বৃহত্তর সিলেট বিভাগ বিশেষ করে আমাদের সুনামগঞ্জ জেলায় রয়েছে অগনিত হাওর, বাওর, ডুবা, পুকুর ও নদী-নালা। বর্ষা মৌসুম থেকে শুরু করে প্রায় ছয় মাস এই এলাকার মানুষজন পানিবন্ধি হয়ে থাকে।
আমাদের লোকজন বিশেষ করে শিশু-কিশোররা বর্ষা মৌসুমে এই পানি ব্যবহারে সবচেয়ে বেশি অসতর্ক থাকে। গোসল করা, সাঁতার কাটা, মাছ ধরা, জমে থাকা পানিতে খেলা-ধূলা করা, বৃষ্টিতে ভিজে স্কুলে যাওয়া,কাঁচা ঘর-বাড়ি, অস্বাস্থ্যকর, স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশ ইত্যাদি নানা কারনে এই সময়ে অনেক মানুষ নানাপ্রকার রোগে ভোগেন। জ্বর, সর্দি-কাশি, নিউমোনিয়া, টাইফয়েড, গলা ব্যথা, নানাপ্রকার চর্মরোগ এবং কান দিয়ে পুজ/পানি পরা ইত্যাদি অনেকের বিশেষ করে বাচ্ছাদের নিয়মিত রোগ হয়ে দাঁড়ায়।
কান থেকে পানি/পুঁজ পরা কি?
কান দিয়ে পুঁজ/পানি পরা বা স্রাব হওয়া হল একটি উপসর্গ যা অনেকগুলি অবস্থার সাথে যুক্ত। যেমন কানে সংক্রমণ, কানে জ্বালা করা, কানের বাইরে বা মাঝখানে আঘাত এবং খুব কমক্ষেত্রে কানে ক্যান্সার। এটি ওটোরিয়া নামেও পরিচিত এবং এটি গভীর বা দীর্ঘস্থায়ী অবস্থা হতে পারে। এই স্রাব পড়া খুবই অপ্রীতিকর এবং যে কোন বয়সে দেখা দিতে পারে কিন্তু আমাদের দেশে প্রধানত শিশুদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। এই স্রাব পুজ, পানি, শ্লেষ্মা, কানের ময়লা বা রক্তের আকারে হতে পারে।
মানবদেহের কানকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের সুবিধার জন্য তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। বহিঃকর্ণ, মধ্যকর্ণ এবং অন্ককর্ণ। কান দিয়ে পুজ/পানি পরা সাধারনত মধ্যকর্ণের রোগ। তবে অনেক সময় বহিঃকর্ণের কিছু প্রদাহের কারনেও কানে পুজ/পানি হতে পারে।
কান দিয়ে পুজ/পানি পরার প্রধান লক্ষণ এবং উপসর্গগুলি কি কি?
কান থেকে পানি পরার খুব সাধারণ কারণ হল কানের বাইরে বা মাঝখানের সংক্রমণ এবং জ্বলনশীলতা। যদি আপনার কান থেকে স্রাব পরে তবে নিম্নলিখিত লক্ষণগুলি থাকতে পারে :
১)কান দিয়ে তরল পুজ/পানি বের হওয়া। এই তরল দুর্গন্ধযুক্ত বা দুর্গন্ধহীন হতে পারে
২)কানের মধ্যে ব্যথা ও অস্বস্তি লাগা
৩) কানে কম শোনা ও বন্ধ বন্ধ অনুভূতি লাগা
৪) কানে শব্দ হওয়া, মাথা ঘুরানো, ভারসাম্য নষ্ট হওয়া, ঘুমের ক্ষতি ইত্যাদি থাকতে পারে।
৫) হঠাৎ প্রদাহের কারনে অনেকের তীব্র কান ব্যথা সহ জ্বর আসতে পারে।
এর প্রধান কারণগুলি কি কি?
