বিশেষ প্রতিনিধি::
রাজাই চিরিং বা পাটলি চিরিং। গারো ভাষায় চিরিং মানে ঝর্ণা। তাহিরপুর সীমান্তের ভারতের খাসিয়া পাহাড়ের কালাপাহাড় থেকে এই ঝর্ণার উৎপত্তি। রাজাই আর চানপুর গ্রামের মধ্যবর্তী সীমান্তঘেঁষা এই ঝর্ণাটিয় বর্ষায় তার রূপ উন্মোচন করে। বৃষ্টি হলে ঝর্ণার পানি অঝোরে শো শো শব্দে নামে। বিশাল বিশাল কালো পাথরের ফাঁক গলে নেমে আসা প্রাকৃতিক ঝর্ণাটি তখন অন্যরকম হয়ে ওঠে। বছরের বেশিরভাগ সময় পানিসংকটে থাকা আদিবাসী গারো সম্প্রদায় তখন এই ঝর্ণা থেকেই জলের প্রয়োজন মেটান।
তবে সম্প্রতি বাঙালিসহ কিছু পর্যটক তাদের এই ঝর্ণাটিতে গিয়ে উৎপাত করায় নীরিহ গারো আদিবাসীরা অনেকটা মনোক্ষুন্ন। এতে তাদের পারিবারিক ও সামাজিক জীবনেও প্রভাব পড়েছে। কারণ পানিসংকটের কারণে এই ঝর্ণাতেই নারীরা ¯œানকাজসহ দৈনন্দিন কাজও সারেন। যা পর্যটকদের উৎপাতে ব্যাহত হচ্ছে।
প্রবীণ আদিবাসীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মেঘালয় সীমান্তের পশ্চিম খাসিয়া পাহাড়ের পাদদেশে হাজার বছর ধরে রাজাই গ্রামে অবস্থান করছেন আদিবাসী সম্প্রদায়ের লোকজন। একসময় জঙ্গলে ভরপুর ছিল পাহাড়ি এলাকাটি। পাহাড়ি খানাখন্দকেই তারা শান্তির জীবন অতিবাহিত করতেন। পাহাড়ি সন্তান হয়ে প্রকৃতির সঙ্গে চমৎকার সমঝোতায় চলতো তাদের জীবন। এই প্রাকৃতিক ঝর্ণাটিও তাদেরকে জীবনযাপনে সহায়তা করে আসছে। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পরে এই অঞ্চলে ময়মনসিং, নেত্রকোণা, কিশোরগঞ্জ, নরসিংদীসহ বিভিন্ন এলাকার বাস্তচ্যুত মানুষরা এসে তাদের পাশেই জঙ্গল কেটে বসতি তৈরি করে বসবাস করতে শুরু করেন। একসময় সংখ্যায় এলাকায় আদিবাসীরা শীর্ষে থাকলেও এই এলাকায় এখন বিভিন্ন স্থান থেকে ভাগ্যন্বেষণে আসা লোকজনই জনসংখ্যা ও প্রভাব প্রতিপত্তিতে শীর্ষে। নানা সময়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ নানা কারণে এই এলাকায় বসবাসরত আদিবাসীরা সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতের অভ্যন্তরে পাহাড়ে চলে গেছেন। তবে এখনো কিছু পরিবার ঐতিহ্য রক্ষা করতে মাটি কামড়ে পড়ে আছেন।
তাহিরপুর উপজেলার উত্তর বড়দল ইউনিয়নের রাজাই ও চানপুর গ্রাম। এখনো ২০-২৫টি আদিবাসী পরিবারের বসবাস রয়েছে এখানে। রাজাই চিরিং ঝর্ণাটি মূলত গারোপাড়ার ভেতর দিয়েই কালা পাহাড় থেকে বেরিয়ে এসেছে। ঝর্ণাটি এসে মিশেছে রাজাই ছড়ায়। রাজাই ছড়া হয়ে এই পানি নামছে পাশের পচাশোল হাওরে। গত কয়েকদিনের বৃষ্টিপাত উজানের ঢলের কারণে অপরুপ হয়ে ওঠেছে ঝর্ণাটি। হিমশীতল জলধারা অন্যরকম আবহ তৈরি করেছে নীরব স্থানটিতে।
জানা গেছে বছরের বেশিরভাগ সময়েই পানিসংকটে থাকেন গারোপাড়ার বাসিন্দারা। বর্ষা মওসুমে তখন প্রকৃতির কল্যাণে এই ঝর্ণা আশির্বাদ হয়ে দেখা দেয় তাদের মধ্যে। তখন বৃষ্টি হলে পাহাড়ি খানাখন্দকে আটকে থাকা পানি ছুইয়ে ছুইয়ে ঝর্ণা হয়ে নামতে থাকে। এই পানি ব্যবহার করে প্রয়োজন মেটান তারা। খাবার পানি, গোসলের পানিসহ দৈনন্দিন পানির চাহিদা মেটান এই ঝর্ণা থেকেই।
ইউপি সদস্য স¤্রাট মিয়া বলেন, রাজাই গ্রামের উত্তর পশ্চিম মাথা ও চানপুর গ্রামের পূর্ব উত্তর মাথায় পাহাড়ি ঝর্ণাটির অবস্থান। কালা পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝর্ণাটি স্থানীয় গারোপাড়ায় অবস্থিত। এই পাড়ার লোকজন বেশিরভাগ সময়ই পানি সংকটে থাকেন। তবে বর্ষা মৌসুমে বিশেষ করে অঝোর বৃষ্টি হলে ঝর্ণায় উপচে পড়ে। তখন ঝর্ণাটি দেখতেও আকর্ষণীয় রূপ নেয়।
রাজাই গ্রামের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব ও কেন্দ্রীয় আদিবাসী নেতা এন্ড্রু সলোমার বলেন, রাজাই চিরিং একটি প্রাকৃতিক ঝর্ণা। বর্ষা মওসুমে ঝর্ণাটি স্বরূপে দেখা দেয়। তখন স্থানীয় গারোপাড়ার লোকজনের কাছে আশির্বাদ হয়ে দেখা দেয় এটি। পর্যটক নামের কিছু মানুষের উৎপাতে তারা অসন্তুষ্ট।