(আমি কোন অণুজীব গবেষক নই, তারপরও গুজব ও মিথ্যা তথ্যের ছড়াছড়িতে সাধারণদের সহজভাবে জানাতে ও সচেতন করতে উদ্ভিদবিদ্যার শিক্ষার্থী ও শিক্ষক হিসেবে এই প্রচেষ্টা। যেহেতু অণুজীববিদ্যা অামাদের পড়তে হয়েছে ও শিক্ষার্থীদেরও পড়াতে হয়। দয়া করে সবাই একটু পড়বেন, উপকার হতেও পারে!)
—
প্রথমেই অামরা জেনে নিই ভাইরাস কী?
– ভাইরাস হল নিউক্লিক অ্যাসিড ও প্রোটিন দিয়ে গঠিত একপ্রকার অতি অাণুবীক্ষণীক অকোষীয় রোগ জীবাণু যা জীবকোষের ভেতরে সক্রিয় হয়ে সংখ্যাবৃদ্ধি ও রোগ সৃষ্টি করে কিন্তু জীবকোষের বাইরে জড় বা মৃত কোষের ন্যায় নিস্ক্রিয় অবস্থায় থাকে।
* এ থেকে বোঝা যায় যেকোন ভাইরাসের সক্রিয় হতে হলে জীবকোষ লাগবে। জীবকোষ ছাড়া ভাইরাস বিস্তার লাভ করতে পারেনা এবং জীবকোষে প্রবেশের জন্য তার ছিদ্রপথ অবশ্যই লাগবে।যেমন, নাক, মুখ,চোখ প্রভৃতি।
তাহলে জীবকোষের ছিদ্রগুলো হেফাজতে রাখতে পারলেই ভাইরাস প্রবেশের সুযোগ পাবেনা।
– ভাইরাসের দেহ সাধারণভাবে নিউক্লিক অ্যাসিড ও ক্যাপসিড দিয়ে গঠিত থাকে। দেহের কেন্দ্রে অবস্থান করে নিউক্লিক অ্যাসিড অার নিউক্লিক অ্যাসিডকে ঘিরে অবস্থিত প্রোটিন অাবরণটির নাম ক্যাপসিড। ক্যাপসিডের অাবরণের একটি প্রোটিন অণুকে বলা হয় ক্যাপসোমিয়ার। এই ক্যাপসোমিয়ার নির্দিষ্ট ভাইরাসে নির্দিষ্ট ধরনের। এ ক্যাপসিড জৈবিক দিক দিয়ে নিস্ক্রিয় তবে নিউক্লিক অ্যাসিডকে রক্ষা করে ও পোষকদেহে( Host) সংক্রমণে সাহায্য করে।
* সাধারণ সর্দি জ্বরে এটিই মানুষের মধ্যে হাঁচির উদ্রেক করে।
-ক্যাপসিডের বাইরে কোন কোন ভাইরাসে (যেমন,ইনফ্লুয়েঞ্জা, হার্পিস,এইচঅাইভি) বিভিন্ন জৈব পদার্থের একটি অাবরণ দেখা যায়। এ অাবরণটি সাধারণত লিপিড, লিপোপ্রোটিন,শর্করা বা স্নেহ জাতীয় পদার্থ দিয়ে তৈরি।
* সেজন্য সাবানের ক্ষার ভাইরাসের দেহকে ভাঙ্গতে সাহায্য করে বেশি।তাই সাবান দিয়ে হাত ধোয়াই উত্তম।
– ভাইরাসের নিউক্লিক অ্যাসিড দু ধরনের। অন্যান্য জীবদেহে এই নিউক্লিক অ্যাসিড DNA ও RNA একসাথে অবস্থান করলেও এক দুটি ব্যতিক্রম ছাড়া ভাইরাসে DNA ও RNA একসাথে অবস্থান করেনা।
DNAকে বলা হয় প্রাণী ভাইরাস ও ব্যাকটেরিওফায ভাইরাস এবং RNAকে বলা হয় উদ্ভিদ ভাইরাস।