কানের থেকে জল পড়া হল একটি সাধারণ উপসর্গ এবং এটি খুব সাধারণত ৫ বছরের নীচের শিশুদের ইউস্ট্যাচিয়ান নলের কম বৃদ্ধি এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকার কারণে দেখা যায়। এটি প্রাপ্তবয়স্কদেরও হতে পারে। যদি একজন ব্যক্তির কান থেকে তরল বের হওয়ার অপ্রীতিকর অভিজ্ঞতা থাকে তবে এর কারণগুলি হতে পারে
১) মধ্যকর্ণের সংক্রমণ (ওটাইটিস মিডিয়া)
২)বহিঃকর্ণের সংক্রমণ (ওটাইটিস এক্সটারনা)
৩) ঠান্ডা, সর্দির কারনে নাক ও মধ্যকর্ণের সংযোগনালীর সংক্রমণ
৪)টেম্পোরাল হাড়ে আঘাত
৫)কানের কোষের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি (বিরল ঘটনা)
৬)কানে অস্ত্রপচারের পরের প্রভাব।
৭) ভুল পদ্ধতিতে জন্ম নেওয়া শিশুদের বুকের দুধ খাওয়ানো।
৮) মোরগের পাখনা, কঁচু গাছের ডগা, ম্যাচের কাটি, কলমের মুখ ইত্যাদি যত্রযত্র জিনিসপত্র দিয়ে কান পরিষ্কারের বাজে অভ্যাস গড়ে তোলা।
এটি কিভাবে নির্ণয় এবং চিকিৎসা করা হয়?
কান থেকে তরলের বের হওয়ার পুরোপুরি নির্ণয় করা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। যদিও, কোন পরীক্ষার আগে তরলের মাইক্রো-সাকশান অথবা মপিং অবশ্যই করতে হবে। রোগ নির্ণয়ের প্রথম ধাপে কান, নাক, কন্ঠনালীর (ইএনটি) বিশেষজ্ঞ রোগীর ইতিহাস নেবেন, এবং আরও নির্ণয়ের জন্য প্রয়োজন হতে পারে:
১) কানের ওটোস্কপিক এক্সামিনেশন
২)টিমপ্যানোমেট্রি
৩)শ্রবণশক্তির পরীক্ষা
৪)যদি ইমিউনোডেফিসিয়েন্সি কারণ হয় তবে রক্ত পরীক্ষা
৫)প্যাথোজেনকে খুঁজে বার করার জন্য স্রাব অথবা ইয়ার সোয়েবস কাল্চারের পরীক্ষা
৬) প্রয়োজনে নাক/কানের এক্সরে করা।
যথাযথ রোগ নির্ণয়ের পরে কানের পানি/পুজ পরার চিকিৎসার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এবং যে কারনে কানের পুজ/ পানি পরছে একজন নাক, কান, গলা রোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অধীনে এর পুঙ্খানুপুঙ্খ চিকিৎসা করা অতীব জরুরী।
কান দিয়ে পুজ/পানি পরলে করনীয়-
১) নিকটস্থ রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া এবং প্রয়োজনে দ্রুত নাক, কান, গলা রোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া।
২) ডুব দিয়ে গোসল না করা, সাতাঁর না কাটা। গোসলের সময় নারিকেল তেল ভেজা তুলা কানে দিয়ে গোসল করা।
৩)বৃষ্টিতে ভিজে খেলা-ধূলা না করা।
৪) ঠান্ডা, ফ্রিজের পানি, আইসক্রিম না খাওয়া।
৫) বুকের দুধ খাওয়া শিশুদের সঠিক নিয়মে দুধ খাওয়া।
৬) অযথা কান পরিষ্কার না করা। কানের ভিতর মোরগের পাখনা, কঁচুর ডগা, ম্যাচের কাটি, কলমের মুখ ইত্যাদি ঢুকিয়ে পরিষ্কার করা সম্পূর্ণ নিষেধ।
কান থেকে পানি পড়ার চিকিৎসার প্রয়োজন কারণ এটি বেদনাদায়ক অবস্থা হতে পারে এবং কিছু ক্ষেত্রে শ্রবণশক্তি নষ্ট করতে পারে। খুব কম ক্ষেত্রে স্রাবের কারণে মারাত্মক ক্ষতি যেমন মস্তিষ্কের ভিতরে ও বাইরে সংক্রমণ ছড়িয়ে পরতে পারে। এটি নিয়ন্ত্রণের জন্য সঠিক রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসার আশু প্রয়োজন।
ডা. এম. নূরুল ইসলাম
আবাসিক সার্জন
নাক, কান, গলা ও হেড-নেক সার্জারী ডিপার্টমেন্ট।
সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।