বিশেষ প্রতিনিধি::
সুনামগঞ্জ জেলায় বোরো মওসুমে ধানকাটার সময়ে গত দুই দশক ধরে চরম শ্রমিক সংকট চলছে। উত্তরাঞ্চল, দক্ষিণাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চল থেকে এক সময় ধানকাটা শ্রমিকরা দলে দলে বৈশাখ মাসে এসে উৎসবমুখর পরিবেশে ধান কাটলেও এখন তারা আসছেনা। তাদের অর্থনৈতিক সচ্ছলতার কারণেই এই অঞ্চলে না আসায় বৈশাখে ধানকাটা শ্রমিকের সংকট দেখা দিয়েছে। তাই স্থানীয় শ্রমিক আর সিলেটের কয়েকটি উপজেলার শ্রমিকরাই এখন ভরসা। তবে এবার করোনাভাইরাসের কারণে সংকট আরো প্রকট হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাই এই সময়ে সিলেট ও সুনামগঞ্জের ধানকাটা শ্রমিকরা জেলার বিভিন্ন উপজেলায় ধান কাটার জন্য যাতে সহজে ও সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করে যেতে পারে এজন্য জেলা প্রশাসন সামাজিক দূরত্ব কিছুটা শীতিল করেছে। তাছাড়া বৃহষ্পতিবার প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকেও এ বিষয়ে বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
সুনামগঞ্জের কৃষক ও জনপ্রতিনিধিরা জানান, সুরমা নদীর উত্তরাঞ্চলে তুলনামূলক হাওরের উপস্থিতি কম। তাই এই অঞ্চলের শ্রমিকরাই মওসুমে হাওরের ধান কাটতে জেলার বিভিন্ন উপজেলায় ছড়িয়ে যান। কিন্তু এবার করোনা ভাইরাসের আতঙ্কের কারণে শ্রমিকদের মধ্যেও উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে। এই অবস্থায় শ্রমিক টানতে প্রশাসনও নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
এদিকে শ্রমিকদের আতঙ্ক দূর করতে সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার সুরমা ইউনিয়ন পরিষদের ৬ নং ওয়ার্ডের তরুণ সদস্য মো. আব্দুল হাই তার ইউনিয়নের ধানকাটা শ্রমিকদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদেরকে ধান কাটায় যেতে উদবুদ্ধ করছেন। তিনি এ পর্যন্ত ৭০ জনেরও অধিক শ্রমিককে সুনামগঞ্জের বিভিন্ন উপজেলার হাওরে এসে ধান কাটার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে ওই ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামের ৭০ জনের মতো ধান কাটা শ্রমিক ৭টি দলে বিভক্ত হয়ে জেলার জগন্নাথপুর, দিরাই, শাল্লা, দক্ষিণ সুনামগঞ্জ, সুনামগঞ্জ সদরসহ বিভিন্ন উপজেলায় যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছেন। আজ-কালের মধ্যেই তারা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে বাড়ি থেকে হাওরের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করবেন বলে জানা গেছে।
কৃষ্ণনগর গ্রামের ধান কাটা শ্রমিক কবির মিয়া বলেন, আব্দুল হাই মেম্বার তিন দিন ধরে আমাদের বুঝাচ্ছে হাওরে গিয়ে ধানকাটার জন্য। আমার মতো আরো অনেক শ্রমিককে বুঝিয়ে সে রাজি করিয়েছে। আমরা শুক্রবার থেকে জগন্নাথপুর ও দিরাইয়ে বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে ধান কাটতে যাব।
ঢালাগাও গ্রামের ধান কাটা শ্রমিক আব্দুল জব্বার বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে সবাই ভয়ে বাড়িতে আছি। ঘরে খাবারদাবার তেমন নাই। তারপরও পরিবারের লোকজন এই অবস্থায় বাড়ি ছেড়ে দিতে চায়না। কিন্তু আব্দুল হাই মেম্বার তিনদিন ধরে আমার যারা এই সময়ে ধান কাটি তাদেরকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বুঝাচ্ছে।
ইউপি সদস্য আব্দুল হাই বলেন, আমাদের হাওরের কৃষকরা খুবই হতভাগ্য। এই হতভাগ্য কৃষকরাই কষ্ট করে প্রতি বছর ফসল ফলায়। কিন্তু কোন বছরই শ্রমিকের অভাবে এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে পুরো ফসল গোলায় তোলতে পারেনা। এবার মহামারি করোনার কারণে থমকে আছে জীবন। জনশুন্য সারাদেশ। এই অবস্থায় শ্রমিকরাও আতঙ্কে আছে। হাওরের কৃষকের অসহায় মুখ দেখে আমার কষ্ট হচ্ছিল। তাই এলাকার যারা বরাবর ধান কাটতে যায় তাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে হাওরে ধান কাটার জন্য অনুরোধ করেছি। প্রায় ৭০ জন শ্রমিক দিরাই, জগন্নাথপুর ও দক্ষিণ সুনামগঞ্জের বিভিন্ন হাওরে যেতে রাজি হয়েছেন। এতে আমার খুব ভালো লাগছে।
উল্লেখ্য এ বছর সুনামগঞ্জ জেলায় ছোট বড় মিলিয়ে প্রায় দেড় শতাধিক হাওরে ২ লাখ ১৯ হাজার ৪০০ হেক্টর বোরো লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে অর্জিত হয়েছে ২ লাখ ১৯ হাজার ৩০০ হেক্টর। বিআর ২৮, ২৯ সহ হ্ইাব্রীড, উফশীসহ কিছু স্থানীয় জাতের ধানও আবাদ হয়েছে। এবার ৫২টি হাওরের ফসলরক্ষার জন্য ৬৪০ কি.মি ফসলরক্ষা বাধ নির্মাণ, সংস্কার করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। সরকার প্রাথমিক ৬৯ কোটি টাকা বরাদ্দ দিলেও পানি উন্নয়ন বোর্ড ১৩২ কোটি টাকার মোট বাজেট চেয়েছে। আগামী ১৪ এপ্রিল থেকে জেলার সকল হাওরে একযোগে ধানকাটা শুরু হবে বলে জানিয়েছে কৃষি বিভাগ।