বিশেষ প্রতিনিধি::
সুনামগঞ্জে দশদিনের ব্যবধানে দ্বিতীয় দফা বন্যা চরম দুর্ভোগ ডেকে এনেছে। বন্যার পানিতে বিশ্বম্ভরপুর ও দিরাইয়ে দুই শিশু এবং শাল্লায় এক যুবকসহ তিনজন মারা গেছে। ঘরবাড়ি প্লাবিত হওয়ায় আশ্রয় কেন্দ্র খুঁজছে মানুষ। ৮১টি ইউনিয়নের কয়েক লাখ মানুষ এখন দুর্ভোগের মুখে পড়েছে। পাহাড়ি ঢল ও বর্ষণে প্রতিদিনই নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। এতে দুর্ভোগের সঙ্গে ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণও বাড়ছে। বিশেষ করে জেলা শহরের হাওর সংলগ্ন এলাকায় হঠাৎ পানির চাপ বৃদ্ধি পাওয়ায় বেশিরভাগ বাসাবাড়িই নিমজ্জিত হয়েছে। তবে সুরমা নদী তীরবর্তী এলাকায় পানি কিছুটা কমছে।
রবিবার দুপুরে পৌর শহরের আফতানগর এলাকার বাসা বাড়ি নিমজ্জিত হওয়ায় সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজে আশ্রয় কেন্দ্রে যান দিনমজুর নূর হোসেন। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখতে পান বিভিন্ন এলাকায় কয়েকশ পরিবার আশ্রয় নিয়েছেন। নতুন করে তার সেখানে থাকার সুযোগ নেই। তাই বৃদ্ধ মা, স্ত্রী ও শিশু সন্তানদের নিয়ে ছুটে আসেন সরকারি জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয়ে। সেখানে একটি শ্রেণি কক্ষের বেঞ্চগুরো সরিয়ে তিনি বাসা থেকে নিয়ে জরুরি জিনিষগুলো রেখে আবারও বাসায় ছুটে যান।
একই সময় সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজ আশ্রয় কেন্দ্রে জায়গা না পেয়ে সরকারি জুবিলী উচ্চ বিদ্যালয়ে ছেলে, ছেলে বউ ও নাতিদের নিয়ে ছুটে আসেন বৃদ্ধা রিনা বেগম। তিনদিন আগেই তার বাড়িটি নিমজ্জিত হয়ে গেছে। তার ছেলে ও স্বামী দিনমজুর। নিজেদের মাথাগোঁজার ঠাই থাকলেও বন্যায় তলিয়ে গেছে সেই ঘরটি। তার পাশেই শহরের মধ্যবাজারের এক দিনমজুর পরিবার এসে স্কুলের আশ্রয় কেন্দ্রে উঠেছে। সেখানে চুলোয় বাচ্চাদের জন্য রান্না করছিলেন সুনীতি বর্মণ নামের গৃহিণী।
জেলা শহরের হাজিপাড়ায় রিক্সা চালক স্বামীকে নিয়ে বসবাস করেন বুয়া মিনারা বেগম। গত শুক্রবার তার বাসাসহ আশপাশের অন্তত ১০টি বাসায় পানি ডুকে পড়ে। পরদিন তাড়াতাড়ি বাসন-কোসন নিয়ে শহরের কালিবাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় তলায় আশ্রয় কেন্দ্রে গিয়ে উঠেছেন। তার মতো আরো ১০-১২টি পরিবারও এখানে উঠেছে।
করোনার থাবায় বিপর্যস্ত জীবন নিয়ে শঙ্কায় আছেন এসব মানুষজন। আয় রোজগার কমে গেছে। এখন উপর্যপুরি বন্যার থাবায় তারা অসহায় হয়ে পড়েছেন। বন্যা বিলম্বিত হলে কঠিন অবস্থায় পড়বেন বলে জানান তারা। সুনামগঞ্জ শহরের এসব আশ্রয় কেন্দ্রের কেউ সরকারি ত্রাণ সহায়তা পাননি বলেও জানান।
রিনা বেগম বলেন, ৩দিন ধইরা ঘরো পানি। উন্দাল ভিইজ্যা নষ্ট অইগিছে। নাতিপুতিরে কুন্তা খাবাইতা পাররাম না। বিস্কুট, ছিরা খাইয়া রাখছি। তিনি বলেন, সরকার এখনও আমরারে কুন্তা দিছেনা। বন্যা লাম্বা অইলে আমরারে আনা খাইয়া মরতো অইব।
মিনারা বেগম বলেন, আমি মাইনসের ঘরবাড়িত কাম কইরা খাই। আমরার এইন রিক্সা বাইন। করোনায় আমরার রুজি রোজগার বন্ধ অইগিছে। এখন বন্যা আইয়া দুইবার ঘরো পানি উঠছে। ইস্কুলে আইয়া উঠলেও খাইবার ব্যবস্থা নাই। বড় কষ্টে আছি।
সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসন জানিয়েছে জেলার ৮১টি ইউনিয়নে বন্যা দেখা দিয়েছে। এতে কয়েক লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। এ পর্যন্ত ২৬৯টি আশ্রয় কেন্দ্রে ১হাজার ৩৭৯টি পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। নতুন করে ত্রাণ বরাদ্দ দেওয়া না হলেও গত ১৫দিন আগে যে ত্রাণ দেওয়া হয়েছে তা এখন বিতরণ চলছে। উপজেলার মজুদ থেকে চাল, নগদ টাকা ও শুকনো খাবার বিতরণ করা হচ্ছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢল অব্যাহত রয়েছে। ফলে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। পাউবোর সূত্র মতে সুরমা নদীর পানি সুনামগঞ্জ পয়েন্টে রবিবার বিকেলে বিপৎসীমার ৪১ সে.মিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গত ২৪ ঘন্টায় বৃষ্টিপাত হয়েছে ১৫০ মি.মিটার।
জেলা প্রশাসন জানিয়েছে দ্বিতীয় দফা বন্যার কারণে ৫টি উপজেলার সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। ঢলের তোড়ে ভেঙ্গে গেছে তাহিরপুর-বিশ্বম্ভরপুর-জামালগঞ্জ-ছাততক-দোয়ারার সঙ্গে জেলা সদরের সংযোগ সড়ক। এতে যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে চারটি উপজেলার সঙ্গে। জেলা শহরের কাজির পয়েন্ট, উকিলপাড়া, সাববাড়ি ও নবীনগর এলাকা এখনো নিমজ্জিত রয়েছে। নতুন করে হাজিপাড়া, নতুনপাড়া, হাছননগর, কালিপুরসহ বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। পানি বাড়ছে এসব এলাকায়। তাছাড়া বন্যায় সড়ক, মৎস্য খামারসহ সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা ও অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হচ্ছে বলে জানা গেছে।
সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আহাদ বলেন, প্রতিটি উপজেলায় তথ্য কেন্দ্র খুলে খোঁজ খবর রাখা হচ্ছে। কোন পরিবার আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেলেই নির্ধারিত আশ্রয় কেন্দ্রে আসার জন্য বলা হচ্ছে। উপর্যুপুরি দুই বন্যায় সুনামগঞ্জে ক্ষয়-ক্ষতি বাড়ছে। প্রশাসন বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রে শুকনো খাবারসহ উপজেলা থেকে বন্যার্তদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত রয়েছে।