কল্লোল তালুকদার চপল::
বি-রাজনীতিকরণের এই স্বর্ণযুগে বিলেতফেরত এক সু-উচ্চ শিক্ষিত যুবক রাজনীতিতে হঠাৎ-ই সক্রিয় হলেন। কেবল রাজনীতিতে নয়; তার নাকি রয়েছে শিক্ষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, দর্শন, রূপতত্ত্ব প্রভৃতিতে সুগভীর পাণ্ডিত্য। আমাদের মতো নিম্নবর্গীয় মানুষেরা তার আবির্ভাবে যারপর নাই উদ্বেলিত হলাম। তার মধুর মধুর বাক্যবাণে পুলকিত হলাম। তিনি নূতন নূতন স্লোগান তৈরি করলেন। অতঃপর তিনি বহু ভাবনা-চিন্তা করে শিক্ষা সংস্কারে মনোনিবেশ করলেন এবং বাঁধিয়ে দিলেন এক তুলকালাম কাণ্ড। রীতিমতো মস্ত একটি আবিষ্কার করে বসলেন অল্প দিনের ভিতর। আমরা আবহমানকাল ধরে কী ভয়ঙ্কর জিনিস-ই না করে আসছি! আমাদের কাচ্চা-বাচ্চাকে বর্ণপরিচয় করাতে গিয়ে শেখাচ্ছি ভয়ানক এক প্রাণী অজগরের নাম। ‘অ’ তে ‘অজগর’। তাই তো, কী সাংঘাতিক! আমাদের পূর্বসুরী শিক্ষাবিদগণ কী সাংঘাতিক একটি ভুল করে গেছেন- ভাবতেই যেন ভয়ে গাঁয়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে!
তার এই ভয়াবহ আবিষ্কারে চারদিকে হইচই পড়ে গেল। হরেক রকমের মিডিয়া, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম প্রভৃতিতে ছাপা হতে লাগল তাঁর গুণকীর্তণ। দাবি উঠল- ক্লাস ওয়ানের বই হতে এই কদাকার প্রাণী অজগরকে নির্বাস দেয়ার। মজার ব্যাপার হলো, এই দাবির বহু বৎসর পূর্বেই ক্লাস ওয়ানের বাচ্চাদের অ তে অজগরের পরিবর্তে শেখানো হচ্ছে অ তে অজ (ছাগল)। তার বদলে অজগর জায়গা করে নিয়েছে আরও ছোট ক্লাসে অর্থাৎ প্
রি-প্রাইমারি বাংলা বইয়ে। এই জিকিরকারীদের জিকির শুনি, আর আমাদের মতো সাব-অল্টার্ন এলেবেলে-টাইপ মানুষগুলোর মানসপটে ভেসে ওঠে জর্জ অরওয়েলের ‘অ্যানিমেল ফার্ম’ এর সেই নির্বোধ ভেড়ার পালের মুখ, বুঝে না বুঝে যারা কেবল জিকির তুলতেই জানে।
বাচ্চাদের ক্ষেত্রে বর্ণপরিচয় একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাই সকল দেশে, সকল সমাজে এই বিষয়টিকে আকর্ষণীয় করার চেষ্টা করা হয়। আমাদের দাড়িওয়ালা বুড়ো সেই কবিও শিশুদের জন্য লিখেছিলেন ‘সহজপাঠ’। আধুনিক শিক্ষাবিদগণও এই বিষয়টিকে দেখেন অতি গুরুত্বের সঙ্গে। একটি শিশুকে আকর্ষণীয় ও সহজভাবে বর্ণপরিচয় করানোটাই মূল লক্ষ্য। তাই এক্ষেত্রে বেছে নেওয়া হয় সহজ, আকর্ষণীয়, আগ্রহোদ্দীপক এবং দৃশ্যমান কোনো প্রপঞ্চকে। তাই সেই সুপ্রাচীনকাল থেকেই tangible কোনো কিছুকে নির্বাচন করা হচ্ছে। জটিল ও বিমূর্ত (Abstract/intangible) বিষয়কে তাই এক্ষেত্রে পরিহার করা হয় সচেতনভাবে। তাই দেখি ইংরাজিতে শেখানো হয় – A for Ant. কখনও-ই শেখানো হয় না A for Amazing বা Awesome. পিঁপড়া কুশ্রী, বিষাক্ত বলে শিক্ষাবিদগণ A for Ant বাতিল করে দেন না।
