1. haornews@gmail.com : admin :
  2. editor@haor24.net : Haor 24 : Haor 24
রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০১:৩৬ অপরাহ্ন
সংবাদ শিরোনাম ::

করোনা আক্রান্ত দেশ : হাওরের কৃষক দিশেহারা।। অধ্যাপক চিত্তরঞ্জন তালুকদার

  • আপডেট টাইম :: বুধবার, ৬ মে, ২০২০, ১০.২৯ এএম
  • ২৯৭ বার পড়া হয়েছে

হাওরের কৃষি এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পেশা। শত সমস্যা মাথায় নিয়ে হাওরের কৃষক ধানচাষ করে এটা যেমন ঠিক অন্যকোন উপায় নেই তাই সারাবছরের সংসারের চিন্তায় ক্ষেত না করে কোন উপায় নেই। অন্য যেকোন সরকারি নিবন্ধিত ছোট চাকুরে বা পেশার লোককে প্রভূত সুবিধা দিলেও এ কৃষিকাজের পেশায় যাবে না তা পরীক্ষিত। আজীবন লালিত অব্যবস্থার সাথে পৃথিবী কাঁপানো ‘করোনা ভাইরাস’র প্রকূপ ভাটির হাওরের কৃষক বা বসতিকেও প্রথমত ভীত করেছে। কিন্তু করোনা’য় ভীত হবার উপায় নেই কেননা ‘করোনা’র আগে পেটের ক্ষুধায় মরবে বুঝে ভয়-ভীতি সব ভুলে গেছে। চৈত্রের শেষ সপ্তাহ, রাত পোহাতেই যখন কৃষক দেখলো তাঁর ক্ষেতের ধানের শীষে হলুদ রঙ্গের সোনালী আভা, কেটে গেলো ‘করোনা’র অশুভ ছায়া। আগত অভিশপ্ত ‘১৪২৭ বঙ্গাব্দ’কে আশীর্বাদ মেনে শিরোধার্য করে ধানকাটার শ্রমিকের খোঁজে বেড়িয়ে পড়ে। শিরদ্বারা উঁচু করে কৃষক আরও একবছর বাঁচার আশায় ফসল তোলার যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে যায় উবে যায় ‘করোনা’র ভয়।
ভাটির হাওরে প্রতি এক দশক পরে পরে একটি বড় দুর্যোগ আসে বাকি বছরগুলি কমবেশি ভালোমন্দে অতিবাহিত হয়। বছরগুলিকে ভাগ করলে সোনার বৈশাখ, খরাশুকনা ও ঝড়বাদলের কাচইরা বৈশাখ ইত্যাদি নামে অভিহিত করা যায়। বছরের বৈশিষ্ট হিসেবে এবারের বৈশাখ খরা-শুকনা হওয়ায় ধান গোলা-শুকনা করতেও কৃষকের বেগ পেতে হবে না। শুরুতে ধানকাটার শ্রমিকের একটা সংকট থাকলেও করোনা ভাইরাসের বদৌলতে দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সব সাময়িক বেকার লোকেরা এলাকায় অবস্থান করায় ধানকাটায় সহায়ক শক্তি হিসেবে ফসল ঘরে তুলে সহায়তা করেছে। ষাট ভাগ ফসল কাটা হয়ে গেছে আগাম বন্যার ঝুঁকি চলে যাওযায় বাকিটুকু কেটে তুলতে আর অসবিধা হবে না আশা করা যাচ্ছে। সামনে এখন যে দুর্যোগ তা হলো মহাজনের তাড়া আর পানির দামে ধান বিক্রি করার কান্না। হাওরে প্রতি কেয়ার বা বিঘা জমিতে হাল, বীজ, সার, পানিসেচ, ক্ষেত লাগানো-বাছার কামলা, খরচ হয় প্রায় সাড়ে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা। আগে ভাগালু ভাগে ধান কাটতো ফলে ধানকাটার খরচ কৃষকের তেমন গায়ে লাগতো না। কিন্তু এখন ভাগালু বা বেপারি ধানের ভাগ নেয় না নগদ টাকায় ধান কাটে। ফলে এক কেয়ার বা এক বিঘা জমিতে ধান গোলায় তোলা পর্যন্ত খরচ দাঁড়ায় কমবেশি সাত হাজার টাকা। তিন কেয়ার বা তিন বিঘায় এক একর