স্টাফ রিপোর্টার::
একাত্তরের বীর যোদ্ধা ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ান রচিত ‘একাত্তরে সুনামগঞ্জ: গণহত্যা, নারীনির্যাতন, অগ্নিসংযোগ ও অন্যান্য’ গ্রন্থটি সুনামগঞ্জের মুক্তিযুদ্ধের এক সমৃদ্ধ ক্যানভাস। মহান মুক্তিযুদ্ধের এক ঐতিহাসিক ও অমূল্য দলিল। স্বাধীনতার ৪৫ বছর পর দুর্গম এলাকা ঘুরে ঘুরে সরেজমিন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস গ্রন্থিত করে নতুন প্রজন্মের জন্য একটি মূল্যবান ও ঐতিহাসিক গ্রন্থ উপহার দিয়েছেন লেখক। সামগ্রিক মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে আঞ্চলিক এই মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক গ্রন্থটি বিরাট ভূমিকা রাখবে।
৬ ডিসেম্বর মঙ্গলবার বিকেলে সুনামগঞ্জ মুক্ত দিবসে শহীদ আবুল হোসেন মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন আলোচকবৃন্দ। অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের স্বজনসহ বিভিন্ন পেশাজীবি সংগঠনের লোকজন উপস্থিত ছিলেন।
সুনামকণ্ঠের সম্পাদকম-লীর সভাপতি মো. জিয়াউল হকের সভাপতিত্বে ও সাংবাদিক শামস শামীমের সঞ্চালনায় অনুষ্টানে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন জেলা প্রশাসক শেখ রফিকুল ইসলাম। বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন, পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ, দোয়ারাবাজার উপজেলা চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ ইদ্রিস আলী বীরপ্রতীক, সিনিয়র আইনজীবি ও প্রবীণ রাজনীতিবিদ আফতাব উদ্দিন, বিশিষ্ট লেখক ও অ্যাডভোকেট স্বপন কুমার দেব। অন্যদের মধ্যে গ্রন্থটি নিয়ে আলোচনা করেন দৈনিক সুনামকণ্ঠের সম্পাদক সও প্রকাশক বিজন সেনরায়, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক লেখক হাসান মুরশেদ, সিলেট মহিলা কলেজের সহযোগী অধ্যাপক মো. জিল্লুর রহমান, অ্যাডভোকেট কল্লোল তালুকদার চপল, প্রভাষক এনামুল কবির প্রমুখ।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে জেলা প্রশাসক শেখ রফিকুল ইসলাম বলেন, সুনামগঞ্জের ঐতিহ্য যাদুঘরকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে সমৃদ্ধ করতে এই জেলার চারজন বীরপ্রতীকের উপর ডকুমেন্টারি নির্মিত হয়েছে। যাদুঘরে জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের ভিডিও ও অডিও স্বাক্ষাৎকার সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তাছাড়া জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের ডায়েরি দেওয়া হয়েছে। যাতে তারা নিজেদের মতো মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লিখতে পারেন। যারা পড়ালেখা জানেননা তাদেরকে ডায়েরির শাদা পাতায় হাতের ছাপ দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে। শীঘ্রই এই ডায়েরি আমরা ঐতিহ্য যাদুঘরে সংরক্ষণ করব। যাতে নতুন প্রজন্মের মুক্তিযুদ্ধের গবেষক এই কাজের উপর দাড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে কাজ করতে পারবে। জেলা প্রশাসক বলেন, সুনামগঞ্জের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে বিরাট ভূমিকা রাখবে আবু সুফিয়ানের এই গ্রন্থটি।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ বলেন, আমাদের নতুন প্রজন্ম আমেরিকার রাজনীতি, বিশ্ব রাজনীতি সংস্কৃতি জানে। কিন্তু আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানেনা। দেশে সাংস্কৃতিক দৈন্যতা চলছে উল্লেখ করে উপস্থিতিদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, এখনই নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানানোর উদ্যোগ নিতে হবে। নাহলে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম আরো অন্ধকারে হারিয়ে যাবে। পুলিশ সুপার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চায় সুনামকণ্ঠের সহায়তাকে অভিনন্দন জানান।
অ্যাডভোকেট আফতাব উদ্দিন তার বক্তব্যে উল্লেখ করেন, মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ানের বইটির একটি ঘটনা দ্বারাই আমি বিশ্বাস করি এটি মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ও সমৃদ্ধ একটি গ্রন্থ। কারণ আমার জানা অনেক বিষয় স্বাধীনতার ৪৫ বছর পর তার লেখা বর্ণণার সঙ্গে মিশে গেছে। এতেই প্রমাণীত হয় বইটি বস্তনিষ্ট ও নির্মোহভাবে লেখা হয়েছে।
বিশেষ অতিথি স্বপন কুমার দেব বলেন, মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ানের এই গ্রন্থটি সুনামগঞ্জের আঞ্চলিক মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের একটি প্রায় পূর্ণ ক্যানভাস। এতে সুনামগঞ্জের মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা গুলো ছবির মতো ভেসে ওঠে। এই গ্রন্থে অনেক অজানা বিষয় উঠে এসেছে। এই গ্রন্থটির মাধ্যমে নতুন প্রজন্ম তার শিকড়ের খোজ পাবে। সুনামগঞ্জ মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি ট্রাস্টের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চায় উদাসীনতা ও সাংবিধানিক উদাসীনতার বিষয়টি উল্লেখ করে বলেন, নামে ‘মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি ট্রাস্ট’ থাকলেও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চায় কোন নীতি নেই। সময় এসেছে এই সংবিধান পরিবর্তন করে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চায় উদ্যোগ ও সহায়তা নেওয়ার।
বিশেষ অতিথি অ্যাডভোকেট বজলুল মজিদ চৌধুরী খসরু বলেন, আবু সুফিয়ানের একাত্তরে সুনামগঞ্জ নানা কারণে উল্লেখযোগ্য একটি বিষয়। এখানে যুদ্ধের ঘটনার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের সামাজিক ইতিহাসও উঠে এসেছে। যা এতদিন অনালোচিত ছিল। এগুলোর পুর্ণাঙ্গ ইতিহাসের ক্ষেত্রে সামাজিক বিষয় গুলোও উঠে আসা জরুরি।
বিশেষ আলোচক হাসান মোরশেদ বলেন, যে আমেরিকা মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের বিরোধীতা করেছিল এখন সেই আমেরিকার গবেষণা প্রতিষ্টান ফোর্ট উইলিয়াম কাড়ি কাড়ি টাকা দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনা করিয়েছে শর্মিলা বসুকে দিয়ে। এই ইতিহাসে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও শহীদদের নিয়ে বিকৃত করা হয়েছে। এই বিকৃত ইতিহাসের মোক্ষণ জবাব হলো মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ানের মতো মুক্তিযুদ্ধের আঞ্চলিক ইতিহাসের এসব গ্রন্থ।