বিশেষ প্রতিনিধি::
করোনাভাইরাস প্রতিরোধে বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান ও ডাক্তারদের চেম্বার বন্ধ রয়েছে প্রায় ১৫ দিন ধরে। ফলে স্বচ্ছল-অস্বচ্ছল রোগীও জঠিল রোগেরও চিকিৎসা নেওয়া সম্ভব হচ্ছেনা। তাছাড়া অনেক অসহায় মানুষ ঘরে বন্ধি থাকায় কোন ধরনের রোগেরই কাঙ্খিত সেবা পাচ্ছেনা। এই অবস্থায় সুনামগঞ্জ বিএমএ’র (বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন সুনামগঞ্জ জেলা শাখা) সাধারণ সম্পাদক সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজের আবাসিক সার্জন (ইএনটি) ডা. এম নূরুল ইসলাম ও সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. সৈকত দাস শুক্রবার দিনব্যাপী সুনামগঞ্জের প্রত্যন্ত এলাকার একটি গ্রামের ঘরে ঘরে গিয়ে দিনব্যাপী অসহায় মানুষদের চিকিৎসা দিয়েছেন। ব্যবস্থাপত্রের সঙ্গে সাধ্যমতো ওষুধ কেনার নগদ টাকাও দিয়েছেন। করোনাভাইরাসের দুঃসহকালে ব্যস্ত বিশেষজ্ঞ ডাক্তার রোগির ঘরে ঘরে গিয়ে খোঁজ নিয়ে চিকিৎসা ও আর্থিক সহায়তা প্রদানের ঘটনায় অবাক হয়েছেন মানুষজন। তারা এ ঘটনায় দুই মানবিক ডাক্তারকে অভিনন্দন ও শুভ কামনা জানিয়েছেন। এদিকে সুনামগঞ্জ বিএমএ’র দুই নেতা সারাদেশের তরুণ ডাক্তারদের মানুষের সেবায় এখনই ঘর ছেড়ে বের হয়ে সেবা দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার কোণাগাও গ্রামের বাসিন্দা ডা. এম নূরুল ইসলাম একজন মানবিক ডাক্তার হিসেবে জেলাব্যাপী পরিচিত। অনেক রোগীকে বিনামূল্যে ব্যবস্থাপত্র প্রদানসহ ওষুধ ও আর্থিক প্রণোদনা দিয়ে থাকেন তিনি। এখন সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজে প্রতিদিন তিনি এই করোনার সময়েও বিশেষ সেবা দিচ্ছেন হাসপাতালে। সম্প্রতি দিনভর ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ঝূঁকি নিয়ে চিকিৎসা দান ও মানবিক মানুষের পাশে দাঁড়ানোর বিভিন্ন ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরালও হয়েছে। সম্প্রতি করোনাভাইরাসে গৃহবন্ধী তার নিজ এলাকার অসহায় মানুষদের ১ লক্ষ টাকা আর্থিক সহায়তা দিয়েছেন। তার অনজপ্রতিম সুনামগঞ্জ বিএমএ’র সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. সৈকত দাসও করোনার এই সময়ে মোবাইলে সাধারণ মানুষদের পরামর্শসহ মেডিকেল স্টুডেন্ট এসোসিয়েশনের হয়ে গ্রামে গ্রামে গিয়ে অসহায় মানুষদের খাদ্য সহায়তা দিয়ে প্রশংসিত হয়েছেন।
বিএমএ’র এই দুই নেতা শুক্রবার দুপুর থেকেই সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার অবহেলিত কলাইয়া গ্রামের ঘরে ঘরে ছুটে যান অসহায় মানুষদের সেবা দিতে। প্রথমে গ্রামের সাধারণ মানুষ করোনার নানা গুজব বিশ্বাস করে সেবা নিতে অনীহা প্রকাশ করলেও তাদের বুঝানোর পর সেবা নিতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। বৃহত্তম এই গ্রামটির বিভিন্ন পাড়ায় গিয়ে তারা জটিল রোগীসহ নানা ধরণের অন্তত অর্ধশতাধিক রোগীকে ব্যবস্থাপত্র ও আর্থিক সহায়তা দিয়েছেন। বিনা ফিতে নিজের ঘরে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের ব্যবস্থাপত্র ও ওষুধের আর্থিক সহায়তা পেয়ে তাদের অনেকেই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। ডাক্তারবৃন্দ চিকিৎসার পাশাপাশি করোনার এই সময়ে গ্রামের মানুষকে সচেতন হওয়ার আহ্বানও জানান।