আঞ্চলিক হিসাবে চার একরে বা বারো কেয়ারে এক হাল জমির উৎপাদন খরচ হয় ষাট হাজার টাকা। কিন্তু ধান কাটার খরচ কেয়ার প্রতি দুই আড়াই হাজার টাকাসহ মোট খরচ দাঁড়ায় ‘প্রতি হালে’ চুরাশি হাজার টাকা। হাওরে এক টাকায় দেড় টাকা হিসাবে অর্থ্যাৎ দেড়া সুদে এক হাল জমির খরচ এক লাখ ছাব্বিশ হাজার টাকা। চার পাঁচ জনের সংসারে প্রতি মাসে দশ হাজার টাকা হাট-বাজার ও আনুষঙ্গিক খরচ ধরলে এক লাখ বিশ হাজার টাকা বাৎসরিক সংসার খরচ, ধান উৎপাদনের খরচের সাথে যোগ করলে মোট ব্যয় হয় দুই লাখ ছিচল্লিশ হাজার টাকা। প্রতি বিঘায় বিশ একুশ বা সাড়ে একুশ মণ দরে ধান হলে প্রতি হালে দুই শ’ ষাটমণ ধান হয়। মোট ব্যয় দুই লাখ ছিচল্লিশ হাজার টাকাকে দুই শ’ ষাট দিয়ে ভাগ করে দেখুন নয় শ’ ছিচল্লিশ টাকা কৃষকের এক মণ ধান ফলাতে ব্যয় হয়। এই ধান যদি আট শ’ সাত শ’ ছয় শ’ টাকা বিক্রি করে তার তিন থেকে সাড়ে তিন শ’ টাকা প্রতি মণে লোকসান হয়। এভাবে প্রতিমণে বছরের পর বছর লোকসান দিতে দিতে একজন কৃষক কি আর কৃষক থাকে ? না ক্ষেতকামলা বা ক্ষেতমজুরে পরিণত হয়। এই জমি করতে বিঘা বা একর প্রতি যে খরচ, সে হিসেবে এক হাল জমির ব্যয়ের হিসাব অনুযায়ী প্রতিমণ ধানের উৎপাদন খরচটা দেখলেই পাঠক বিষয়টি পরিস্কার বুঝবেন। সরকার বাহাদুর নাম-মাত্র একটি ধান কেনার রেট দিয়ে রাখে, জানে এরা ধান গোডাউনে দিতে পারবে না। রাস্তাঘাট নেই যখন দেওয়ার সুযোগ হবে নৌ-পথ হবে তখন এদের ধান থাকবে না, ধান দেবে সরকার দলের ভাড়াটে লোকেরা।
সুনামগঞ্জে দুই লাখ তেইশ হাজার হেক্টর বোরো জমিতে নিয়ম মাফিক নয় লাখ টন ধান উৎপন্ন হয়। বিগত বছরে ধানের দামে লোকসান দেওয়ার কারণে চলতি বছর (২০২০ সনে) চার পাঁচ হাজার হেক্টর জমি পতিত রয়েছে। তবে আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় বাম্পার ফলন হয়ে এবার বারো লাখ টন ধান কৃষকের গোলায় উঠবে বলে সর্বমহলের ধারনা। সব ঠিক থাকলেও কৃষকের কপাল ভাঙ্গে যখন সরকার কৃষকের অনুকূলে সরকারি ক্রয়কেন্দ্রে যথাসময়ে ধান কেনে না, সরাসরি কৃষকের নিকট থেকে ধান কেনে না।
জেলা প্রশাসনের এক জনবিজ্ঞপ্তিতে জানা যায় সরকার সুনামগঞ্জে পঁচিশ হাজার মে: টন ধান, সিদ্ধ-আতপ মিলিয়ে ঊনত্রিশ হাজার টন চাল কিনবে। কৃষকের ক্ষেতে ফলে ধান সরকার কেনে চাল তা চাতাল মালিকের দিক চিন্তা করেই যে করা হয় তা বুঝিয়ে বলতে হয় না। জেলায় সরকার ঘোষিত ক্রয় লক্ষমাত্রা ধানের হিসেবে ধরলে সরকার সত্তর বাহাত্তর হাজার টন ধান কিনছে। জেলায় যেখানে ধান ফলে বারো লাখ টন, সরকার কিনে হাজারের মাপে। এটা সুনামগঞ্জের এক ফসলী কৃষক ও জেলাবাসীর জন্য অত্যন্ত বেদনাদায়ক, অপমানকর। ২০১৭ সনে হাওর দুর্যোগের পর থেকে বাংলাদেশ কৃষক সমিতি, জেলা ভিত্তিক সংগঠন ‘হাওর বাঁচাও সুনামগঞ্জ বাঁচাও আন্দোলন’ ও ‘হাওরের কৃষি ও কৃষক রক্ষা সংগ্রাম পরিষদ’ যুগপৎভাবে