হাওর ডেস্ক ::
আজ ১৪ মার্চ। ঊনবিংশ শতকের শ্রেষ্ঠ দার্শনিক, মার্কসবাদের প্রবক্তা কার্ল মার্কস-এর ১৩৭ তম মৃত্যুবার্ষিকী। মার্কস ১৮১৮ সালের ৫ই মে তৎকালীন প্রাশিয়ার ত্রিভস (ত্রিয়ের) শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা হার্শেল মার্কস পেশায় ছিলেন একজন অ্যাডভোকেট।
বন ও বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন, দর্শন এবং ইতিহাসের পাঠ সমাপ্ত করে মার্কস যোগ দেন রাইনল্যান্ডের র্যাডিকাল যুবকদের দ্বারা পরিচালিত ‘রাইন অঞ্চলের সংবাদপত্র’ নামক পত্রিকায়। ১৮৪২ সালের অক্টোবর মাসে তিনি এর সম্পাদক হন। সম্পাদক হিসাবে যোগ দেয়ার পর থেকেই মার্কস-এর ক্ষুরধার লেখনীর জোড়ে কাগজের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর উত্তর উত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে। কয়েক মাসের মধ্যেই সরকারি রোষানলে পড়ে কাগজের অফিস বন্ধ হয়ে যায়। এই সময় মার্কস অর্থশাস্ত্রের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং তার পাঠ নেয়া শুরু করেন।
১৮৪৩ সালের ১৯-এ জুন জেনির সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ হন কার্ল। জেনি ছিলেন একজন বিখ্যাত ব্যারনের কন্যা। এরপর তারা চলে আসেন প্যারিস-এ। প্যারিস থেকেই শুরু হয় অপরিসীম দারিদ্র্য ও ইউরোপীয় রাষ্ট্রশক্তির প্রবল বাধার মুখে দাঁড়িয়ে তাদের লড়াই, যা জীবনের শেষ দিন অবধি ছিল তাদের নিত্যসঙ্গী। এই সংগ্রামে মার্কস এবং জেনির পাশে এসে দাঁড়ান তাদের অকৃত্রিম বন্ধু কমরেড ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস। ১৮৪৫ সালে প্রাশিয়ান সরকার মার্কসকে তার পরিবারহস প্যারিস থেকে নির্বাসিত করে। তারা চলে যান ব্রাসেলস-এ।
১৮৪৭ সালে মার্কস এবং এঙ্গেলস যোগ দেন কম্যুনিস্ট লীগে। সে বছরের নভেম্বর মাসে লিগের দ্বিতীয় সাধারণ সম্মেলনে ফ্রেডরিখ এঙ্গেলসের সঙ্গে কার্ল মার্কস যৌথভাবে রচনা করেন শ্রমিকশ্রেণির অমোঘ হাতিয়ার ‘কম্যুনিস্ট ইস্তাহার’। এতে তারা দেখান যে ‘রাজনৈতিক ক্ষমতা হচ্ছে অপর এক শ্রেণিকে দমন করার জন্য এক শ্রেণির হাতে সংগঠিত ক্ষমতা’। ১৮৪৮ সালে প্রকাশিত এই ছোট্ট পুস্তিকা গোটা ইউরোপে আলোড়ন তোলে।
