(শেখ লুৎফর এই সময়ের শক্তিমান কথাশিল্পী। তিনি যখন লেখেন তখন কমিউনিটির ভিতর-বাহিরটার সম্পূর্ণনা দেখেন। পচাগলা ভালোমন্দ দুটোই। হাওরের মাটিগন্ধা মানুষকে নিয়ে তার এই ছোট গল্প। উন্নয়ন, অবকাঠামো কিভাবে গিলছে হাওর তার রূপটা দেখা যায়। একই সঙ্গে হাড়ভাঙ্গা খাটুনিতে জীবনজয়ী কৃষকের পার্সোনালিটি এক অন্যরকম শ্রদ্ধা জাগায়। অনন্য হাওর গ্রুপের জন্য এই লেখাটি পাঠিয়েছেন কথাশিল্পী। আমরা হাওরবাসী তাকে স্যালুট জানাই।)
শীতকালে সবুজে সবুজে সয়লাব হাওরে ঘুরে বেড়ানো আমার পুরানা বাতিক। তাই একটু সুযোগ পেলে দম নেবার জন্য সংসারের ঝক্কি-ঝামেলা থেকে যখন-তখন পালাই। সে-বার নিজের জন্য আস্ত একটাদিন হাতে নিয়ে সকাল সকাল বেরিয়ে পড়েছিলাম। সারাটা সপ্তাহ মানুষের মুখাবয়বের জটিল আঁকিবুকি দেখতে দেখতে যখন নিজের নফছ্ বিগড়ে যায়, পেট আর চেটের জন্য ছুটতে ছুটতে নিজেকে মানুষ ভাবতে ঘিন্না লাগে, তখন এই হদ্দ সংসারের বেড়া-জাল ছিঁড়ে কে-না চোরের মতো একা হতে চায় ?
বাস-রিক্সা বদল করে চিলাউড়া পয়েন্টে সিএনজি-তে উঠে বসি। গন্তব্য নলুয়ার হাওর। হঠাৎ উজান থেকে ছুটে আসা ঢল কিংবা অতি বৃষ্টিতে নলুয়ার হাওরের বরো ধান তলিয়ে গেলে, এলাকার মানুষজনকে বহুবার আক্ষেপ করে বলতে শুনেছি : ‘বাংলাদেশের একদিনের খোরাকি, নওল্ল্যার হাওর মারা খাইছেরে !’ তাদের অন্ধবিশ্বাস, সহিসালামতে নলুয়ার হাওরের সব ধান কৃষকের গোলায় তুলতে পারলে বাংলাদেশের সতের কোটি মানুষের একদিনের খোরাকি হয়।
হাওরের মাঝ দিয়ে সাবমার্সেবল সড়ক ধরে সিএনজি টানা বিশ-পঁচিশ মিনিট ছুটার পর কামারখাল নদীর পাশে আমি নেমে পড়ি। দশ-বারো বছর আগেও হাওরের ধান কাটার জন্য টাঙ্গাইল-সিরাজগঞ্জ থেকে কামলারা বড়ো বড়ো নাও নিয়ে, চৈত-বৈশাখে এই কামারখাল নদী দিয়ে একদম হাওরের বুকের কাছে চলে আসত। তারবাদে ফসল রক্ষা-প্রকল্পের নামে এখানে অপরিকল্পিত, অপরিণামদর্শী একটা সুইচ গেইট হলো। এই কারণে পলি জমে জমে এখন কর্তিকের পরেই নদীটা মরে যায়। আমি সিএনজি থেকে নেমে, করুণ চোখে মরা নদীর ফাঁটা বুকের দিকে তাকিয়ে থাকি।