দাবি জানিয়ে আসছে হাওরে উৎপাদিত ধানের অর্ধেক সরকারকেই কিনতে হবে। ডুবো হাওর এলাকা বিধায় অন্য এলাকার মতো দুই তিনটি ফসল ফলানোর উপায় নেই। তাই অন্যুন অর্ধেক ফসল সরকার না কিনলে সুনামঞ্জের কৃষক তথা কৃষিকে রক্ষা করা, কৃষক অধ্যুষিত জনবসতি টিকিয়ে রাখা যাবে না। কে শুনে কার কথা ! তাই বছর বছর সুনামঞ্জের কৃষক তিলে তিলে ধুকে ধুকে ঋণ-জালে আবদ্ধ হয়ে দিনে দিনে গরিব থেকে সর্বহারা হচ্ছে।
সুনামগঞ্জের উৎপাদিত অর্ধেক ফসল মানে ছয় লাখ মে: টন ধান সরকার কিনলে কী লাভ-ক্ষতি হয়, কৃষকের কী লাভ-ক্ষতি হয় আর একটি হিসাবে বুঝাচ্ছি ও দেখাচ্ছি।
সরকারি গোডাউন রেটে এক মে:টন ধানের দাম সাতাশ হাজার সাত শ’ আটত্রিশ টাকা, সে হিসেবে ছয় লাখ মে:টন ধানের দাম হিসাব করলে পুরো ধানটা কিনতে সরকারের মাত্র এক হাজার ছয় শ’ চৌষট্টি কোটি, চৌদ্দ লাখ টাকা প্রয়োজন। হাওরের কৃষকের জন্য এই টাকা সরকারের হাতে নেই তা তো বিশ্বাসযোগ্য নয়। করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর প্রধারমন্ত্রী ঘোষিত বাহাত্তর হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা থেকেও যদি সরকার ধানটুকু কেনে মহামারী উত্তর আগামী খাদ্য-সংকটে তা আশীর্বাদ হবে। বিগত বছরে সরকার যেভাবে চিন্তা করেছে এবছরও তাই করছে। জেলায় তিন লাখ সাতচল্লিশ হাজার নয় শত সাতাশ জন তালিকাভূক্ত কৃষক আছে। গত বছর লটারি করে বারো হাজার কৃষক নির্বাচন করে কার্ড দিয়েছে। যাঁরা লটারি পেলো না তাঁরা কি দেশের বাইরের লোক ? তাদের কথা কে ভাববে ? এটা কোন রাষ্ট্রীয় যুক্তিসংগত বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থা হতে পারে না। যাক্, পরের চিত্রটা দেখুন কী হয়েছে—লটারিপ্রাপ্ত প্রত্যেকের নিকট থেকে আধাটন মানে মাত্র তেরো ধান ক্রয়কেন্দ্রে কিনেছে। এটা কৃষকের সাথে পরিহাস করার শামিল। যে কৃষক পঁঞ্চাশ থেকে এক শ’ মণ ধান পানির দামে পাঁচ শ’ থেকে বড়জোর সাত শ’ টাকায় বিক্রি করে সরকারের দোয়ায় তেরো মণ ধান গোডাউনে বিক্রিতে তার আর কতটুকু সহায় হয়! এ বছর প্রথম বৈশাখে বাজারে ধানের দাম পৌণে আট শ’ টাকায় বিক্রি শুরু হলেও আজ ১৬ বৈশাখে ছয় শ’ টাকায় অবস্থান করছে। খাদ্যমন্ত্রী মাত্র উদ্বোধনের ফিতা কাটতে প্রস্তুত হচ্ছেন, যা ২৬ এপ্রিল হবার কথা ছিলো। এই করে করে সরকার যখন ধান কিনতে শুরু করবে এক থেকে চার টন ধান বিক্রি করতে পারে এমন কৃষকের ঘরে আর বিক্রির মত ধানই থাকবে না। কেননা এখন হাওর এলাকায় বারো আনা কৃষক ভাগচাষী বর্গাচাষী যারা কামলাকাটি দিয়ে পাঁচসাত কেয়ার বা বিঘা জমি লাগায়। এই পাঁচ সাত কেয়ার জমিতেই ভাগচাষী একশ’ দেড়শ’ মণ ধান পায়। বাকি দশ থেকে বিশটন ধান বেঁচতে পারে এমন কৃষক কম, তারা শেষ বর্ষায় চূড়ান্ত দাম দেখে ধান বিক্রি করে।
