশ্যই রাখতে হবে। আমি মনেকরি খেলাঘর যারা করে তারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনাকে লালন করে বেড়ে উঠবে। তারা মানবিক মানুষ হিসেবে বেড়ে উঠবে। তারা মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখবে। খেলাঘরের যেকোনো প্রয়োজনে আমি পাশে থাকবো।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আহাদ বলেন, আজকে আমরা উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার দিকে ধাবিত হচ্ছি। কিন্তু আমাদের সমাজ ও পরিবারে থেকে আমাদের শিশুরা অনিরাপদ। অনিরাপদ মূলত দুইটি কারণে। একটি কারণ হলো মাঝে মধ্যে আমরা হিং¯্রতার উদাহরণ পেয়েছি যার শিকার হচ্ছে আমাদের শিশু। যদিও প্রতিটি ক্ষেত্রে কঠোরভাবে যারা প্রতিহিংসামূলক কাজ করছে তাদের আইনের আওতায় নিয়ে এসে বিচার হচ্ছে। কিন্তু তারপরেও এসব বন্ধ হচ্ছে না। কারণ পারিবারিক পরিম-লে আমরা আমাদের শিশুদের সময় দিচ্ছি না। দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে আমরা সন্তানদের খবর রাখি না। তারা কার সাথে আছে, কি করছে তা খোঁজ নেওয়ার সময় এখন আমাদের নেই। যান্ত্রিক সভ্যতার মধ্যে আমরা আমাদের সন্তানকে নিয়ে যাচ্ছি। এ অবস্থার পরিবর্তন হওয়া দরকার। একটি শিশুকে সাংস্কৃতিক ও খেলাধুলা সবকিছুর সুযোগ দিতে হবে। শিশুকে শুধু পড়াশোনার পিছনে না দৌড়ায়ে তাকে সাংস্কৃতিক ও শিশুর ইচ্ছা অনুযায়ী বেড়ে উঠার সুযোগ করে দিতে হবে।
খেলাঘরের প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যাপক ডা. আবু সাঈদ বলেন, আমাদের বাবা-মা তার সন্তানকে দুধে-ভাতে গড়ে তুলতে চান। এটি একটা দুষ্ট বৃত্ত। যা থেকে আমরা বের হতে পারছি না। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়ে বুঝতে পারলাম যে মানুষ আমাকে শিক্ষিত করেছেন। তাদের তরে আমি। আমার চিন্তা-ভাবনা মানুষের স্বার্থে ব্যবহার হবে। নিজের সন্তানকে দুধে-ভাতে রাখার দুষ্ট বৃত্ত ভাঙ্গতে হবে।
তিনি বলেন, অন্যকে ফাঁসাতে নিজের সন্তানকে মারছি। অন্যকে শাস্তি দেয়া বা পরাজিত করার মানসিকতা কখনও মনুষত্বের শিক্ষা হতে পারে না। আপনার শিশু অন্য শিশু থেকে বড় ভাববেন না। বড় ভাবার শিক্ষা দিবেন না। আজকের সমাজ ব্যবস্থায় নিজেকে বড় ভাবার প্রতিযোগিতা চলছে। যা শিশুর মানসিকতা সংকীর্ণ করে তুলছে।
বীর মুক্তিযোদ্ধা মতিউর রহমান বলেন, আমরা দীর্ঘদিন পরাধীনতার শৃঙ্খলে বন্দি ছিলাম। আমরা যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি। কিন্তু এখনও বিভিন্ন অরাজকতায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে দেশ। খেলাঘরের বন্ধুদের এই অরাজকতা ভাঙার যোদ্ধা হতে হবে।
সংগঠনের কেন্দ্রীয় ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক রুনু আলী বলেন, আমরা কষ্টে আছি, যা কথা ছিল না। স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তভাবে বেড়ে উঠার কথা ছিল। কিন্তু সারাদেশে যেভাবে শিশু হত্যা, ধর্ষণ হচ্ছে এর প্রতিবাদ করছি আমরা। সমাজ বা পরিবারে শিশুরা আজ নিরাপদ নয়। এই অবক্ষয় থেকে শিশুদের মুক্তি দিতে একটি বিজ্ঞানমনস্ক দেশ গড়ে তুলতে হবে। পড়ালেখার ধরাবাধা নিয়ম ছাড়িয়ে স্বাধীনভাবে শিশুদের চলতে দিতে হবে। তা না হলে শিশুরা ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে পারবে না।
আলোচনা সভা শেষে কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। সবশেষে খেলাঘর আসরের বিভিন্ন ইউনিটের সদস্যদের পরিবেশনায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়।
জেলা খেলাঘরের কমিটি গঠন
সভাপতি বিজন সেন রায়
সম্পাদক রাজু আহমেদ
স্টাফ রিপোর্টার ::
সম্মেলনের মাধ্যমে সুনামগঞ্জ জেলা খেলাঘরের কমিটি গঠন করা হয়েছে। শুক্রবার জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে অনুষ্ঠিত কাউন্সিল অধিবেশনে নতুন কমিটি গঠন করা হয়। ৩১ সদস্যের কমিটিতে সভাপতি পদে পুনরায় নির্বাচিত হয়েছেন বিজন সেন রায়। অন্যান্য দায়িত্বপ্রাপ্তরা হলেন- সহ-সভাপতি অ্যাড. অলক ঘোষ চৌধুরী, অ্যাড. দেবদাস চৌধুরী রঞ্জন, নিগার সুলতানা কেয়া, কানিজ সুলতানা, এনাম আহমদ, সাধারণ সম্পাদক রাজু আহমেদ, সম্পাদকম-লী মানিক মোহন চন্দ, তুলিকা ঘোষ চৌধুরী, প্রদীপ কুমার পাল, হায়দার আলী, দুলাল মিয়া, আশরাফুজ্জামান বাবলু। সদস্যগণ হলেন- কানন বালা দেবী, আলী আক্কাস মুরাদ, প্রশান্ত, গোলাম সারোয়ার লিটন, বদরুল আমিন রুবেল, মনিকা দাস, হাবিবুর রহমান পল্লব, অমিত বর্মণ, রাজিব দেব, শফিকুল ইসলাম, শহিদুর রহমান, রূপা পাল, শ্রাবন্তী পুরকায়স্থ, অরুণ তালুকদার, সুমন, আবু জাকের প্রিন্স।