দুনিয়াজুড়ে লকডাউন। ঘর থেকে পাড়া, গ্রাম থেকে শহর বাংলাদেশও জারি করেছে করেছে লকডাউন। তবে একমাত্র বাংলাদেশের চাবাগানে চলছে না এই লকডাউন। করোনা মহামারীর এই দারুণ দু:সময়ে বাংলাদেশের ১৬৬টি চাবাগান যেন সংক্রমণ ও বিস্তার ঠেকিয়ে রাখার কোনো জাদুকরি কৌশল আবিষ্কার করেছে। করোনাযুদ্ধে গোটা দুনিয়া যেখানে বেসামাল, সেখানে চাবাগানি শ্রমিকদের এখনো কাজ করতে হচ্ছে জীবনের ঝুঁকি নিয়েই। এ যেন বাংলাদেশ নয়, বিশ্ব নয়। এ যেন আসলেই এক অদ্ভূত অঞ্চল। চাবাগান কর্তৃপক্ষ কী মনে করছেন এখানে করোনার বিস্তার ও সংক্রমণ ঘটবে না? যদি তাই হয় তবে আমরা পুরো দেশ ও বিশ্ব করোনা ঝুঁকি এড়াতে বাংলাদেশের চাবাগানকে কেন অনুসরণ করছি না? বিশ্ববাসী যেখানে নিরাপত্তা ঝুঁকিতে ঘরে বসে আছে সেখানে চাবাগানের শ্রমিকদের এই বৈশ্বিক মহামারীর ভেতরও নিদারুণভাবে কাজ করে যেতে হচ্ছে। কারণ তা না হলে হয়তো মজুরি জুটবে না, ছুটে যাবে কাজ। কেবল চাবাগান নয়, সম্প্রতি গার্মেন্টস শ্রমিকদের সাথেও মালিকেরা এমন চরম অন্যায় করেছেন। করোনারকালে তাদের ঘর থেকে টেনে রাস্তায় বের করেছেন। শেষমেষ রাষ্ট্র প্রনোদণার ঘোষণা দিলে মালিকেরা ক্ষ্যান্ত হন। কিন্তু চাশ্রমিকদের জন্য এখনো জুটেনি কোনো প্রনোদণা কী সুরক্ষা সরঞ্জাম। এখনো মেহনত ঝরিয়ে দেশের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন চাশ্রমিকেরা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী করোনাকালে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে যাওয়া চিকিৎসক ও সংশ্লিষ্টদের জন্য বিশেষ প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এই করোনাকালেও কাজ করে যাওয়া চাশ্রমিকেরাও তো এমন বিশেষ প্রণোদনা দাবির অধিকার রাখেন। হয়তো বিজ্ঞ প্রধানমন্ত্রী চাশ্রমিকদের বিষয়টিওখতিয়ে দেখবেন এবং করোনার ঝুঁকি থেকে চাবাগানিদের সুরক্ষায় বিশেষ ঘোষণা দেবেন।
২.
করোনার সংক্রমণ ও বিস্তার বাড়তে থাকলে নানা রাষ্ট্রীয় বিধি ও সুরক্ষা ঘোষণা আসে। রাষ্ট্রীয় বিধিকে অনুসরণ করে চাশ্রমিক সংগঠন ২৬ মার্চ বাগান মালিকদের সংগঠন ‘বাংলাদেশীয় চা সংসদে’ চিঠি দিয়ে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত বাধ্যতামূলক ছুটির দাবি জানায়। কিন্তু বাগান মালিকেরা এইসব দাবি খারিজ করেন। পরবর্তীতে চাশ্রমিকদের সুরক্ষায় মে মাস পর্যন্ত সবেতনে ছুটি ঘোষণার দাবি জানায় চাবাগান ছাত্র ও যুব সংগঠন। তাদের বক্তব্য ভারত ৮৮১টি বাগান বন্ধ রেখেছে, দেশের সুরক্ষায় বাংলাদেশের ১৬৬টি বাগানও বন্ধ রাখা জরুরি। বাগান বন্ধ না হওয়ায় পরে বাধ্য হয়ে ২৭ ও ২৮ মার্চ শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জের শমসেরনগর, দেওছড়া, বাগিছড়া, ডবলছড়া, মিত্তিঙ্গা, সাতগাঁও, মাকড়িছড়া, ইছামতী ও মাজহিদিসহ বেশকিছু চাবাগানের শ্রমিকেরা নিজ থেকে কাজ বন্ধ করে দেন। কিছু বাগানে কিছু কাজ বন্ধ থাকলেও এখনো ঝুঁকি নিয়ে চাবাগানে কাজ করতে হচ্ছে শ্রমিকদের। চাবাগানের জীবন নানাভাবে একের সাথে আরেকজনের গলাগলি জড়িয়ে থাকার জীবন। কেবলমাত্র পাতা তোলা, ওজন করানো আর বাগান পরিষ্কার বা বিষ ছিটানোর ক্ষেত্রে শারিরীক দূরত্ব মানা সম্ভব। কিন্তু এর বাদে চাবাগানিদের জীবনতো