হাওরের কৃষক আর সেই আগের কৃষক নেই। কৃষির বেহিসেবি বা অসংলগ্ন ব্যয়ের ধাক্কায় বেশি জমির মালিক গৃহস্থরা আর পরিপূর্ণ চাষাবাদ করেন না। ’৮০ দশকে ক্ষেতমজুর আন্দোলন শুরু হওয়ার পর গ্রামীণ মজুররা ‘সমাজ বদলের রাজনীতি’ না বুঝলেও গৃহস্থের বাড়িতে ছয়মাস আটক থেকে যে লোকসান হয় তা বুঝেছে। ফলে এখন আর কৃষক গৃহস্থি করার মজুর পায় না জমি নিয়ে প্রায় বিপদেই আছে। এখন যারা জমি চাষ করে তারা অন্যের ক্ষেতে কামলা খেটেখুটে তিন থেকে ছয়-সাত কেয়ার বা বিঘা জমি ভাগে চাষ করে, এ সংখ্যাটাই বেশি। পঁচিশ ত্রিশ একর জমির গৃহস্থি করার মতো কৃষক এখন খুব কম।
আগামী দিনের হাওরে একটি অশনি সংকেতের কথা আলোচনা করেই লেখাটি শেষ করতে চাই। সুনামগঞ্জের হাওরে আশি পঁচাশি হাজার শ্রমিক ধানকাটার কাজে যুক্ত হয়। যে শ্রমিকটা তিন দশক আগে পর্যন্ত বরিশাল, ফরিদপুর, মুন্সিগঞ্জ, মানিকগঞ্জ থেকে অগ্রিম টাকা দাদন দিয়ে ধান কাটতে আসতো। আস্তে আস্তে দূরের শ্রমিক বোরো ধান নিজ এলাকায় উৎপাদন শুরু হলে তাদের আসা স্থবির হয়ে যায়। পাশাপাশি কাছের উঁচু এলাকার শ্রমিকেরা আসতো করোনা প্রাদুর্ভাবের কারণে এটাতে একটু নৈরাশ্য দেখা গেলেও সাময়িক বেকার শ্রমিকেরা মিলে এবার হাওরে প্রায় পঁচান্নব্বই হাজার শ্রমিকের এক জোয়ার সৃষ্টি হয়। কিন্তু ভাবনার ও দেখার বিষয় একইসাথে হারভেস্টার মেশিনের দাপটে হাওর এখন অন্যরূপ ধারন করছে, নিরাশার দিক হলো কৃষিশ্রমিক কর্মহীন হতে যাচ্ছে। উল্লেখ্য যে, এবছরই সুনামগঞ্জের হাওরে উনিশটি মেশিন ধান কেটেছে। কেননা হারভেস্টার মেশিন চলার মত এখন পঁচিশভাগ জমি শক্ত হয়েছে, দিনে দিনে পরিমানটা বেড়ে পঁঞ্চাশভাগ বা পঁচাত্তরভাগ হবে। আনুপাতিক হারে আগামী বছর পর্যন্ত পঁঞ্চাশভাগ কৃষি-শ্রমিক বেকার হয়ে যাবে। হারভেস্টার বা রিপার মেশিন তাড়াতাড়ি ধানকাটা এবং একইসাথে মাড়াইয়ের কাজটা সম্পন্ন করতে পারে। তাতে কৃষকের দুটি কাজ একই সঙ্গে হয়ে যাওয়ায় কৃষক একটা প্রশান্তিও অনুভব করছে। কিন্তু প্রতি কেয়ার বা বিঘা জমি কাটতে টাকা নিচ্ছে তিন হাজার টাকা যা চারজন ক্ষেতমজুর এক কেয়ার জমি কেটে নিয়ে থাকে দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা। কৃষক হারভেস্টারের মাধ্যমে কাটা-মাড়াই করে একটু সময় বাঁচাতে পারলেও ভবিষ্যতে হাওরের কৃষি ও কৃষক পরাশ্রয়ী হতে যাচ্ছে এতে কোন সন্দেহ নেই। তাই ‘হাওরে হারভেস্টার’ বিষয়টি নিয়ে এবং হাওরের শ্রমিক-কর্মসংস্থান নিয়ে বিশেষজ্ঞ মহলের একটু ভাবনা ও দৃষ্টিদান প্রার্থনা করছি।
লেখক: অধ্যাপক কমরেড চিত্তরঞ্জন তালুকদার, সভাপতি- সিপিবি, সুনামগঞ্জ জেলা কমিটি। সভাপতি হাওরের কৃষি ও কৃষক রক্ষা সংগ্রাম পরিষদ।

Print Friendly, PDF & Email

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর
themesbazarhaor24net
© All rights reserved © 2019-2024 haor24.net
Theme Download From ThemesBazar.Com
error: Content is protected !!