বিশেষ প্রতিনিধি::
ছাতকের সুরুজ আলী (সাধু মিয়া) চেয়ারম্যান ছিলেন সৎ, ত্যাগী, জনদরদী একজন মানুষ। আওয়ামী লীগের জন্মলগ্ন থেকে তিনি আমৃত্যু বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। একজন আদর্শবাদী নেতা হিসেবে তিনি বাঙালির প্রগতিশীল বিভিন্ন আন্দোলনে দেশের পক্ষে কাজ করেছেন। ৫২ এর ভাষা আন্দোলন, ৬৬ এর ছয় দফা থেকে শুরু করে দেশে-বিদেশে বাংলাদেশের জন্য জনমত গড়ে তুলতে সক্রিয় ছিলেন। ৬৮ তে দেশে ছুটি কাটাতে এসে রাজনীতিতে আরও বেশি সক্রিয় হয়ে ১১ নং সিংচাপইড় ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ছাতক উপজেলার আওয়ামী লীগের সদস্য নির্বাচিত হন। ৬৯ সালের আগ পর্যন্ত যুক্তরাজ্য থেকে নিয়মিত দেশে আসা যাওয়া করতেন। রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হওয়ায় উনি আর ইউকে ফিরে যান নি।
শুরু হল ৭০ সালের নির্বাচন। বাঙালির স্বাধীকার ও স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার প্রশ্নে এ নির্বাচন নিয়ে আগ্রহ ছিল দেশ জুড়ে। বঙ্গবন্ধু ঝাপিয়ে পড়েন নির্বাচনী প্রচার অভিযানে। চষে বেড়ান সারাদেশ। আপামর জনসাধারণ আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক অঙ্গীকার ও স্বতঃস্ফূর্ত প্রচার অভিযানে আশার আলো দেখে দিকেদিকে জড়ো হতে থাকে। বঙ্গবন্ধু ছুটে চলেন দেশের আনাচে কানাচে। বাদ পড়ে না দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। বাদ পড়েনি সত্তরের নির্বাচনে সুনামগঞ্জ জেলার ছাতক উপজেলাধীন জাউয়া বাজারও। বঙ্গবন্ধুর মতো অবিসংবাদিত নেতা আমাদের জাউয়া বাজারের মাটিতে পথসভা করে জাউয়া এলাকার মানুষকে গর্বিত করে ইতিহাসের সাক্ষী করেন । আর এই সভাকে সফল করতে অন্যতম সাংগঠনিক ভূমিকা পালন করেন ১১নং সিংচাপইড় ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি সাধু মিয়া চেয়ারম্যান।
হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের ডাক আসে। শুরু হয় মহান মুক্তিযুদ্ধ। উনি ৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে একজন সংগঠকের ভুমিকা পালন করেন। যার ফলে ক্ষুব্ধ রাজাকারেরা উনার পাকা ঘর-বাড়ি সম্পদ জ্বালিয়ে দেওয়াসহ সেদিন প্রায় ২৫ জনকে ধরে নিয়ে যেয়ে ব্রাশ ফায়ারের মুখামুখি করে। মহান আল্লাহর অপার দয়ায় তারা সেদিন বেঁচে যান। বীর মুক্তিযোদ্ধা কমাণ্ডার আছদ্দর আলী, বীর মুক্তিযোদ্ধা কদর আলী, বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হান্নান বশর মিয়া, বীর মুক্তিযোদ্ধা কদরিছ আলী, বীর মুক্তিযোদ্ধা খুর্শিদ আলী, বীর মুক্তিযোদ্ধা আলতাব আলী, বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুর নূর, বীর মুক্তিযোদ্ধা মহেন্দ্র কুমার দাশ বিশ্বাস প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধা একবাক্যে স্বীকার করেছেন, “স্বনামধন্য সাবেক চেয়ারম্যান সুরুজ আলী(সাধু মিয়া) মুক্তিযুদ্ধের সময় ১১ নং সিংচাপইড় ইউনিয়নের সংগ্রাম পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন।”
দেশ স্বাধীন হল। উনি মুক্তিযুদ্ধের একজন সংগঠক এবং একাত্তরে নির্যাতিত পরিবারের সদস্য হিসাবে অচিরেই জনপ্রিয় একজন নেতা হয়ে উঠেন। পরের বছরই বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করতে ঢাকায় যান জাতীয় নেতা আবদুস সামাদ আজাদের সঙ্গে। বঙ্গবন্ধু সাধু মিয়া চেয়ারম্যানের মুখে এই ক্ষয়ক্ষতির কথা শুনে গভীর দুঃখ প্রকাশ করেন এবং মুক্তিযুদ্ধে উনার উনার ত্যাগ ও সক্রিয় ভূমিকার প্রশংসা করেন।
