হোক ঢিলেঢালা কী জোরালো, কার্যত লকডাউন চলছে। বন্ধ হয়ে আছে হোটেল-রেস্তোরা কী দোকান। বারান্দা দিয়ে রাস্তায় তাকালে অনেক পরিচিত-অপরিচিত কুকুরদের ভিড়। কুকুরগুলো ক্ষুধায় অস্থির হয়ে আছে। চারপাশের শংকা ও দুম করে ঘটতে থাকা একটা পরিবর্তন হয়তো এই কুকুরেরাও বুঝতে পারছে না। তাই ভীষণ ক্ষুধার্ত হলেও হামলে পড়ছে না কারোর ওপর। ঢাকা শহরসহ দেশের নগর কী মফস্বলের হাটবাজারে এমন অনেক কুকুর আছে। যারা দিনমান এঁটোকুটো খায়। হোটেল, রেস্তোরা কী দোকানের ফেলে দেয়া নানাকিছু যায় এদের পেটের। এইসব কুকুরই আমাদের গ্রাম কী নগরের গলিপথ ও মহল্লাগুলোর নিরাপত্তা দেয়। এইসব কুকুরেরা কারোর বাড়ির নয়, অনেকে মাঝেমধ্যে একআধটু খাবার দেন। কিন্তু এই লকডাউনে এইসব কুকুরেরা পড়েছে দারুণ বিপাকে। খাবার দেয়ার কেউ নেই, কোথাও পাওয়াও যাচ্ছে না এঁটোকুটো। কী করে বাঁচবে এই দুর্ভাগা প্রাণিরা? এরা তো নিজের পরিশ্রমে আমাদের পাড়া-মহল্লার নিরাপত্তা দেয়, আবর্জনা পরিস্কারে ভূমিকা রাখে। তাহলে এই দু:সময়ে মানুষ কেন দাঁড়াবে না তাদের পাশে? জানি করোনারকালে এমনতর কত নিদারুণ যন্ত্রণা আর সংকট তৈরি হতে থাকবে, কিন্তু মানুষ হিসেবে আমাদেরকেই তো এই সংকট সামাল দিতে হবে। কারণ আমরাই এই মহামারী তৈরি করেছি। আমাদেরকেই এর দায় নিতে হবে। নিজেদের ভেতর নানামুখী দায়িত্ববোধ জাগাতে হবে। সামনের দিনে করোনার সংকট আরো তীব্র হলে, যখন গরিব মানুষের খাদ্য নিয়েই দুশ্চিন্তা তখন এইসব নগরের প্রাণিদের কী হবে? কতদিন এরা ক্ষুধার যন্ত্রণা সইতে পারবে? হয়তো বদলে যাবে চরিত্র, হয়তো ঝাঁপিয়ে পড়বে মানুষের ওপর। তৈরি হবে সংঘাত ও রক্তপাত। মানুষ তখন কী করবে? হয়তো পিটিয়ে এইসব আক্রমণকারী ‘বেওয়ারিশ’ কুকুরদের মেরে ফেলবে। কিন্তু এই নির্মমতাই কী এর সমাধান? করোনারকালে গৃহপালিত, বন্যপ্রাণ কিংবা উল্লিখিত কুকুরদের মতো মালিকাবিহিন প্রাণিদের সুরক্ষা নিয়ে আমাদের এগিয়ে আসা জরুরি। কারণ তা না হলে করোনা সংকট আরো জটিল হবে এবং নতুন সামাজিক অস্থিরতা বিস্তৃত হবে।
২.
