সময়টা ছিল ১৯৭১’র উত্তাল মার্চ। বঙ্গবন্ধুর ভাষন শেষ। চারিদিকে বাংলার আপামর মানুষের রক্ত স্বাধীনতার স্বপ্নে বিভোর আবার অপরদিকে পাকিস্তানের আশীর্বাদপুষ্ট এদেশীয় শকুনের বাচ্চারা তাদের স্বার্থসিদ্ধি নিয়েও তারা বিভোর।এই অরাজক অবস্থায় হাওরের মাঝে জ্বীয়ে উঠেছিলো কালাই গং[আব্দুল খালিক(দৌলতপুর),শরাফত আলী(সুলতানপুর),কালা মিয়া চৌধুরী(মনুয়া),হাশিম মোড়ল(কান্দিগাঁও),খলিল উল্লা(চব্বিশা),নুর মিয়া(মোহাম্মদ নগর),এলিম উদ্দীন(উজানগাঁও)শাল্লা শান্তি কমিটি পৃ:-১৮২,রক্তাক্ত ৭১সুনামগঞ্জ]।
এই শকুনের বাচ্চাদের পাকিস্তানিরা ভাতা বাবদ মূল্য ধারন করেছিলো ১৫০ রুপি (টাকা)। যেখানে প্রতি ভরি স্বর্নের দাম নির্ধারণ ছিলো ৯০ রুপি(টাকা)। তারমানে ধারনা করা যায় টাকার মূল্য কতোটুকু ছিলো ?
এমতাবস্থায় নিদারুন আর্থিক সংকটের মুখে বাধ্য হয়ে,চাকুরী জীবনের শেষ সম্বল কষ্টার্জিত পেনশনের টাকা উত্তোলনের জন্যে ইস্টার্ন মার্কেন্টাইল ব্যাংক(পূবালী ব্যাংক) সুনামগঞ্জে আসলে শান্তিকমিটি,রাজাকার আলবদরগং তাঁকে সুকৌশলে ধরিয়ে দেয় পাক সেনাদের হাতে; যাকে ৭১এর উত্তাল মার্চে সুনামগঞ্জের সর্বদলীয় সংগ্রামপ্রিয় নেতাকর্মীরা স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে গড়ে উঠা ইস্পাত কঠিন ঐক্যকে আরো বেগবান করার লক্ষ্যে এবং পাকিস্তানের সুশিক্ষিত ইয়াহিয়া বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্যে নানা কর্মসূচীর মধ্যে ছাত্রদের যুদ্ধ প্রশিক্ষনে যে দুজন নিয়োজিত হয়েছিলেন তাদের মধ্যে একজন হলেন শাল্লার কৃতি সন্তান আটগাঁও গ্রামের অধিবাসী মতিউর রহমান চৌধুরী।
পিতার নাম স্নোহর চৌধুরীর। স্নোহর চৌধুরীর ৬ পুত্র সন্তানের মাঝে ২য় মতিউর রহমান চৌধুরী ও ৬ষ্ঠ তম মহিবুর রহমান চৌধুরী হচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধা। উনার বড় ভাই পুত্র আইনজীবি শহীদুজ্জামান সাহেবকে মতিউর রহমান সম্পর্কে জন্ম তারিখ জানতে প্রশ্ন করলে উনি বলেন ঠিক সঠিক ভাবে এই মুহুর্তে জন্ম তারিখটা মনে নেই তবে চাচা ২০১২ সালের মে মাসে আনুমানিক ১০০ বৎসর বয়সে মারা যান।
আরো জানা যায় ১৯৭৩ সালে যখন মেজর মোতালিব শাল্লা অঞ্চলে নির্বাচন করেন তখন মতিউর রহমান চৌধুরী নির্বাচনী প্রচার প্রচারনায় কাজ করেছেন তাছাড়া ৭৪ এর বন্যার পর আস্তে ধীরে নেত্রকোনার মোহনগঞ্জের অধিবাসি হন। পারিবারিক জীবন স্বাচ্ছন্দে শ্বশুর বাড়িরসূত্রে ঐখানে আরো আগ থেকেই উনি বসতভিটা গড়ে তুলেছিলেন।
সুনামগঞ্জে তাঁকে পাক সেনাদের হাতে ধরানোর পরে কয়েকদিন ইন্টারগেশন করে পাঠিয়ে দেওয়া হয় সিলেট সেনা ক্যাম্পে অত:পর ব্রিগেড-হেড কোয়াটার শ্রীমঙ্গলে।সেখানে জাদরেল সামরিক অফিসাররা তাঁকে ব্যাপক ইন্টারগেশন করে সন্তুষ্ট হতে না পেরে চাকুরি দিয়ে সরাসরি পাকিস্তান পাঠিয়ে দেবার প্রস্তাব দেয়। সে প্রস্তাবে সায় না পাওয়ায় পাক সেনারা পুনর্বার তাঁকে পাঠিয়ে দেয় সিলেট কারাগারে।
মতিউর রহমান চৌধুরী ১৯৩৮ সালে বানিয়াচং উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মেট্রিক পাশ করেন। তিনি ছিলেন বৃন্দাবন কলেজের প্রথম ব্যাচের ছাত্র। ১৯৪২ সালে দিরাই থানার বাউশি এম-ই স্কুলে কিছু দিন শিক্ষকতা করেন। শিক্ষকতার পর সুনামগঞ্জ মহকুমায় ঋন শালিসি বোর্ডে নকল নবিশ পদে চাকুরি নেন। এক বছর চাকুরি করার পর ১৯৪৩ সালে তিনি ইন্ডিয়ান এয়ারফোর্সে যোগদানের লক্ষ্যে লাহোরের ওয়াল্টনে প্রশিক্ষন গ্রহনে যান এবং বিমান বাহিনীর ওয়ারেন্ট অফিসার হিসেবে যোগদান করেন।