— বর্তমানে মহামারী ধারণ করা ভাইরাসটি একটি RNA(রিবোনিউক্লিক অ্যাসিড) ভাইরাস।
– দেখা যায় যে ভাইরাসগুলো অারএনএ দিয়ে তৈরি তারাই খারাপ চরিত্রের হয়ে থাকে। যেমন, HIV, HEPATITIS C, RABIES,EBOLA,DENGUE ইত্যাদি। সম্প্রতি এই দলে যোগ হয়েছে করোনা ভাইরাস।
– করোনা ভাইরাসের স্ট্রাকচার দিয়েই এর নামকরণ করা হয়েছে। এদের গায়ে চারদিকে ব্যাঙের ছাতার মতো Halo(Corona) সাজানো থাকে।এর ভেতরে একটি Single Stranded RNAথাকে। এর দুটি সাবটাইপ অাছে 229E এবং OC43। এটি ল্যাটিন শব্দ করোনা থেকে নেয়া যার অর্থ মুকুট।
ভাইরাসের প্রোটিন সংক্রমিত হওয়া টিস্যু নষ্ট করে।ধারণা করা হয় প্রাণীর দেহ থেকে এই ভাইরাস প্রথম মানবদেহে প্রবেশ করে।
– ১৯৬০ এর দশকে প্রথম করোনা ভাইরাস অাবিষ্কৃত হয়। প্রথমদিকে মুরগির মধ্যে সংক্রামক ব্রঙ্কাইটিস ভাইরাস হিসেবে দেখা যায়। পরে সাধারণ সর্দি, হাঁচি, কাশিতে অাক্রান্ত রোগীদের মধ্যে দু ধরনের ভাইরাস পাওয়া গেছে। বিভিন্ন সময় ভাইরাসটির বেশ কিছু প্রজাতি পাওয়া যায়, এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ২০০৩সালে SARS COV, ২০০৪সালে H COVNL63, ২০১২সালে MARS COV এবং সর্বশেষ ২০১৯ সালে চীনে নোভেল করোনা ভাইরাস।
* করোনা ভাইরাসটি ভয়ঙ্কর যেজন্য তা হল অতি দ্রুত এর জিন মিউটেশন ঘটছে। হিউম্যান প্যাথোজেনিক ভাইরাসের সংক্রমণজনিত অসুখের গবেষক ইন্দ্রনীল বন্দোপাধ্যায় বলেন, এত কম সময়ের মধ্যে ঘন ঘন জিন মিউটেশন করে নিজের চরিত্র বদলে ফেলেছে এ ভাইরাস।তার দাবি, নোভেল করোনা ভাইরাসের জিনোম ( জিনের বিন্যাসগত সিকোয়েন্স) বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে এরই মাঝে এর মধ্যকার ২৭টি ভাইরাল প্রোটিনের রাসায়নিক বদল হয়েছে এবং ৩৮০বার জিনের গঠন বদলে গেছে।
– সাধারণ ফ্লু যখন মহামারী হয় তার মধ্যে এক অাধটা ভাইরাল প্রোটিনের বদল ঘটে, যাকে বলে পয়েন্ট মিউটেশন, অর্থাৎ সিঙ্গেল অ্যামাইনো অ্যাসিডের বদল।
* কিন্তু করোনার মধ্যে সে পরিবর্তন লাগাম ছাড়া। এত বেশি জিন মিউটেশন( গঠন বদল) এর ফলে করোনা ভাইরাসের প্রকৃত চরিত্র ও রাসায়নিক গঠন বিজ্ঞানীদের কাছে অধরা হয়ে পড়ছে!