গাদাগাদি করে থাকা। এক ঘরে পুরো পরিবার ও গরু-ছাগসহ একসাথে কাটানো। আছে পানির তীব্র সংকট। বাগানের ভেতর দিয়ে মুমূর্ষু পাহাড়ি ছড়া গুলোই একমাত্র পাবলিক পানির উৎস। এইসব ছড়াতেই গোসল, কাপড় ও বাসন ধোয়া থেকে শুরু করে ঘরগেরস্থালির সব কাজ সারতে হয়। চাবাগানের ধারেকাছে কোনো বাজার নেই। বাগানেই বসে একবেলার হাট। সেই হাটেই ভিড়ের ভেতর নানাবয়সীদের একত্র হওয়া। এই তুমুল ঘনবসতির জনবহুল গাদাগাদির জীবনের চাবাগানে কেন তাহলে করোনার সংক্রমণ ও বিস্তারের ঝুঁকি থাকবে না? করোনার ঝুঁকি সবখানেতেই আছে। কিন্তু করপোরেট চাবাণিজ্য চাশ্রমিকদের জীবনের ঝুঁকিকে কোনো ঝুঁকিই মনে করে না। করেনি কোনোকালে। এই ঐতিহাসিক উপনিবেশিক মনস্তত্ত্বের ঘেরেই এখনো বন্দি চাবাগান তাই করোনার ঝুঁকি নিয়েও আমাদের জন্য প্রস্তুত করে যাচ্ছে ক্লান্ত নিবারণী পানীয়। যাতে আমরা কোনো ঝুঁকি ও বিপদে ক্লান্ত না হয়ে পড়ি, মুষড়ে না যাই।
৩.
বাংলাদেশ চা বোর্ড ৬ এপ্রিল ২০২০ তারিখে তাদের ওয়েবসাইটে ‘চাবাগানে করোনা ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে সচেতনতামূলক ভিডিও’ নামে প্রায় তিন মিনিটের একটি ভিডিও আপলোড করে। ভিডিওটিতে দেখা যায় দূরত্ব বজায় রেখে চাশ্রমিকেরা চা পাতা তুলছেন, পাতা ওজন করাচ্ছেন, হাত ধুচ্ছেন এবং মাস্ক পড়ে কাজ করছেন। এছাড়াও শ্রমিকের শরীর, গাড়িসহ কারখানার চারপাশ জীবাণুনাশক স্প্রে করা হচ্ছে। চাশিল্পই তো দেশের একমাত্র শ্রমঘন শিল্প যার শ্রমিকেরা তাদের পরিবার পরিজন নিয়ে গাদাগাদি করে চাবাগানেই বসবাস করেন। চাবাগানের ভাষায় যাকে শ্রমিক বস্তি লাইন ও কলোনি বলে। যাদের রক্তজলে চাঙ্গা থাকে চাবাগান তাদের বসতিএলাকায় চাবাগান কর্তৃপক্ষ কী ধরণের সুরক্ষা নিশ্চিত করছেন বা করা জরুরি তার কোনো ফুটেজ দু:খজনকভাবে ভিডিওটিতে নেই। দেশের গরিষ্ঠভাগ চাবাগান গুলো সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জে অবস্থিত। এছাড়াও চট্টগ্রা, রাঙামাটি, বান্দরবান, পঞ্চগড়ে কিছু বাগান আছে। দেশের এই সবগুলো অঞ্চলেই করোনা ঝুঁকিতে সরকার কঠোর নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। বিশেষ করে প্রবাসী অধ্যুষিত সিলেটেই দেশের প্রায় চাবাগানগুলি আর তাই এখানকার শ্রমিকেরা অন্য অনেক শিল্পের চেয়ে আরো বেশি ঝুঁকিতে আছেন। চাবাগানগুলো দেশের অন্যতম পর্যটনস্থল। ২৫ মার্চের আগে গণপরিবহন ও পর্যটনে নিষেধাজ্ঞা আসার আগ পর্যন্ত চাবাগানগুলোতে উপচে পড়েছিল পর্যটকদের ভিড়। কেন জানে কোন বাগানে এই কারণে ছড়িয়েছে কীনা করোনা। করোনার মতো উপসর্গ নিয়ে এমনিতেই দিন কাটে চাবাগানিদের। তার ওপর রোগে ভোগে মৃত্যু চাবাগানের এক প্রশ্নহীন নিয়তি। এ নিয়ে কোনো রা নেই কোথাও, নেই কোনো গণমাধ্যম প্রতিক্রিয়াও। সরকার যেহেতু দেশের সকলকে করোনা মোকাবেলায় নিরাপত্তাবিধি মেনে ঘরে থাকতে বলেছে তাই বাগান মালিকদের এ বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়া জরুরি। দ্রুত চাবাগানের শ্রমিকবসতির নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করে চাশ্রমিকদের সবেতনে ছুটি দেয়া দরকার। কারণ কোনোভাবে চাবাগানে এই মহামারী ছড়িয়ে গেলে একে সামাল দেয়ার কোনো কারিগরি আমাদের নাই।
৪.