এর ভেতর একটি ঘটনা গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে। রাজশাহীর শহীদ এ এইচ এম কামারুজ্জামান কেন্দ্রীয় উদ্যান ও চিড়িয়াখানায় ৩ এপ্রিল ভোরে পাঁচটি ক্ষুধার্ত কুকুর ঢুকে চারটি হরিণ শিশু খেয়ে ফেলতে বাধ্য হয়েছে। যদিও পরবর্তীতে রাজশাহী সিটি করপোরেশেন শহরের এইসব কুকুরদের জন্য কিছু খাবার সরবরাহের উদ্যোগ নিয়েছেন। রাজশাহী সিটি করপোরেশেনের এই অবিস্মরণীয় উদ্যোগটি দেশের সকল স্থানীয় সরকার কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করতে পারেন। কেবল সিটি করপোরেশন নয়; পৌরসভা, গ্রাম কী ইউনিয়ন, হাটবাজার কী মফস্বল, বন্দর থেকে টার্মিনাল সর্বত্রই এমন প্রাণিরা আছে। যাদের দয়ায় তারা বাঁচত সেইসব কিছু মানুষ আজ ঘরের ভেতর। তাহলে কীভাবে বাঁচবে জীবন। এইসব প্রাণিকূল ছাড়া এককভাবে বাঁচবে কী প্রজাতি হিসেবে মানুষের জীবন? সমন্বয়ের দায়িত্বটা স্থানীয় সরকার নিতে পারেন। কিন্তু এই নিদারুণ সংকটে কেবল সরকার নয়, দেশের প্রাণিদরদী সংগঠন ও ব্যক্তি এবং স্বচ্ছল ধনী মানুষদের এক্ষেত্রে এগিয়ে আসাটা জরুরি। তারা নিজেরাই নিজেদের এলাকার স্থানীয় সরকারকে এইসব প্রাণিকূলের সুরক্ষায় অর্থ ও খাদ্য সহযোগিতা করতে পারেন। স্থানীয় সরকার নিজ নিজ এলাকায় দিনের কয়েকটি নির্দিষ্ট সময়ে এইসব খাবার প্রতিদিন সরবরাহ করতে পারেন। তবে অবশ্যই সকলক্ষেত্রে করোনা মোকাবেলায় রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও সুরক্ষা বিধি মেনেই কাজটি করতে হবে।
৩.
লেখাটি যখন লিখছি তখন বারবার ভাসছে নভেল করোনা একটি ‘জুনোটিক রোগ’। মানে এই ভাইরাস প্রাণি থেকে মানুষে ছড়িয়েছে। যেমন বাদুড় থেকে নিপাহ ভাইরাস কিংবা মশা থেকে ডেঙ্গু ছড়িয়েছে মানুষে। যদিও এখনো নিশ্চিত প্রমাণ নেই কোন প্রাণি থেকে ছড়িয়েছে এই করোনা ভাইরাস, তারপরও এটি নিশ্চিত যে চীনের উহানের এক বাজার থেকে এটি ছড়িয়েছে। যেখানে বন্যপ্রাণী বিক্রি হতো। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রথমে বলেছিল, এই ভাইরাস মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায় না। অনেকে বলেছিলেন, এই ভাইরাস মানুষ থেকে অন্য প্রাণিতে ছড়ায় না। কিন্তু করোনা প্রতিদিন আমাদের সকল মুখস্থ পরিসংখ্যান ও বাহাদুরি বদলে দিচ্ছে। মানুষ থেকে প্রাণিতে ছড়িয়েছে এই ভাইরাস। বিড়ালের পর আমেরিকার নিউইয়র্কের ব্রংস চিড়িয়াখানার নাদিয়া নামের এক বাঘের শরীরেও মিলেছে করোনা ভাইরাস। ইউনাইটেড স্টেটস ডিপার্টমেন্ট অব অ্যাগ্রিকালচার (ইউএসডিএ) জানিয়েছে, নাদিয়া ছাড়াও আরো পাঁচটি বাঘ ও সিংহের মধ্যে শ্বাসযন্ত্রের সমস্যা দেখা দিয়েছে। তো ভাবছি যদি এই ভাইরাস আমাদের গৃহপালিত প্রাণি, চিড়িয়াখানায় বন্দি জীব কিংবা রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো এইসব কুকুর-বিড়ালের ভেতরেও ছড়িয়ে পড়ে তবে কী হবে? কিংবা আমাদের গ্রামীণ বন কী সুন্দরবন বা লাউয়াছড়া বা রেমা-কালেঙ্গা বনে বন্যপ্রাণীতে যদি ছড়িয়ে পড়ে তবে কে কাকে সামাল দিবে তখন? জানি এসব ঘটবে না। এই বিশ্বাস বিদ্যায়তনিক মুখস্থ বুলি দিয়ে নয়,¯্রকৃতির ওপর আস্থা থেকে বলা। প্রকৃতির নিজস্ব বিজ্ঞান ও দর্শন আছে। প্রকৃতি নির্দয় নয়। এভাবে সবকিছু চুরমার ও খানখান হয়ে যাবে না সব। কিন্তু তারপরও আমাদেরতো এইসব বিপদ চিন্তায় রাখা জরুরি। আমেরিকায় বাঘের শরীরে করোনা ধরা পড়ার পর ভারতের কলকাতা আলিপুর চিড়িয়াখানা নানা সুরক্ষা ব্যবস্থা নিয়েছে। বিশেষ করে যারা পশুদের খাঁচায় ঢুকে খাবার দেন তাদের পিপিই, স্যানিটাইজার ও অন্যান্য নিরাপত্তা উপকরণ সরবরাহ করেছে। গুরুত্বপূর্ণ হলো প্রতিবার খাঁচায় প্রবেশের আগে প্রাণিদের শরীর পরীক্ষা করা হচ্ছে। জানিনা, করোনাসংকটে বাংলাদেশ চিড়িয়াখানার প্রাণিকূল এবং এখানে দায়িত্বরতদের নিরাপত্তায় কী ব্যবস্থা নিয়েছে? বা নিতে যাচ্ছে?