RNAভাইরাসের মধ্যে সবচেয়ে বড় হওয়ায় এটি ভূপৃষ্ঠতলেই অবস্থান করে। বাতাসের স্পর্শে অথবা সংক্রমিত ব্যক্তির হাঁচি, কাশিতে মুক্ত হয়ে বাতাসের স্পর্শে এলে সুস্থ মানুষের নাক,মুখ,চোখ দিয়ে প্রবেশ করে মিউকাস মেমব্রেনের ( স্তন্যপায়ী প্রাণীর শ্বাসতন্ত্র বা পৌষ্টিকতন্ত্র হতে পিচ্ছিল নি:সরণ) কোষ হয়ে রিসেপ্টর বা গ্রাহক অাক্রান্ত কোষ একসময় ফেটে গিয়ে অাশপাশের কোষকে অাক্রমণ করে। এই পরিস্থিতিতে উপসর্গ হিসেবে গলাব্যথা ও কাশির মতো লক্ষণ দেখা যায়।
এরপর ব্রঙ্কিউল টিউবে ছড়িয়ে পড়ার পর একসময় সেই ভাইরাস ফুসফুসে পৌঁছায়। মিউকাস মেমব্রেনের প্রদাহ তৈরি করে ফুসফুসের থলিগুলির ক্ষতি করে। একসময় ফুসফুসের স্থিতিস্থাপকতা নষ্ট হলে সারা শরীরে অক্সিজেন সরবরাহ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এভাবে শ্বাস কষ্টে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে!
করণীয়: যেহেতু জীবপোষক( Host) ছাড়া ভাইরাস নিস্ক্রিয় তাই তা যেন দেহে প্রবেশ করতে না পারে তার জন্য সচেতন হতে হবে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকা, মাস্ক ব্যবহার করা, হাত সাবান দিয়ে ধোয়া, মাস্ক ব্যবহারের পরপর সাবান দিয়ে ধুতে হবে। অাক্রান্ত অাছে বা সন্দেহজনক ব্যক্তি বা এলাকা এড়িয়ে চলতে হবে।
যেহতু কিছু বিশেষজ্ঞদের মতামত অাছে ৩০ডিগ্রি সে: এর ওপরে তাপমাত্রা থাকলে এ ভাইরাসের ক্ষমতা কমে যায় তাই ধৈর্য ধরে রোদ্র তাপের অপেক্ষায় সংগ নিরোধ পন্থা মেনে চলতে হবে।
* তবে অামার ব্যক্তিগত মত হল, যাদের অাগে থেকেই শ্বাসতন্ত্রে সমস্যা অাছে, যাদের সর্দি কাশি লেগেই থাকে, যাদের ডায়াবেটিকস এর মত রোগ অাছে তাদের উচিত বিশেষজ্ঞ ডা:এর পরামর্শ নিয়ে এগুলো নিয়ন্ত্রণ বা নির্মূল করা। কারণ রোগাক্রান্ত ব্যক্তির রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে।
যেহেতু দু সপ্তাহ ধরে ভুগে টিকে থাকতে পারলে মুক্তি মিলে সেহেতু রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে পারলে ভাল। সেজন্য নিয়মিত ব্যায়াম বা কায়িক শ্রম করা, রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এমন ভেষজ উদ্ভিদ খাওয়া যেতে পারে।
ভিটামিন এ,সি, বি, কে সমৃদ্ধ ফলমূল, শাক সব্জি পরিমিত খেতে হবে।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভাল থাকলে তেমন রিস্ক নেই।
তাই গুজব ও মিথ্যে তথ্যে কান না দিয়ে সচেতনতা ও সম্মিলিত প্রচেষ্টাই পারে এ ধরনের দুর্যোগ থেকে রক্ষা করতে।
যতই জিন মিউটেশন ঘটুক একসময় তার স্থিরতা অাসবে অথবা কার্যক্ষমতা কমে অাসবে। যেহেতু জিন চরিত্র এক অাজব রহস্য, তাই যেকোন সময় রহস্য উন্মোচন হয়ে অামাদের কাছে চলে অাসবে দ্রুতই তার এন্টিভাইরাস।
সে সুদিনের প্রত্যাশায় চলুন অামরা সবাই পরস্পর সজাগ থাকি।
[সহায়ক তথ্য সূত্র: International committee on Taxonomy of Viruses( 24 August, 2010), Microbiolgy and Immunology wiley online library, অানন্দবাজার পত্রিকা, উইকিপিডিয়া ]
লেখক: প্রভাষক, উদ্ভিদবিদ্যা,বৃন্দাবন সরকারি কলেজ, হবিগঞ্জ।