চাকুরি থেকে অবসর নিয়ে মতিউর রহমান চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষন পর্বের কাজটি হাতে নেন। প্রস্তুতি পর্বে রয়েছে নাটকীয় কাহিনী। তথ্যমতে তিনি স্মৃতিচারন করে বলেন ২৮ শে মার্চ ১৯৭১ সাল সকাল ১১টায় হাছননগরের ময়নার পয়েন্টে সুনামগঞ্জ আক্রমণকারী ক্যাপ্টেন মাহবুবের সাথে দেখা হয়।
পরে খোঁজনিয়ে আনুমানিক ২টার দিকে মতিউর রহমান চৌধুরীর হাছন নগরের কুরিয়ার-পারস্থ বাস ভবনে ক্যাপ্টেন মাহবুব দুজন সৈন্য নিয়ে হঠাৎ করে প্রবেশ করে।
বাস ভবনে একান্ত আলাপে মতিউর রহমান চৌধুরীর বাঙ্গালী হয়ে বাঙ্গালীর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরার জন্য মাহবুবকে মারাত্মক ভাবে শাসিয়ে বিদায় করে দেন। কিন্তু প্রস্থান কালে মাহবুব গং দেখতে পায় তাঁর(মতিউর) বাসগৃহে ঝুলানো রয়েছে বঙ্গবন্ধুর ছবি। ফলে তারা বিষন্ন,চিন্তিত ও ক্রোধান্বিত হয়ে বিদায় নেন।
(উল্লেখ্য- ক্যাপ্টেন মাহবুব বাঙ্গালী পাক সেনা কমান্ডার,বৃহত্তর বরিশালে জন্ম। সে ১১ জন পাক সেনা নিয়ে ২৭ মার্চ’৭১ এর সন্ধ্যায় সুনামগঞ্জ দখল করেছিল। চাকুরীসূত্রে তার পাকিস্তানেই পরিচয় হয়েছিল বয়সের ব্যবধানে মতিউর রহমানকে ভাই ডাকতো। পরে বিমান বাহিনী থেকে সেনাবাহিনীতে ক্যাপ্টেন হিসেবে পদোন্নতি নেন)
২৯ মার্চ নিরস্ত্র ছাত্র জনতা,ইপিআর ও আনসারদের প্রতিরোধের মুখে মাহবুব বাহিনী সুনামগঞ্জ থেকে বিতাড়িত হয়ে সিলেট পাক আর্মি ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়।তথ্যানুসারে এম আর চৌধুরী আরো বলেন- আমি যতোদূর জানি, সিলেট প্রত্যাবর্তনের পর পরাজিত হয়ে ফিরে যাওয়ার কারনে সঙ্গীয় সিনিয়র সেনা অফিসাররা তাকে হত্যা করে। তবে উনার ভাতিজা অ্যাডভোকেট শহীদুজ্জামান (২৫/০২/২০) বলেন ১৯৯৮ সালে হঠাৎ আমি (সম্ভবতো জনকন্ঠ রিপোর্টস) জানতে পারি- ক্যাপ্টেন মাহবুবকে হত্যা করা হয়নি,উনাকে পাকিস্তানে তখন যুদ্ধবন্ধীস্থায় রাখা হয়েছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে দেশে এসে চাকুরীও করেছেন,পেনশন নিয়েছেন । শুনেছি বর্তমানে আমেরিকাতে থাকেন। ১৯৯৮ সালে এ খবর চাচাকে জানানোর পর আমি চাচাকে নিয়ে বেশ কয়েকবার চেষ্টা করছিলাম তার সাথে দেখা করে চাচাকে না মারার ও আমার নিক্ষিপ্ত নিষ্ঠীবন জানানোর জন্য।
কারন চাচা মতিউর রহমানকে যেভাবে পাঞ্জাবি সেনারা ধরে ইন্টারগেশন করে সুনামগঞ্জ থেকে সিলেট, সিলেট থেকে শ্রীমঙ্গল আবার শ্রীমঙ্গল থেকে সিলেটে এমনকি পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেয়ার পায়তারা করেছিলো তারা এমন না করে সুনামগঞ্জেই শেষ(মৃত্যু) করে ফেলতে পারতো। পরে আমার পেশাগত সময় সংকুলান না হওয়ায় ও চাচা মারা যাওয়ায় আর দেখা করিনি ।
এই সাহসী উদীপ্ত বাঙ্গালীর সূর্য্যসন্তান জুবেলী উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে সহযোগী অবসরপ্রাপ্ত বিমান বাহিনীর কর্মকর্তা আচ্ছদ্দর আলী চৌধুরী, লাল মিয়া সহকারে মুক্তি বাহিনী গড়ে তুলে সশস্ত্র ট্রেনিং দান করে প্রশিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধাদের মুক্তিযুদ্ধে পাঠিয়ে দিতেন। তাঁর সাহসী এমন কর্মময়তার জন্য বাঙ্গালী জাতি স্মরণ করছে যা হাওরবাসী শাল্লার গর্বের বিষয় ও অহংকার।