১৮৪৮ সালে জার্মানি এবং অস্ট্রিয়াতে বুর্জোয়া বিপ্লব শুরু হলে মার্কসকে বেলজিয়াম থেকে বিতাড়িত করা হয়। সেখান থেকে প্যারিসের বুর্জোয়া বিপ্লবের ঝড় ঝাপটা পেরিয়ে সপরিবারে মার্কস পৌঁছন জার্মানির কোলোন শহরে। সেখানে তিনি ‘রাইন অঞ্চলের নতুন সংবাদপত্র’ নামে একটা পত্রিকার সম্পাদনা শুরু করেন। তবে খুব বেশী দিন নয়। প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির হাতে আবার তাকে বেছে নিতে হয় নির্বাসিতের জীবন। মার্কসরা চলে যান প্যারিসে, সেখান থেকে আবার নির্বাসিত হয়ে লন্ডনে। বাকি জীবন তাদের সেখানেই কাটে।
১৮৬৪ সালে মার্কস এবং এঙ্গেলস তৈরি করেন শ্রমজীবী মানুষের আন্তর্জাতিক সংঘ। প্রথম আন্তর্জাতিক নামেই এই সংগঠন প্রসিদ্ধ। ১৮৭১ সালে প্রথম আন্তর্জাতিকের ফরাসি বিপ্লবীরা প্রতিষ্ঠা করেন প্যারিস কম্যুন। কম্যুনার্ডদের হঠকারী সিদ্ধান্তের সাথে মার্কস-এঙ্গেলস একমত না হলেও, তারা তাকে স্বীকৃতি জানাতে ভোলেননি। খুব বেশীদিন টেকেনি এই সংগঠন। ১৮৭২ সালে হেগ সম্মেলনে রুশ নৈরাজ্যবাদী নেতা বাকুনিনের সাথে মার্কস-এর প্রবল বিতর্ক হয় এবং বাকুনিন বিতাড়িত হন। বাকুনিনপন্থীদের হাত থেকে সংগঠনকে বাঁচাতে আন্তর্জাতিকের কার্যালয় স্থানান্তরিত করা হয় আমেরিকার নিউইয়র্কে। ১৮৭৬-এর ফিলাদেলফিয়া সম্মেলনের পর প্রথম আন্তর্জাতিকের পতন ঘটে—শেষ হয় শ্রমিক আন্দোলনের এক বৈচিত্র্যময় অধ্যায়।
মার্কস ও জেনি মোট ছয় সন্তানের জন্ম দেন—জেনি ক্যারোলিন(১৮৪৪-১৮৮৩), জেনি লরা (১৮৪৫-১৯১১), এডগার (১৮৪৭-১৮৫৫), হেনরি এডওয়ার্ড গাই (১৮৪৯-১৮৫০), জেনিইভলিন ফ্রান্সেস (১৮৫১-১৮৫২), জেনি জুলিয়া এলিনর (১৮৫৫-১৮৯৮)। এছাড়াও আরও একটা পুত্র সন্তান তাদের হয়েছিল, যদিও সে পর্যাপ্ত খাদ্য না পেয়ে জন্মের এক সপ্তাহ পরেই মারা যায়।
মৃত্যুর আগে কার্যত মার্কসের কোনো দেশ ছিল না! প্রায় ১৫ মাসের দুরারোগ্য ব্যাধীতে ভুগে এই মহান শিক্ষাগুরুর ১৮৮৩ সালের ১৪ মার্চ লন্ডনে মহাপ্রয়াণ ঘটে। তাঁর মৃত্যুপরবর্তীকালে শোক জানানোর জন্যও জড় হয়েছিল মাত্র জনা দশ-পনের মানুষ। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর অনেক পরে বিশেষত রাশিয়াতে শ্রমিক শ্রেণির বলশেভিক পার্টি ক্ষমতা দখল করার পর বিশ্বে নতুন এক সমাজতান্ত্রিক দেশের অভ্যুদয়ের পর বিশ্ব নতুন করে কার্ল মার্কসকে জাজ্বল্যমান করে তোলে।
কার্ল মার্কসের স্মরণ অনুষ্ঠানে অকৃত্তিম বন্ধু ফ্রেডারিক এঙ্গেলস বলেছিলেন, “১৪ মার্চ বিকেল ঠিক পৌণে তিনটায় বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ট জীবিত চিন্তাবিদ চিন্তা থেকে বিরত হয়েছেন । মাত্র মিনিট দুয়েকের জন্যে তাঁকে একা রেখে অন্যত্র গিয়েছিলাম আমরা । ফিরে এসে দেখলাম, নিজস্ব আর্মচেয়ারটাতে শান্তিতে ঘুমিয়ে আছেন তিনি, ঘুমিয়ে আছেন চিরদিনের মতো ।”