আশিস রহমান ::
করোনা ভাইরাসের প্রকোপে বেকার কর্মহীন হয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন অজোপাড়া গাঁয়ের খেটে খাওয়া প্রান্তিক মানুষ। কাজ করতে না পারায় স্ত্রী সন্তান সন্তুতি নিয়ে কোনো রকমে খেয়ে না খেয়ে ঘরবন্দী বেকার সময় পার করছেন তারা। এইসব প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ সহায়তা আসলেও খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে বেশিরভাগ অস্বচ্ছল পরিবারই বাদ পরেছেন ত্রাণ সহায়তা থেকে। অনেক এলাকায় দেখা গেছে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের প্রত্যক্ষ/পরোক্ষ সহযোগিতায় কর্মহীন অস্বচ্ছলদের ত্রাণ সহায়তা ভোগ করছেন স্বচ্ছল পরিবারের লোকজন। ত্রাণ বন্টনে ইউপি চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্যদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা লক্ষ্য করা গেছে। সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, ওয়ার্ড ভিত্তিক ইউপি সদস্যদের ত্রাণের তালিকায় কর্মহীন অস্বচ্ছল পরিবারের কেউ স্থান না পেলেও তার বদলে স্থান পেয়েছেন ভিজিএফ/ভিজিডি কার্ডের একাধিক সুবিধাভোগীরাও।
দোয়ারাবাজার উপজেলার সুরমা ইউনিয়নের ০৭ নং ওয়ার্ডের আলীপুর, হাছনবাহার ও বৈঠাখাই গ্রামের ৫০ জনের ত্রাণের তালিকায় নাম আসেনি কর্মহীন হতদরিদ্র পরিবারের লোকজনদের অনেকেরই। আলীপুর গ্রামের উত্তর পাড়ার বাসিন্দা বাউল ফুল মিয়া। ৬ সদস্যদের সংসার তার। মাথাগোজার ঠাঁই একমাত্র ভিটেবাড়ি টুকু ছাড়া নেই কোনো ফসলি জমি। বছরের বেশিরভাগ সময় রাতবিরাতে গ্রামের বিভিন্ন বাউল গানের আসরে গান গেয়ে যে কয় টাকা পান তা দিয়ে কোনোরকমে সংসারের ব্যয় নির্বাহ করেন তিনি। করোনাকালে জনসমাগম নিষিদ্ধ হওয়ায় প্রায় মাস খানেক সময় ধরে বেকার ঘরবন্দী সময় পার করছেন তিনি। স্ত্রী সন্তান সন্ততির খাবারের যোগান দিতে এখন হিমশিম খেতে হচ্ছে তাকে। পরিবারের ব্যয় নির্বাহ করতে গিয়ে তিনি ইতোমধ্যে ঋণগ্রস্তও হয়ে পরেছেন। অস্বচ্ছল হওয়া স্বত্ত্বেও পাচ্ছেন না কোনোধরনের ত্রান সহায়তা। গ্রামের একই পাড়ার বাসিন্দা দুই সন্তানের জননী নূর জাহান বেগম। স্বামী আলী আকবর মানসিক বিকারগ্রস্ত পাগল দীর্ঘ দিন ধরে এলাকা ছাড়া। বিভিন্ন বাড়িতে বাড়িতে কাজ করে সন্তানদের ভরণপোষণের ব্যয়নির্বাহ নূর জাহান বেগমকেই করতে হয়। করোনায় মানুষের বাড়িতে কাজ করা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সন্তানদের নিয়ে বেকায়দায় পরেছেন তিনি। কোনো রকমে খেয়ে না খেয়ে থেকে এখন সামনের দিনগুলো নিয়ে অন্ধকার দেখছেন তিনি। তার পরিবারের কারোরই নাম নেই ওয়ার্ড ভিত্তিক সরকারি ত্রাণের তালিকায়। পাচ্ছেননা অন্যান্য কোনো সরকারি সুযোগ সুবিধাও।বাজারের সেলুন ব্যবসায়ী সাগর দাস। বাজারের ছোট্ট সেলুন দোকানে চুলকেটে সংসার চলে তার। করোনায় জীবিকার একমাত্র মাধ্যম সেলুন দোকান কয়েক সপ্তাহ ধরে বন্ধ থাকায় পরিবারের সাংসারিক খরচ যোগাতে এখন দিশেহারা তিনি। পাচ্ছেন না কোনো ধরনের ত্রাণ সহায়তাও। একই গ্রামের পশ্চিম পাড়ার বাসিন্দা ভ্রাম্যমাণ শুটকি ব্যবসায়ী সিরাজ মিয়া। স্থানীয় বাজারের শুটকি বিক্রি করে ৪ সন্তানের পড়াশোনার খরচসহ, নিজের চিকিৎসা ও সাংসারিক খরচ চালাতে বছরের পুরোটা সময়ই তাকে নুন আনতে পান্তা ফুরোয় অবস্থা অতিক্রম করতে হয়। অভাব অনটনের মধ্যে খেয়ে না খেয়ে বেচেঁ থেকে করোনায় জীবিকা নির্বাহের শেষ সম্বল সামান্য শুটকি ব্যবসাটুকুও বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এখন অসহায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন। তার পরিবারও