একটু দূরে হিজল বনের সারি। সেই দিকে তৃষ্ণিত নয়নে তাকিয়ে থাকি। পরম শান্তিতে নড়তেও ভুলে গেছি। তাই মাছির পুঞ্জাক্ষি ঘুরানোর মতো ধীরে ধীরে মাথাটা ঘুরিয়ে হাওরটা দেখছি। উত্তরের গ্রামগুলো এখনো নজরের বাইরে। দক্ষিণ দিকটাও আবছা আবছা কালচে-সবুজ। পশ্চিম-দক্ষিণ কোণার দিকে একটা বিশাল চারণ ভুমি ছিল। সেখানকার একটা বড় অংশ সরকার যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদেরকে খয়রাত করেছে। তাই ধানের জমিন বাড়লেও উজ্জ্বল চন্দ্রপৃষ্ঠের মতো অর্ধবৃত্তাকার হরিৎ তৃণভূমিটা এখন আর আগের মতো নজর কাড়ে না। পুব দিকের ওই গ্রামটা গত দশ-বারো বছর ধরে রূপকথার রাক্ষসের মতো চুপি চুপি হাওরটা গিলতে গিলতে এবার একেবারে আগ্রাসী হয়ে ওঠেছে। গতবছর এলজিইডি হাওর ঘেঁষে যাওয়া গ্রামের সড়কটা পাকা করে দিয়েছে। আর এই সড়কটাই এখন বাজিকরের মতো গ্রামের ঘন বসতি থেকে লোকজনকে ডেকে ডেকে হাওরের দিকে পঙ্গপাল নিয়ে আসছে।
অনেক উঁচু উঁচু অন্তত দশটা ভিটিতে এবছর ঘর উঠছে। এখনো দুইটা ভেকু মেশিন গুমগুম শব্দে মাটি কাটছে। অধিকাংশই টিনশেড হাফবিল্ডিং। বিদ্যুতের বিশাল বিশাল খাম্বা, নীল আকাশের পটভ’মিতে তেত্রিশ হাজার ভোল্টেজের হাবি-জাবি, ডিশের লাইন, হাগু-মুতোর টাট্টি-ফাট্টি…আরও বাল-ছাল কত কিছু যে খাটশ-পিশাচের মতো বসতিটা ঘিরে হাওরের দিকে দাঁত-ধরাচ্ছে।
একটা সিগারেট ধরিয়ে, মাথা নুয়ে নুয়ে হিজল-সারির দিকে হাঁটি। বোঝতে পাড়ি, এই টুকুতেই মনটা মাটি হয়ে গেছে। তাই ইচ্ছা করছিল পেন্টের চেইন খুলে এইসব কিছুর মুখে একদফা হাত মেরে দেই। কিন্তু বিশাল ওই ঐশ্বর্যময়ী-প্রাণময় সবুজারণ্যের কাছে নিজেকে আর ছোট করতে সাহস হল না।
মাকে মনে পড়ে। ব্যাংক লোনের টাকায় যেদিন প্রথম টিভি-ফ্রিজ কিনে নিয়ে আসি মায়ের সেদিনের কথাটাও মনে পড়ে। টিভিটা ঠিক ঠিক জাগায় সেট করার পর মা ডাকল। পাশে যেতেই বললে, ফ্যানডা ছাইড়া আমার কাছে ব।
মায়ের নড়বড়ে শরীর। আমি তার শিরা ওঠ কুঁচকানো চামড়ার একটা হাত হাতে নিয়ে পাশে বসি। মায়ের হাত-পায়ের নখগুলো খুব শক্ত আর পুরু পুরু। আমি নখগুলো দেখতে দেখতে তাঁর শতাব্দী ছুঁই ছুঁই জীবনের ঘ্রাণ পাই। মা আমার হাতটা তার দুই হাতে নিয়ে বলে, কেল্লিগ্যা এইসব আলতু-ফালতু জিনিসের পিছে রক্ত-পানি-করা ট্যাহা খরচ করস ?