৪.
যখন করোনায় আক্রান্ত বিশ্ব। রাষ্ট্রীয়ভাবে বিধি জারি হয়েছে অসুস্থ প্রাণিকূল থেকে দূরে থাকতে। বন্যপ্রাণিদের এড়িয়ে চলতে। এই সময়েও মানুষ অকাতরে পিটিয়ে মারছে বন্যপ্রাণী। মৌলভীবাজারে নির্মমভাবে গলায় রশি দিয়ে একটি বানর হত্যার ভিডিও সবাই মিলে উপভোগ করার একটি নিদারুণ ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে। রাজশাহী-চাপাইনবাবগঞ্জে আবার বাড়ছে চন্দ্রবোড়া বা রাসেল ভাইপারের উপস্থিতি। একটার পর একটা সাপ মারছে মানুষ। বন্যপ্রাণীর ওপর এমন নির্দয় আচরণ আর কত সইবে প্রকৃতি। বন্যপ্রাণীর লাগামহীন অবৈধ বাণিজ্য আর লালসার বাজারই তো আজ এই বৈশ্বিক মহামারী তৈরির পাটাতন তৈরি করেছে। এই করোনারকালেও যদি মানুষ হিসেবে এখনো আমাদের বোধোদয় না হয় তবে আর কীভাবে আমরা শিক্ষা লাভ করবো? দুনিয়ায় কী এমন ঘটার বাকি থাকলে আমরা মানুষ হিসেবে আমাদের নির্মমতা বন্ধ করবো?
৫.
মাত্র দশ হাজার বছর আগে হাজার উদ্ভিদ প্রজাতি থেকে মানুষের খাদ্যের জোগান আসতো, আজ মাত্র চারটি শস্যফসল মানুষের খাদ্যবাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। ঐসময়ে দুনিয়ায় মানুষ ছিল এক ভাগ আর বন্যপ্রাণ ছিল ৯৯ ভাগ। আজ মানুষ হয়েছে ৩২ ভাগ, গবাদি প্রাণিসম্পদ ৬৭ ভাগ আর বন্যপ্রাণ মাত্র এক ভাগ। দুনিয়াজুড়ে নির্দয়ভাবে উধাও হচ্ছে বন্যপ্রাণের জাত ও পরিসংখ্যান। প্রতিবেশবিমুখ এই উন্নয়ন বাহাদুরিই একের পর এক নানা অসুখ ও মহামারী ডেকে আনছে। যার প্রভাব জীবনযাপন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রনীতি, অর্থনীতি কী বৃহৎ সামাজিক প্রক্রিয়ায় ছড়িয়ে পড়ছে। করেনারকালে আমরা বেসামাল হয়ে আছি কেবলমাত্র মানুষের সুরক্ষায়। আমাদের সবকিছু কেন্দ্রীভূত হয়েছে প্রজাতি হিসেবে এক মানুষকে ঘিরে। কিন্তু আমাদের চারপাশের গৃহপালিত থেকে শুরু করে চিড়িয়াখানায় বন্দি কী অরণ্যনির্ভর বন্যপ্রাণের সুরক্ষা বিষয়ে আমরা কোনো চিন্তিা করছি না। করোনারকালে দেশের গৃহপালিত কি রাস্তাঘাটের প্রাণিকূলসহ বন্যপ্রাণীদের সুরক্ষায় রাষ্ট্রকে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। স্থানীয় জনগণকে এই সুরক্ষামঞ্চে সামিল হতে হবে। আশা করি পরিবেশ-বন ও জলবায়ু বিষয়ক মন্ত্রণালয় দেশের স্থানীয় সরকারের সাথে এই কাজটি শুরু করবেন অচিরেই।
…………………………………………………………………………
লেখক ও গবেষক।