পাচ্ছেনা কোনো ধরনের সাহায্য সহযোগিতা। সামনে হয়তো পরিবারের সবাইকে নিয়ে উপোস থেকে মরতে হবে এই দুশ্চিন্তায় দিন কাটছে তার। এই অবস্থা শুধুমাত্র আলীপুরের বাউল ফুল মিয়া, নূর জাহান, সেলুন ব্যবসাী সাগর দাস কিংবা শুটকি ব্যবসায়ী সিরাজ মিয়ার বেলাতেই সীমাবদ্ধ নয়। উপজেলার সুরমা ইউনিয়নের ০৭ ওয়ার্ডের আলীপুর, হাছনবাহার, বৈঠাখাই গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে ঘুরে এরকম প্রায় অর্ধশতাধিক পরিবারের করুন অবস্থা দেখা গেছে। যারা করোনাকালে প্রকৃত পক্ষে কর্মহীন অস্বচ্ছল হয়েও পাচ্ছেন না কোনো ধরনের সরকারি সুযোগ সুবিধা। সরকারি ত্রাণের তালিকায়ও আসছেনা তাদের কারোরই নাম। তাদের বদলে কর্মক্ষম এবং আর্থিক ভাবে স্বচ্ছল অনেকের নামই উঠে আসতে দেখা গেছে এই ওয়ার্ডের সরকারি ত্রাণের তালিকায়। এদিকে ত্রাণ বিতরণের বেলায়ও অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলা দেখা গেছে। সরকারি ভাবে গণজমায়েত নিষিদ্ধ থাকলেও গত ৯ এপ্রিল বৃহস্পতিবার সকাল নয়টায় ত্রাণ দেওয়ার কথা বলে আলীপুর বাজারে ৫০টি পরিবারের সদস্যদের গণজমায়েত করা হয়। শেষ পর্যন্ত আলীপুর সমাজকল্যাণ পরিষদ নামের একটি সামাজিক সংগঠনের যুবক ও স্থানীয়রা ত্রাণের তালিকায় অস্বচ্ছলদের বাদ পড়া নিয়ে প্রতিবাদ করলে পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই সকালের নির্ধারিত সময়ে ত্রাণ বিতরণ স্থগিত রেখে দিনভর ভুক্তভোগীদের অপেক্ষায় রাখা হয়। পরে বিকাল তিনটার দিকে গণজমায়েত করে গ্রাম পুলিশের মাধ্যমে ত্রাণ বিতরণ করা হয়। ত্রাণ বিতরণের সময় অনুপস্থিত ছিলেন স্থানীয় ইউপি সদস্য। এব্যাপারে স্থানীয় বাসিন্দা অস্বচ্ছল মুদী দোকানী আমিরুদ্দিন বলেন, ‘যেসব বাড়িতে ভোটার সংখ্যা বেশি তাদেরকেই তালিকায় নাম দেওয়া হয়েছে। মেম্বারের কাছে বার বার বলার পরেও আমাদের মতো গরীবদের নাম তালিকায় আসেনা।’ স্থানীয় বাসিন্দা ব্যাংক কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম, প্রভাষক জামাল উদ্দিন ও আব্দুল হামিদ মাস্টার বলেন, ‘একাধিক সরকারি সুবিধা ভোগীর নাম ত্রাণের তালিকায় থাকলেও করোনায় কর্মহীন হয়ে যাওয়া অসহায় হতদরিদ্র নিন্ম আয়ের কারোর নামই তালিকায় আসেনি। আমরা মেম্বারকে ধরলে তিনি চেয়ারম্যানের কথা বলেন। আলীপুর সমাজকল্যাণ পরিষদের সভাপতি মাহমুদুর রহমান রাসেল বলেন, ‘ত্রাণের তালিকা করার সময় এলাকার স্থানীয়দের সাথে সমন্বয় করা হয়নি। যেকারণে তালিকায় প্রকৃত কর্মহীন অস্বচ্ছলদের নাম উঠে আসেনি। আমরা স্থানীয় ইউপি সদস্যের সাথে এব্যাপারে আলোচনা করলে তিনি কিছুই জানেন না বলে জানিয়েছেন।’ এব্যাপারে জানতে চাইলে স্থানীয় ইউপি সদস্য আব্দুল কাদির বলেন, ‘তালিকায় সবার নাম আমি দেইনি। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও তার লোকজন অনেকের নাম দিয়েছেন। সরকারি একাধিক সুবিধাভোগীর নাম কিভাবে আসলো তা আমি জানিনা।’ সুরমা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান খন্দকার মামুনুর রশীদ প্রতিবেদককে বলেন, ‘ত্রাণের তালিকায় স্থানীয় কর্মহীন হতদরিদ্রদের নাম দিতে ইউপি সদস্যদেরকে বলা হয়েছে। এখানে তাদের বদলে স্বচ্ছল ও সুবিধাভোগীদের নাম কিভাবে এলো আমার জানা নেই। মোবাইলে অনেকেই অভিযোগ জানিয়েছেন। লিখিত অভিযোগ পেলে দেখব।’ মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সোনিয়া সুলতানা বলেন, ‘কর্মহীন অস্বচ্ছলদের ছাড়া স্বচ্ছল কিংবা অন্য কোনো সুবিধাভোগীদের নাম ত্রাণের তালিকায় দেওয়ার কোনো নিয়ম নেই।সরকারি ত্রাণ বিতরণে কোনো ধরনের অনিয়ম হতে দেওয়া হবেনা। বিষয়টি আমি খোঁজ নিয়ে দেখব।’