অসুখ ও চিকিৎসাহীনতায় মৃত্যু যেন চাবাগানের এক মুখস্থ কাহিনি। কলেরা, ডায়রিয়া, ম্যালেরিয়া, হাম লেগেই থাকে। ২০০৭ সনের অক্টোবরে প্রায় জনাপঞ্চাশেক মানুষের ডায়রিয়ায় করুণ মৃত্যু কি তখন কোনো গণমাধ্যম কী সুশীল সমাজে দাগ কেটেছিল? আইসিডিডিআর-বি চাবাগানের পানি পরীক্ষা করে তখন জীবাণু পেয়েছিল। কিন্তু বাগান মালিকেরা কী জীবাণুমুক্ত পানি নিশ্চিত করতে পেরেছিলেন। না, এখনো চাবাগানে মানুষ নিরাপদ পানি পায় না। তাহলে কীভাবে এইসব শ্রমিকেরা করোনা মোকাবেলা করবে? কীভাবে সম্ভব? যেখানে মজুরি না পেলে উপোস থাকা পরিবারগুলো কোনোমতে খেয়ে না খেয়ে তীব্র অপুষ্টির জীবন নিয়ে বড় হচ্ছে। যেখানে এমনিতেই পানি ও খাদ্যের সংকট আছে। যেখানে চিকিৎসার জন্য সরকারি হাসপাতালে হেঁটে আসতে হয় মাইলের পর মাইল। করোনার সংক্রমণ ঘটলে কোন জাদুতে এই গরিব মেহনতি মানুষেরা এর সামাল দিবেন? আর চাবাগান থেকে এই সংক্রমণ যে দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়বে না তার তো কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখা নেই।
৫.
এই বৈশ্বিক মহামারীর সময়েও চাবাগানগুলো ছুটি দেয়া যাচ্ছে না কেন? কারণ কী? ফিনলে, ডানকান, ইস্পাহানী, ইউনিলিভারের মতো করপোরেট কোম্পানিরা তাতে মন খারাপ করবে? নাকি আমরা কিছুদিন আর ক্লান্তিনিরাবারণী পানীয় পান করতে পারবো না বলে? নাকি চাবাগানে সব গরিব আদিবাসী মেহনতি মানুষেরা কাজ করে বলে? নাকি কাজ না করলে মজুরি দিবে কে এই আশংকায় মালিকেরা শ্রমিকদের ছুটি দিতে পারছেন না? এই সিদ্ধান্ত বাগান ও রাষ্ট্র মিলে নিতে হবে। কারণ মজুরির নিশ্চয়তা ছাড়া ছুটি হলে চাশ্রমিকেরা একেবারে ¯্রফে না খেয়ে মরবে। কারণ এর অজ¯্র নজির আগে তৈরি করে রেখেছেন মালিকপক্ষ। মৌলভীবাজার জেলার জুরী উপজেলার রতনা চা বাগান ২১/১২/২০০৪ সালে বন্ধ করে দেয়ার দুই বছরের ভেতর বাগানের ৬৬৮ জন স্থায়ী শ্রমিকের ভেতর কার্যত না খেয়ে ও রোগে ভোগে মারা যান ত্রিশজন মানুষ। তো এই বৈশ্বিক মহামারীতে চাবাগানে দুই ধরণের ভয়। একদিকে করোনা আরেকদিকে মজুরি না পেলে না খেয়ে মরার ভয়। চাশ্রমিকদের করোনাঝুঁকি মোকাবেলায় এই দ্বৈত ভীতি সামাল দিতে হবে। করোনারকালে আমরা প্রতিদিন নানাকিছু শিখছি নতুনভাবে। শিখছি রোগের বিশ্বায়নে প্রচলিত বৈষম্য ও উপনিবেশিকতা চুরমার হয়ে যায়। আশা করি চাবাগান নিয়ে চলমান বৈষম্যমূলক মনস্তত্ত্ব থেকে এই সংকটে অন্তত সরে আসবেন মালিকপক্ষ। করোনার ঝুঁকি মোকাবেলায় চাশ্রমিকদের বাসস্থানের সামগ্রিক সুরক্ষাসহ তাদের সবেতন ছুটি মঞ্জুর করবেন। ফাল্গুন-চৈত্র মাস চাবাগানের জীবনে নানা কৃত্য ও উৎসবের আয়োজন থাকে। বিশেষকরে গাজন, চৈত্রসংক্রান্তি, দন্ডবর্ত, চড়ক জমে ওঠে এই সময়। এ সময় সকল পাবলিক আয়োজন ও সমাগম এড়াতে চাবাগানিদেরও দায়িত্ব নিতে হবে। জাতিগত নানা লোকায়ত সঙ্গনিরোধ ও গ্রামবিচ্ছিন্নতার প্রথাগুলোকে জোরদার করে নিজেদের সুরক্ষার সাংস্কৃতিকবৈচিত্র্যকে আরো দৃঢ় করে তোলার এইতো সময়।
পাভেল পার্থ, লেখক ও গবেষক। ই-মেইল: animistbangla@gmil.com