চকচকে নীল পানির জলাশয়টা সামনে নিয়ে বয়বৃদ্ধ একটা হিজল গাছের তলে বসি। মাঘ মাসে শীতের জোর কমে যায়। দুপুরের দিকে রোদটাও চড়ে। তাই একটু একটু গরম বাতাস আর গম্ভীর-কালচে-সবুজের নির্জনতায় আরেকটা সিগারেট ধরাই। ধানের এখন উঙ্কুর (তরুণ) বয়স। সপ্তাখানেকের মাঝেই শীষ ছাড়বে। এখন ক্ষেতে ক্ষেতে ঘাসবাছা, সার দেওয়া চলছে। সব-ই একদম নীরবে। বিধাতার এই অপার্থিব-বিশাল-ভুবনে এসে নামলে সবার মন-ই বোধ করি কেমন হয়ে যায়। নিজেকে খালি তুচ্ছ তুচ্ছ লাগে। হয়ত ইন্দ্রীয়ের সেই অবচেতন চাপ থেকেই সকলে নিজের অজান্তে নির্লিপ্ত এই প্রকৃতির কাছে নিজেকে নিশ্চুপে সোঁপে দেয়।
গাছে হেলান দিয়ে ঝিঁমাচ্ছি। খস খস শব্দে চোখ খুলি। খাড়া নেংটিকাছা একজন বুড়ো মানুষ কার্পেটের মতো ঘন-মোলায়েম ঘাসে ঘঁষে ঘঁষে হাতের জল-কাদা মুছছে। আমি বোতল থেকে এক কুল্লি পানি খেয়ে সিগারেট ধরাই। দুপুরের মিষ্টি রোদে হাওর তার তাবত সৌন্দর্য ও সম্পদের চুড়ান্ত মহিমায় হৃদয়-মন স্তব্ধ করে দেয়। এখন পুব দিকের ওই উঠতি গ্রামটার হিজিবিজি মুছে দিতে পারলে হাওরটা সেরকম লাগত ! আমি এক নজরে গোটা হাওরটা আবার দেখছি। লোকটা ছোট্ট একটা গলা খাঁকারি দিয়ে বললে, আগুনটা দ্যাইন।
দেখি লোকটা একটা বিড়ি ঠোঁটে গোঁজে আগুনের জন্য আমার দিকে হাত বাড়িয়ে আছে। আমি একটা সিগারেটসহ লাইটারটা তার হাতে তোলে দেই। ভেজা, স্যাঁতসেঁতে-ঠা-া একটা আঙুল আমার আঙুলে লাগলে তার ভাঙাচুরা জীবনের নিবুনিবু পরশ পাই।
অধিকাংশ হাওরবাসীর মতো এই লোকটাও অকালে বুড়িয়ে গেছে। সামনের তিনটা দাঁত পোকায় কেটে কেটে বারো আনাই সাবার করে ফেলেছে। লাইটারটা ফেরত দিতে দিতে বিষণœ মানুষটা আড় চোখে আরেকবার আমাকে দেখে। আমার হৃদয় দু-চোখের দৃষ্টিতে সীমাহীন হাওরে ছড়িয়ে দিয়ে নিজের মাঝে ডুব দেই। লোকটা সিগারেট শেষ করে আবার গলা খাঁকারি দেয়, সাইব একটা কথা আছিন।
তার গলার শব্দে আমার ভেতরটা ধড়মড় করে ওঠে। কেমন একটা দুঃখগন্ধী বহু পুরোনো কান্নার রেশ। আমি বাইরে বেরোলেই চেতনে-অবচেতনে গল্প খুঁজি। এখন আমার আত্মা বলছে, লোকটার অলহমে (কণ্ঠনালী) একটা ছোটগল্প বসে উঁকি দিয়ে দিয়ে আমাকে দেখছে। আমি লোকটাকে আরেকটা সিগারেট দিয়ে নিজেও একটা ধরাই। হাওরের প্রকৃতির মতো লোকটাও সহজেই আমাকে সমঝে নেয়। তাই ঘাসে পাছা ঘঁষতে ঘঁষতে সে আমার পাশে চলে এসে ফিসফিস করে বলে, আইচ্ছ্যা ‘পারছনালিটি’ জিনিসটা কী ?