কলাইয়া গ্রামের বৃদ্ধা কুলসুমা বলেন, ‘আল্লাহ আমরা গ্রামে আইজ দুই ফিরিস্তা ফাঠাইছইন। তারা আমার মতো গরিব অনেক মানুষরে সেবা দিছইন। ওষুধ কিনার টাকাও দিছইন। আল্লায় তারারে অনেক উফরে নিবা।
কলাইয়া গ্রামের যুবক ও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দফতরি মো. আক্তার হোসেন বলেন, সিলেট বিভাগের নামকরা বিশেষজ্ঞ ডাক্তার আমাদের গ্রামের অসহায় মানুষদের ঘরে এসে সেবা দিবেন, ওষুধের টাকা দিবেন-এই ঘটনা আমাদের কাছে এখনো স্বপ্ন মনে হচ্ছে। তিনি বলেন, প্রথমে গুজব বিশ্বাস করে মানুষ সেবা নিতে অনীহা প্রকাশ করলেও পরে চিকিৎসার জন্য ভীষণ আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তারা দুই ডাক্তারকে প্রাণভরে দোয়া করেছেন। গ্রামবাসী মনে করছেন এই অবরুদ্ধ সময়ে এই দুই ডাক্তার আশির্বাদ হয়ে দেখা দিয়েছেন।
গ্রামের সাবেক ইউপি সদস্য কামরুল ইসলাম বলেন, ডা. নূরুল ইসলাম সুনামগঞ্জের সবচেয়ে ব্যস্ত ডক্তারদের একজন। তিনি আমাদের গ্রামের ঘরে ঘরে এসে সেবা দিবেন এটা এখনো বিশ্বাস হচ্ছেনা। কিন্তু তিনি আমাদের অবাক করে আজ সারাদিন এটাই করেছেন। তিনি বলেন, করোনার এই সময়ে আমাদের গ্রামের কয়েকজন মরণাপন্ন রোগী সেবা নিতে পারছেন না। দেখার পর তিনি তাদেরকে জরুরি সেবা দিয়েছেন। এতে গ্রামের মানুষ খুব খুশি হয়েছে।
সুনামগঞ্জ বিএম’র সাংগঠনিক সম্পাদক শিশু রোগ বিষয়ে অভিজ্ঞ ডা. সৈকত দাস বলেন, আমরা সুনামগঞ্জ বিএমর পক্ষ থেকে আজ কলাইয়া গ্রামের অসহায় মানুষদের ঘরে ঘরে এসে বিনামূল্যে সেবাসহ সাধ্যমত আর্থিক সহায়াতাও দিয়েছি। তবে গ্রামে এসে মনে হয়েছে মানুষ করোনা নিয়ে নানা গুজব বিশ্বাস করে বসে আছেন। গুজব রোধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। তিনি বলেন, সুনামগঞ্জ বিএমএ সব সময় মানুষের সেবায় নিয়োজিত থাকবে।
সুনামগঞ্জ বিএমএ’র সাধারণ সম্পাদক ও সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজের আবাসিক সার্জন (ইএনটি) ডা. এম নূরুল ইসলাম বলেন, সরকারি সেবা এখন অনেকটা সংকুচিত। বেসরকারি সেবাও প্রায় বন্ধ। এই অবস্থায় অসহায় মানুষসহ স্বচ্ছল মানুষও সেবা নিতে পারছেন না। তাই আমাদের মনে হলো প্রত্যন্ত গ্রামে গিয়ে মানুষকে সেবা দিব। যারা ওষুধ কিনতে পারবেনা তাদের সাধ্যমতো আর্থিক সহায়তা দেব। এই ভাবনা থেকেই আজ মানুষের ঘরে এসে সেবা দিলাম। আমি চাই এখনই দেশের সকল ডাক্তারদের বাইরে এসে মানুষের সেবা করার উত্তম সময়। বিশেষ করে সারাদেশের তরুণ ও মানবিক ডাক্তারদের এই কাজে এগিয়ে আসার অনুরোধ জানাই।