হাওর ডেস্ক ::
মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের মধ্যে এইচআইভি’র (এইডস) পর এবার কলেরা রোগের জীবাণু শনাক্ত করেছে স্বাস্থ্য বিভাগ। গত দুই মাসে সাড়ে তিন শতাধিক রোহিঙ্গার কাছ থেকে কলেরা রোগের জীবাণু পাওয়া গেছে। বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকট, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, ঘিঞ্জি শিবিরে গাদাগাদি বসবাসকে দায়ী করছেন শরণার্থী শিবিরে দায়িত্বরত চিকিৎসকরা।
সংশ্লিষ্টদের মতে, গত দুই মাসে কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফে সাড়ে চার শতাধিকের বেশি লোকের কলেরা রোগের জীবাণু শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের মধ্যে সাড়ে তিন শতাধিক রোহিঙ্গা। বাকিরা স্থানীয় লোকজন। এ প্রসঙ্গে কক্সবাজার সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ আবদুল মতিন বলেন, ‘রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে দিন দিন কলেরা রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। গত দুই মাসে তিন শতাধিকের বেশি রোহিঙ্গার কাছে কলেরার জীবাণু পাওয়া গেছে। তবে এখন পর্যন্ত কেউ মারা যায়নি।’
তিনি বলেন, ‘এতে আতঙ্কিত হওয়ার কোনও কারণ নেই। তাদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। শিবিরের লোকজন জলাশয় ও পাহাড়ি ছড়া থেকে পানি সংগ্রহ করে ব্যবহার করায় রোহিঙ্গারা কলেরায় আক্রান্ত হচ্ছে। এছাড়া রোহিঙ্গা শিবির স্থানীয় গ্রামগুলোর পাশাপাশি হওয়ায় তাদের মাঝেও এই রোগ ছড়াচ্ছে।’
আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) একটি চিকিৎসা সংক্রান্ত গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও স্বাস্থ্য বিভাগের দেওয়া তথ্যমতে, কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফে ৩৪ রোহিঙ্গা ক্যাম্পসহ স্থানীয় সাড়ে চার শতাধিকের বেশি লোকের শরীরে কলেরার জীবাণু শনাক্ত করা হয়েছে। রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি স্থানীয়দের নিয়ে কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটি। তবে রোহিঙ্গাদের জন্য লেদা শরাণার্থী শিবিরের একটি ডায়রিয়া ট্রিটমেন্ট সেন্টার রয়েছে আইসিডিডিআরবি’র। তাদের আরেকটি ডায়রিয়া ট্রিটমেন্ট সেন্টার রয়েছে টেকনাফে। তবে সেখানে রোহিঙ্গা রোগী ট্রিটমেন্ট দেওয়া হয়।
ই দুই সেন্টারে গত দুই মাসে প্রায় দেড় হাজারের কাছাকাছি ডায়রিয়া রোগে আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। শুধু লেদা ডায়রিয়া সেন্টারে চলতি মাসের ৯ অক্টোবর থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত আটশ’ ডায়রিয়া রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া হয়। তাদের মধ্যে শতাধিকের কাছ থেকে কলেরা জীবাণু শনাক্ত করা হয়েছে। এছাড়া টেকনাফ সেন্টারে ৩০ জন, বাকি রোগী পাওয়া গেছে শালবাগান ও উখিয়া রোহিঙ্গা শিবিরের। এর মধ্যে পাঁচ বছরের নিচে সাতশ’ শিশু এই রোগে আক্রান্ত।
‘মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গারা সে দেশে স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত ছিল। এ কারণে তারা নানা রোগে আক্রান্ত’ এ কথা বলছিলেন আইসিডিডিআরবি’র লেদা শরণার্থী শিবিরের ডায়রিয়া ট্রিটমেন্ট সেন্টারের চিকিৎসক ডা. জাকারিয়া সেলিম ঈমন। তিনি বলেন, ‘বেশির ভাগই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ ও খাবার থেকে এই রোগে আক্রান্ত। তাদের মানসম্মত খাবার ও বিশুদ্ধ পানি পান করতে হবে। না হলে এই রোগ সব রোহিঙ্গা শিবিরে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এছাড়া রোহিঙ্গা ও স্থানীয়দের বসতি একই পরিবেশের হওয়ায় তাদের মাঝেও এই রোগ ছড়িয়ে পড়ছে। বিশেষ করে শিবিরে গাদাগাদি বসতির ফলে এই রোগে ঝুঁকি আরও বাড়তে পারে।’