আমি বুড়ো মানুষটাকে আরেকবার দেখি : তার জল-কাদায় মাখামাখি দড়কচা শরীর, সাদা রুক্ষ চুল-দাড়িতে শুকনা কাদার ছিট ছিট দাগ এবং বারো আনা খাওয়া তিনটা দাঁতের কালো গর্তে মানুষটার আটআনা জীবনের জ্যান্ত সাক্ষাৎ পাই। তাই একটু সতর্ক হয়েই বলি, একটা শব্দ দ্যায়া ত কিছু হয় না। প্রত্যেক শব্দের সামনে-পিছে আরও কিছু কিছু কথা থাকে, সেইসব জানতে পাড়লে আসল অর্থ ধরা সহজ হয়।
লোকটা কি বোঝল আল্লা জানে! সে অনেকক্ষণ মাটির দিকে নীরবে তাকিয়ে থাকে। তাবাদে বলতে শুরু করে, আমার নিজের কোনো সন্তানাদি নাই। ছোট ভাইয়ের একটা ছেলেরে নিজের কৈয়া মানুষ করছিলাম। বাজান আমার শহরে থাইক্যা বিএ পাশ করছিল। তে শহর থাইক্যাই তার বিয়ার একটা পরস্তাব আইল। কৈন্ন্যাও শহরের কলেজে পড়ে। পাত্রিপক্ষ পাত্র আর বাড়িঘর দেখতে আইল। বাজান আমার দেখতে এই বড়সড় থাপাতোলা রাজপুত্র। আমরা সব মুরুক্ষু-সুরুক্ষু তাই সে নিজেই তদারক কৈরা মেহমানগরে শরবত-চা-পান খাওয়াইল। দুপুরে খাইবার সময় হুনি মেয়ের বড় ভাই তার চাচার কাছে কৈতাছে, সবকিছু ঠিক আছে, খালি ছেলেটার পারছনালিটি নাই।
আমার মুখের ভাত গলায় আটকে গেল : সবকিছু যদি ঠিক থাকে তাইলে পারছনালিটি ঠিক থাকত না ক্যা ? এইডা কী এমন জিনিসি যার অভাবে একজন পাত্রের চৌদ্দ আনা যোগ্যতা মাটি অইয়া যায় ?
তালু চিনচিন করে জ্বলছে…হঠাৎ গজার মাছের ঘাইয়ের মতো মনের মইধ্যে কতাডা ভুস কৈরা উঠল : আমগর গৈ-গেরামে কত মাইয়া বিয়ার আড়াইদিন বাদে বাপের বাড়ি আইয়া ‘জামাইয়ের হেইডা নাই’ এই কতা কৈয়া বিয়া খারিজ কৈরা দ্যায়। তাইলে কি পাত্রির বড় ভাই হেই কতাই কৈবার ছাইতাছে? আগ-পাছ বিচার না-কৈরাই আমি মেয়ের চাচারে কৈলাম, কিযেন কথা, মাঝে মাঝে হে যহন পুকুর ঘাডে গামছা পিইন্দ্যা গোসল করে তহন দেখছি বিরাট তার পারছনালিটি।
আমার কথা হুইন্যা হেরাসব পাত্থর অইয়া গ্যাল। গপ্সপ্ কিম্বা খানাখাইদ্যে কারো আর মন বইল না। তিনদিন পরে পাত্রিপক্ষ খবর পাঠাইল, এইহানে তারা বিয়া দিত না।
অবশ্য মুহে মুহে এই কথা আগেই গেরামে রইট্যা গ্যাছিল। হাইঞ্জার পরে বাজানও ব্যাগ কান্দে লইয়া বাইর হইয়া গেলো। আইজ তিন বছর, হেইডাই তার শেষ যাওয়া।
লোকটা ধরাগলায় আমার কাছে আরেকবার লাইটারটা চায়। শেষ সিগারেটটাসহ আমি লাইটারটা তার দিকে এগিয়ে দেই। সে কিরিচ কিরিচ শব্দ তোলে সিগারেট ধরায়। খক্ খক্ কাশে। এবং মনের ভুলে পারসনালিটি শব্দটার অর্থ না-জেনেই কাশতে কাশতে জমিনের কাদা-জলে নেমে যায়। আমার আবার ঝিঁমানি আসে। ঝিমুতে ঝিমুতে দেখি মা আমার চোখের সামনে হাত নেড়ে নেড়ে বলছেন, ‘লোকটা শব্দটার মানে না-জাইন্যা ভালাই করছে। চৌপাশে মত্ত হাতির লাহান ধুন্ধুমার উন্নয়ন, অনাচার আর বস্তা বস্তা লুটের ট্যাহায় সয়লাব দেশে মানুষের কোনো পারসনালিটি থাক্তা পারেনারে বাজান…
শেখ লুৎফর, কথাসাহিত্যিক।