অজগর একটি সহজ সরল শব্দ। এতে নেই কোনো যুক্তবর্ণ, নেই কোনো ‘কার’ এর ব্যবহার। আছে কেবল অ জ গ র – এই চারটি বর্ণ। কিন্তু অপরদিকে ‘অপূর্ব’ শব্দটি যদি আমরা একটি শিশুকে তার শিক্ষাজীবনের প্রথম শব্দ হিসেবে দিতে চাই, তবে পড়ার প্রতি সেই শিশুটির মনে ভীতি সৃষ্টি হওয়ার রয়েছে সমূহ সম্ভাবনা। সর্বোপরি মূর্ত এবং বিমূর্তের দ্বন্দ্ব তো থেকেই গেল। নন-ভেনামাস সরিসৃপ ‘অজগর’ নামক সুন্দর এই প্রাণীটির রয়ছে একটি সুনির্দিষ্ট রূপ। একে দেখা যায়। স্পর্শ করা যায়। নিদেন পক্ষে একটি মডেল বা ছবি দেখিয়ে শিশুকে বলা যায়, এই যে বাবু, দেখ- এটি হলো অজগর। অপরদিকে একটি শিশু যদি ‘অপূর্ব’ জিনিসটা কি তা দেখার বায়না ধরে, তখন কীভাবে তা তাকে দেখানো হবে? এই অবয়বহীন ‘অপূর্ব’ শব্দটি একটি পরিণত মানুষের জন্য যত সহজ, তেমনি একটি শিশুর কাছে তা বহুগুণ জটিল একটি বিষয়।
আমাদের সেই যুবনেতার (যুবরাজও বলা যায়!) যুক্তি – অজগর নাকি খুব ভয়ঙ্কর একটি প্রাণী। তাই তা শিশুদের শেখানো যাবে না। কিন্তু পাঠ্যপুস্তকে এই অজগর বা পিপীলিকার ছবি দেখে বাচ্চারা কি ভয় পায়? নাকি রোমাঞ্চিত হয়?
Samuel Taylor Coleridge এর ‘The Rime of the Ancient Mariner’ ছাত্রজীবনে আমাদের পাঠ্য ছিল। সৌভাগ্যের প্রতীক Albatross পাখিকে হত্যার পর কীভাবে সেই অভিশপ্ত নাবিকটি অভিশাপ মুক্ত হয়েছিল, তা নিশ্চই আমাদের সকলেরই মনে আছে। এই রাইমের মৌলিক শিক্ষাটিও নিশ্চই আমরা ভুলে যাইনি,
“He prayeth best, who loveth best
All things both great and small;
For the dear God who loveth us,
He made and loveth all.”
তবে কেন আমরা আামদের শিশুর মনে শুরুতেই প্রাণীজগতের প্রতি ঘৃণার বীজ বপন করে দেবো? তার বদলে প্রাণীবৈচিত্র্য সম্পর্কে তার আগ্রহ এবং ভালোবাসা সৃষ্টিতে উৎসাহ দেওয়া কি সমীচীন নয়?
‘অ তে অজগর নয়, অ তে অপূর্ব বাংলাদেশ’ – এই দাবি কতটুকু যৌক্তিক? একি কেবল সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জনের প্রচেষ্টা? চটকদার বাকবাকুম? নাকি অগভীর চিন্তাপ্রসূত একটি একদেশদর্শী ভাবনা? নাকি সেরেফ স্ট্যান্টবাজী? ভেবে কূলকিনারা পাই না!
আমাদের সেই উচ্চ শিক্ষিত নাজিল হওয়া নেতাদের মনে অজগর নিয়ে কিসের এতো ভীতি? আমার এই শিশুসুলভ প্রশ্নের উত্তরে এক বিদগ্ধ কবির উত্তর, “আসলে তেনারা অজগরকে পাঠ্যবই থেকে নির্বাসিত করতে চান অন্য এক গুহ্য কারণে। প্রকৃত অজগর তো আমাদের দেশ থেকে কবেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তাই আমাদের বাচ্চাদের অজগরের সঙ্গে চিরিয়াখানা ছাড়া দেখা হওয়ার ক্ষীণ সম্ভাবনাও নাই। কিন্তু বনের অজগর বিলুপ্ত হলে কী হবে, তার চেয়েও ভয়ঙ্কর অজগরে পরিণত হয়েছেন আমাদের সেই নাজিল হওয়া নেতাগণ। তাদের সর্বগ্রাসী রূপের সঙ্গে যদি শিশুরা প্রকৃত অজগরের সাদৃশ্য খুঁজে পায়, যদি তাদের মুখোশ উন্মোচিত হয়ে পড়ে- সেই কারণে অজগর শব্দটিকেই বাতিল করে দিতে হবে চিরতরে।”
ধরণী দ্বিধা হও! আমরা মনুষ্যরূপী অপূর্ব অজগর চাই না। আমাদের সেই প্রাকৃতিক অজগর-ই ফিরিয়ে দাও…
লেখক, গবেষক ও আইনজীবি।