৭৩-৭৪ সালে দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে সমস্ত সহায় সম্পদ মানুষের কল্যাণে জন্য বিতরণ করে দেন তিনি। সুনামগঞ্জের যে কয়জন আওয়ামী লীগের জাতীয় নেতা সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদ, পাঁচ নাম্বার সেক্টরের বেসামরিক উপদেষ্টা এম এন এ আবদুল হক, এডভোকেট রইছ মিয়া এমপি এবং বিলেতে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ডাক্তার হারিছ আলীসহ প্রমুখের সাথে উনার হৃদ্যতা ছিল। আমৃত্যু গভীর আন্তরিক সম্পর্ক ছিল। মানুষের সেবায় সারাজীবন নিজেকে সম্পৃক্ত রাখতে পছন্দ করতেন বলে ৭৪ এর দুর্ভিক্ষে মরহুম আবদুস সামাদ আজাদসহ অত্র অঞ্চলের মানুষকে সাথে নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে ত্রাণ বিতরন করেন।
সাধু মিয়া চেয়্রাম্যান স্পষ্টবাদী, ন্যায়পরায়ণ ও সর্বজন শ্রদ্ধেয় একজন মানুষ ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় ৩০শে আশ্বিন স্থানীয় শান্তি কমিটির উদ্যোগে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সভায় তিনি শান্তি কমিটির ঘৃণ্য কার্যকলাপের তীব্র নিন্দা করেন। এই নিন্দার প্রতিবাদে ২ রা কার্তিক মঙ্গলবার রাজাকার মুজাহিদের সহায়তায় গ্রেফতার করে ডাবর ক্যাম্পে নিয়ে তাকে অকথ্য নির্যাতন করে এবং হত্যা করতে চায়। কিন্তু এক ফৌজির সহায়তায় তিনি সেদিন প্রাণে বেঁচে আসতে সক্ষম হন। এপ্রিল মাসের শেষের দিকে সপরিবারে হত্যার ঘোষণায় তিনি আত্মগোপনে চলে গেলে তাঁর বাড়িতে প্রায় শাতাধিক পাক সৈন্য নিয়ে প্রথমে বাড়ির মালামাল লুট,পাকা বাড়িসহ একটি কার গাড়ী জ্বালানো হয়। উনাদের লাল পাসপোর্ট জ্বালানো হয়। হানাদার বাহিনীর হাতে সুনামগঞ্জের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের মধ্যে এই পরিবার অন্যতম।
দেশ স্বাধীন হলে তিনি হাজার মানুষের শ্রদ্ধা ভালোবাসায় বঙ্গবন্ধুর রিলিফ চেয়ারম্যান হলেন। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর ত্যাগ তিতিক্ষার কথা মনে করে হাজার হাজার মানুষ তাকে প্রকাশ্যে সমর্থন করে। মানুষ ভালোবেসে উনাকে পরবর্তীতে ইউনিয়ন চেয়ারম্যান নির্বাচিত করে। সিংচাপইড় ইউনিয়ন, দেওকাপন ইউনিয়ন, পাণ্ডারগাও ইউনিয়নের কিছু অংশ এলাকা এনে নতুন ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা করেন—জাউয়া বাজার ইউনিয়ন। জাউয়া বাজার ইউনিয়ন পরিষদের তিনি প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান।
০৬-০১- ১৯৭২ সালে তিনি স্বাধীন দেশে যুদ্ধাপরাধী আইনে মামলা করেন। শতাধিক পাঞ্জাবি সৈন্যসহ সুনামগঞ্জের কুখ্যাত শওকত রাজাকার, উজানিগাঁওয়ের ছত্তার রাজাকারকে যুদ্ধাপরাধী আইনে সাজা দেন। তাঁর দায়ের করা মামলায় অনেকেই জেল কাটেন। পারিবারিক এত ক্ষয় ক্ষতি হওয়ার পরও তিনি বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমায় উদ্বুদ্ধ হয়ে মামলা তুলে নেন। এসব দলিল এখনো সংরক্ষিত আছে।
মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, সাদা মনের নিখাদ নির্লোভ জনদরদী দেশপ্রেমিক সাধু মিয়া চেয়ারম্যানকে বিজয়ের মাসে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি।