বিশেষ প্রতিনিধি::
‘বইন্যার ফানি টান ধরলে আমরার বাশফালার ঘরবাড়ি ধুম করি ভাইঙ্গা পড়ব। আর ঘর তুলতাম ফারতাম না। দুইবারের বইন্যায় ঘরো ফানি উইট্যা বাশফালা পইচ্যা মরকা খইরা গেছিগি। এখন ফানি কমলে যে কিতা খরমু আল্লায় জানে’। (বন্যার পানি কমলে আমাদের বাঁশের খুঁটির কাচা ঘরবাড়ি ধুম করে ভেঙে পড়বে। আর ঘর বানাতে পারব না। দুইবারের বন্যায় ঘরে পানি উঠে বাঁশের খুঁটি পচে নড়বড়ে হয়ে গেছে। এখন পানি কমলে কি করব আল্লায় জানে)
এভাবেই দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার উজানীগাঁও গ্রামের হতদরিদ্র বাউল লাল শাহ তার নিমজ্জিত ঘর দেখিয়ে আক্ষেপের সুরে কথা বলছিলেন। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত দরিদ্র মানুষজন জানান, বন্যার পানি কমতে শুরু করেছে। পানি নামার সঙ্গে সঙ্গে তাদের কাঁচা ঘরবাড়ির বেড়া (দেয়াল) ধসে পড়ছে। পচে যাওয়া বাঁশের খুঁটিও ভেঙে পড়ছে। তাই বসতঘর রক্ষা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন বন্যাকবলিত নিম্ন আয়ের মানুষজন। সরকারিভাবে বাউলদের আর্থিক সহায়তা করা হলেও মূলধারার এই বাউল কোনো সহায়তা পাননি।
দ্বিতীয় দফা বন্যায় শাল্লা উপজেলার নারকিলা গ্রামের অর্ধশতাধিক কাঁচা ঘরবাড়ি প্লাবিত হয়েছে। এই গ্রামের পশ্চিম পাড়ার সবাই হতদরিদ্র দিনমজুর। ছোট ছোট খুপড়ি ঘরে বসবাস করেন তারা। দুই দফা বন্যা হয়ে গেলেও গ্রামের কেউ সরকারি ত্রাণসহায়তা পাননি। কোথাও যাওয়ার সুযোগ না থাকায় বাঁশের মাচা করে অবস্থান করছেন তারা।
গ্রামের মাদকবিরোধী কণ্ঠ হিসেবে পরিচিত কলেজছাত্র পাভেল মিয়া বলেন, আমাদের পাড়ার সব ঘরবাড়ি ডুবেছে। ঘরের বাশের খুঁটিগুলো পচে যাচ্ছে। তাই পানি কমলে ঘরগুলো ধসে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। আমরা বাঁশের মাচা বানিয়ে অবস্থান করছি। পানি কমে গেলেও অভাবি মানুষরা আবার বাঁশ কিনে খুটি দিয়ে ঘর আটকানোর অবস্থায় নেই। করোনার কারণে আয় বন্ধ থাকায় খুবই কষ্টে আছি আমরা। সরকারি কোনো ত্রাণ আমাদের গ্রামের কেউ পায়নি।
ধর্মপাশা উপজেলার সুখাইর রাজাপুর উত্তর ইউনিয়নের নূরপুর গ্রামের দিনমজুর আমির হোসেন, রইছ মিয়া, হারেছ মিয়া ও নজরুল ইসলামের কাঁচা ঘরবাড়ি প্লাবিত হয়েছে। চার দিন নিমজ্জিত থাকায় ধানকুনিয়া হাওরের উত্তাল ঢেউ বসতবাড়িতে আছড়ে পড়ায় ধসে পড়েছে। এই চারজন বর্তমানে গ্রামের প্রতিবন্ধী স্কুলে আশ্রয় নিয়েছেন। বন্যার পানি কমে গেলে বসতঘরটি ধসে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে তাদের। নজরুল ইসলাম বলেন, ‘খাচা বাশের ফালার ঘর। ঢেউয়ে ভাইঙ্গা ভাইঙ্গা নেরগি। পানি কমলে ঘরটা এক্কেবারে ভাইঙ্গা পড়ব। তখন বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে কোয়াই থাকতাম’।
ধর্মপাশা উপজেলার সুখাইর রাজাপুর দক্ষিণ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আমানুর রাজা চৌধুরী বলেন, আমার ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামের নতুন বসতি যে গ্রামগুলোতে গড়ে ওঠেছে সেগুলো বেশির ভাগই নিমজ্জিত হয়েছে। দরিদ্র মানুষের কাঁচা ঘরবাড়ি বন্যার পানি কমার সাথে সাথে ধসে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। করোনা ও বন্যায় এখন বিপর্যস্ত মানুষজন। কিভাবে তারা বন্যয় ক্ষতিগ্রস্ত ঘর সংস্কার করবে সেই দুশ্চিন্তায় রয়েছে। সবাই আমাদের কাছে সহযোগিতার জন্য আসছে। কিন্তু আমাদের এসব খাতে কোনো বরাদ্দ নেই।
সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসনের মতে বন্যায় লাখো পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তারা বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন। সেখানে প্রশাসনের পক্ষ থেকে শুকনো খাবার সরবরাহ করা হচ্ছে। তবে বন্যায় হতদরিদ্র ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের ঘরবাড়ি সংস্কার বিষয়ে প্রশাসনের কোনো সহায়তা কার্যক্রম আপাতত নেই বলে সংশ্লিষ্টরা জানান। সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আহাদ বলেন, আমরা বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করছি। সেটা কর্তৃপক্ষ বরাবরে পাঠানো হবে। এ খাতে বরাদ্দ আসলে প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে বণ্টন করা হবে।