হাওর ডেস্ক ::
করোনাভাইরাস মহামারির চাপে স্বাস্থ্যব্যবস্থা দুর্বল হতে থাকায় এবং নিয়মিত স্বাস্থ্যসেবা বিঘ্নিত হওয়ায় বিশ্বে আগামী ছয় মাস প্রতিদিন স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে অতিরিক্ত ছয় হাজার করে শিশুর মৃত্যু হতে পারে। এর মধ্যে বাংলাদেশে মারা যেতে পারে অতিরিক্ত ২৮ হাজার শিশু। গতকাল বুধবার এ আশঙ্কা প্রকাশ করেছে জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ।
সংস্থাটি বলছে, বাংলাদেশে কভিড-১৯ মহামারির কারণে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের জরুরি স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তি উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। গত বছরের মার্চের তুলনায় এ বছরের মার্চে সেবা গ্রহণ ২৫ শতাংশ কমেছে।
নতুন এক গবেষণার বরাত দিয়ে ইউনিসেফ জানায়, বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ আরো কমে গেলে আগামী ছয় মাসে মহামারির পরোক্ষ প্রভাবে সম্ভাব্য সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে পাঁচ বছরের কম বয়সী অতিরিক্ত ২৮ হাজার শিশুর মৃত্যু হতে পারে। উচ্চতার অনুপাতে ওজন কম হওয়া, যা অপুষ্টির একটি ধরন, পাঁচ বছরের কম বয়সী এসব শিশুর মৃত্যুর ক্ষেত্রে একটি বড় ভূমিকা রাখবে।
দ্য ল্যানচেট গ্লোবাল হেলথ জার্নালে প্রকাশিত জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণার ভিত্তিতে শিশু মৃত্যুর আনুমানিক এই পরিসংখ্যান দেওয়া হয়েছে। মহামারি সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় উপনীত হলে ১১৮টি নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশে আগামী ছয় মাসের মধ্যে নিয়মিত স্বাস্থ্যসেবা বিঘ্নিত হয়ে ও শিশু অপুষ্টি বেড়ে পাঁচ বছরের কম বয়সী অতিরিক্ত ১২ লাখ শিশুর মৃত্যু ঘটতে পারে বলে সেখানে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।
ইউনিসেফ জানায়, এই ১১৮টি দেশে প্রতি ছয় মাসে পাঁচ বছরের কম বয়সী যে ২৫ লাখ শিশুর মৃত্যু হয় তার বাইরে এসব সম্ভাব্য শিশুমৃত্যুর কথা বলা হয়েছে এই গবেষণায়, যা প্রায় এক দশকে শিশুমৃত্যু রোধে অর্জিত অগ্রগতি পেছনে টেনে নেওয়ার হুমকি তৈরি করেছে। এসব দেশে একই সময়ে যে ১,৪৪,০০০ মাতৃমৃত্যু ঘটে, তার সঙ্গে আরো ৫৬,৭০০ মায়ের মৃত্যু যোগ হতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।
আগে থেকেই দুর্বল স্বাস্থ্যব্যবস্থার দেশগুলোতে কভিড-১৯-এর প্রভাবে মেডিক্যাল সরবরাহ ব্যবস্থা ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি অর্থনৈতিক ও মানবসম্পদের ওপর চাপ তৈরি হয়েছে। লকডাউন, কারফিউ ও পরিবহন চলাচলে বিঘ্ন এবং সংক্রমণভীতির কারণে স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোতে সেবাগ্রহীতাদের যাওয়া কমে যাচ্ছে। ল্যানচেটের প্রতিবেদনে এক মন্তব্যে ইউনিসেফ সতর্ক করেছে, এর মধ্য দিয়ে মাতৃ ও শিশু মৃত্যু বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বিপর্যয়কর পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।
জীবন রক্ষাকারী সেবা হ্রাসের প্রভাবে শিশু ও মাতৃ মৃত্যুর ক্ষেত্রে সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে কী হতে পারে সে রকম তিনটি পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করেছে প্রতিবেদনটি। এটি সতর্ক করে দিয়েছে, সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে যেখানে সেবা গ্রহণ ১৫ শতাংশ হ্রাস পাবে, সেখানে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু মারা যাওয়া ৯.৮ শতাংশ বাড়বে বা একদিনে আনুমানিক এক হাজার ৪০০ জনের মৃত্যু হতে পারে এবং মাতৃমৃত্যু ৮.৩ শতাংশ বাড়তে পারে। সম্ভাব্য সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির পাশাপাশি স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ ৪৫ শতাংশ কমে গেলে প্রতি মাসে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু মৃত্যু ৪৪.৭ শতাংশ এবং মাতৃমৃত্যু ৩৮.৬ শতাংশ বাড়বে। এসব স্বাস্থ্যসেবার মধ্যে পরিবার পরিকল্পনা, গর্ভকালীন সেবা, সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর, সন্তান জন্মদান, টিকা প্রদান এবং প্রতিষেধক ও আরোগ্য সহায়ক সেবা অন্তর্ভুক্ত। মহামারি নিয়ন্ত্রণে গৃহীত পদক্ষেপসমূহ অথবা চাপের মুখে স্বাস্থ্যব্যবস্থা ভেঙে পড়া, এড়াতে না পারা মর্মান্তিক ঘটনা—যেকোনো কারণেই স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ বিঘ্নিত হলে শিশু ও মাতৃ মৃত্যুর বৃদ্ধি হবে ভয়ানক।
ইউনিসেফ জানায়, মহামারির সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ কমে যাওয়ার ফলে যে ১০টি দেশে সর্বাধিকসংখ্যক অতিরিক্ত শিশুমৃত্যু ঘটার ঝুঁকি রয়েছে সেগুলো হলো—বাংলাদেশ, ব্রাজিল, গণপ্রজাতন্ত্রী কঙ্গো, ইথিওপিয়া, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, নাইজেরিয়া, পাকিস্তান, উগান্ডা ও তানজানিয়া। আর যে ১০টি দেশে সবচেয়ে বেশি অতিরিক্ত শিশুমৃত্যুর হার হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে সেগুলো হলো—জিবুতি, এস্তোনিয়া, লেসোথো, লাইবেরিয়া, মালি, মালাবি, নাইজেরিয়া, পাকিস্তান, সিয়েরা লিওন ও সোমালিয়া। এই দেশগুলোতে জীবনরক্ষাকারী সেবাসমূহ অব্যাহত রাখাটা জরুরি।
ইউনিসেফের প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে মাতৃ ও নবজাতকের স্বাস্থ্যসেবাপ্রাপ্তিও ব্যাপকহারে প্রায় ১৯ শতাংশের মতো কমেছে।
বাংলাদেশে ইউনিসেফের প্রতিনিধি তোমো হোজুমি বলেন, ‘মহামারির কারণে স্বাস্থ্যসেবা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেলে প্রতিরোধযোগ্য ও আরোগ্য লাভ করা সম্ভব এমন অবস্থা থেকে হাজার হাজার শিশু মারা যেতে পারে। নারী ও শিশুদের জন্য জীবনরক্ষাকারী সেবা সহজলভ্য, নিরাপদ এবং সেবা গ্রহণের সুযোগ নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করছে ইউনিসেফ।’