টেকনাফ উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. সুমন বড়ুয়া বলেন, ‘প্রতিদিন রোহিঙ্গা শিবির থেকে কলেরা রোগের জীবাণু পাওয়ার খবর আসছে। এনজিও সংস্থাসহ তাদের পাঁচটি টিম সেখানে কাজ করছে। এই রোগে আক্রান্তের সংখ্যা যাতে না বাড়ে সেভাবে ট্রিটমেন্ট দেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গারা যেসব পানি ব্যবহার করছে তা বিশুদ্ধ ও নিরাপদ হতে হবে। না হলে এই রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়বে। পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের নিরাপদ খাবার ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ থেকে দূরে থাকতে হবে।’
স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্মীরা জানান, রোহিঙ্গাদের একটি বড় অংশ অপুষ্টির শিকার। স্বাস্থ্য বিভাগের হিসাবে, অপুষ্টির শিকার বেশির ভাগই রোহিঙ্গা শিশু। তাদের পুষ্টিকর খাবার দেওয়া হচ্ছে। সরেজমিনে দেখা যায়, আইসিডিডিআরবি লেদা ডায়রিয়া ট্রিটমেন্ট সেন্টারে বেশ কিছু রোহিঙ্গা চিকিৎসা নিচ্ছে। এ সময় চার জনের কাছে কলেরা রোগের জীবাণু পাওয়া গেছে। সেখানেই কথা হয় রাখাইনের হাদুরছড়া থেকে পালিয়ে আসা জাহেদা বেগমের সঙ্গে।
লেদা রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের ই-ব্লকে স্বামী ও পাঁচ সন্তান নিয়ে বসবাসকারী জাহেদা বলেন, ‘একটি ছোট ঝুপড়ি ঘরে সাতজনকে থাকতে হচ্ছে। তাদের বেশকিছু দিন ধরে খাবার পানি সংকট ছিল। কাছাকাছি যে টয়লেট রয়েছে সেটিও নষ্ট। এরপর থেকে পরিবারের দু’জনের ডায়রিয়া দেখা দিয়েছে।’
এক বছরের সন্তান সোহেলকে নিয়ে ডায়রিয়া সেন্টারে আসেন হাসিনা বেগম (২৫) নামে এক রোহিঙ্গা নারী। তিনি বলেন, ‘গত দুই দিন ধরে বাচ্চার পাতলা পায়খানা শুরু হয়েছে, এখনও বন্ধ হয়নি। ফলে এখানে চিকিৎসা নিতে এসেছি।’
দীর্ঘদিন পর রোহিঙ্গাদের কারণে এই অঞ্চলে কলেরা রোগের জীবাণু পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন টেকনাফ স্বাস্থ্য বিভাগের চিকিৎসক টিটু চন্দ্র। তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন অর্ধশতাধিক রোগীকে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়। তার মধ্যে অর্ধেক রোহিঙ্গা। তারা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ ও বিশুদ্ধ পানির অভাবে কলেরা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।’ তিনি জানান, রোহিঙ্গাদের জন্য স্থানীয়দের মাঝে এই রোগ ছড়িয়ে পড়ছে। এছাড়া সর্দি, জ্বর, কাশি, ম্যালেরিয়া ও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এ রোগীদের ৭০ ভাগই শিশু।’
স্বাস্থ্য বিভাগ বলছে, ‘চলতি মাসের ৮ ডিসেম্বর থেকে কলেরার টিকা দেওয়া শুরু হবে। এবার কক্সবাজারের ৪ লাখ ৯২ হাজার জনগণ ও দেড় লাখ রোহিঙ্গা শিশুকে এই টিকা দেওয়া হবে। এর আগে গত বছরের নভেম্বরের মাঝামাঝি চতুর্থ রাউন্ডে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে আশ্রিত ৩৪টি ক্যাম্পে কলেরা টিকা খাওয়ানো হয়েছে। তখন কলেরা টিকা পেয়েছেন ২ লাখ ২৪ হাজার ৯৫১ জন। পাশাপাশি রোহিঙ্গা শিবিরের আশপাশে অবস্থিত ১ লাখ ৩ হাজার ৬০৫ জন স্থানীয় জনগোষ্ঠীকেও এই টিকা খাওয়ানো হয়েছিল।’ রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে যাতে কলেরা রোগ না ছড়ায়, সে কারণে ৮ ডিসেম্বর থেকে কলেরার টিকা দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ আবদুল মতিন।