হাওর ডেস্ক::
করোনা দুর্যোগ ও নগরে নি¤œ আয়ের মানুষদের খাদ্য সংকট শীর্ষক এক অনলাইন নাগরিক সংলাপ আজ সকাল ১১.৩০টায় পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা), কোয়ালিশন ফর দ্যা আরবান পুওর (কাপ) এবং বারসিক-এর যৌথ আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয়। পবার চেয়ারম্যান আবু নাসের খানের সভাপতিত্বে ও পরিবেশ বার্তার সম্পাদক ফেরদৌস আহমেদ উজ্জলের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত সংলাপে আলোচনা করেন কাপ এর নির্বাহী পরিচালনক রেবেকা সান ইয়াত, বাপার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মিহির বিশ্বাস, বারসিকের পরিচালক পাভেল পার্থ, সমাজসেবা কর্মকর্তা কেএম শহীদুজ্জামান, পবার সম্পাদক মেসবাহ সুমন, বস্তিবাসী নেত্রী হোসনে আরা বেগম রাফেজা প্রমূখ। সংলাপে ধারণাপত্র উপস্থাপন করেন বারসিকের সমন্বয়ক মো: জাহাঙ্গীর আলম।
সংলাপে বস্তিবাসী নেত্রী রাফেজা বলেন, করোনাকালে ঢাকার বস্তিবাসীরা সবচেয়ে বড় সংকটে পড়েছে। লক ডাউনের শুরুতেই তাদের কাজ থেকে বের করে দেয়া হয় কিন্তু তাদের খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি একবারের জন্য ভাবেনি কেউ। বস্তিবাসীদেষর কাজ নাই, নিরাপত্তা নাই, খাদ্য নাই কিন্তু তাদেরও পেট আছে তাদেরও ক্ষুধা আছে। তাদের প্রতি সরকারের সদয় হওয়ার প্রয়োজন ছিলো।
বাপার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বলেন, বস্তিবাসীদের বাড়ী ভাড়া না থাকলে বের করে দেয়া হয়েছে কিন্তু পেটে যাদের খাবার নাই তাদের খোঁজ কেউ নেয়নি। তিনি আরও বলেন, গ্রাম শহরের দরিদ্রদের মধ্যে দারিদ্রতা আরও বেড়েছে। আমর্ত সেনের কথা টেনে তিনি বলেন, খাদ্যেও মজুদ থাকলেও তার যথাযথ বন্টন ব্যবস্থা না থাকলে দুর্ভিক্ষ ঠেকানো যায় না। এক্ষেত্রে একই ব্যাপার লক্ষ্য করা যায়।
কাপের রেবেকা সান ইয়াত বলেন, সামাজিক নিরাপত্তা চাদর বস্তিবাসীদের জন্য এই করোনাকালে কোন কাজেই আসেনি। সরকার বস্তিবাসীদের নাগরিকই মনে করেন না। সবার আগে দরকার বস্তিবাসীদের মানুষের মর্যাদা দিয়ে দেখা আর বন্টন ব্যবস্থাটা ঠিক করা।
পাভেল পার্থ বলেন, করোনা মহামারী মানুষ চোখে দেখতে না পারলেও তার প্রভাবটা খুব ভাল করেই চোখে দেখা যাচ্ছে। মানুষকে ভয়ংকর প্রান্তিকার দিকে ঠেলে দিচ্ছে করোনা।
আবু নাসের খান সভাপতির বক্তব্যে বলেন, করোনায় এদেশে নি¤œ বিত্ত, নি¤œ মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত এই তিন শ্রেণীকেই সংকটে ফেলেছে। সবার আগে দরকার সরকারের একটা ফ্রেকওয়ার্ক দাড় করানো যার মাধ্যমে এই মানুষদের পাশে নিয়মতান্ত্রিকভাবে দাড়ানো সম্ভব হবে। তিনি বলেন, সরকারের মধ্যে আন্তরিকতা থাকলেও কিছু অসাধু গোষ্ঠীর কারণে মানুষ খাদ্য নিরাপত্তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সরকারের উচিত হবে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করার।
সংলাপে বক্তারা আরও বলেন, ঢাকা শহর পৃথিবীর অন্যতম জনবহুল একটি শহর। বেসরকারী তথ্যমতে মোট বস্তিবাসীর সংখ্যা ৪০ লক্ষের অধিক, যা ঢাকার মোট জনসংখ্যার ৩৭.৪%। বাংলাদেশের জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশল ২০১৫,; এর বানীতে গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন; আমাদের জাতীয় সংবিধানের ১৫ (ঘ) অনুচ্ছেদে নাগরিকদের সামাজিক নিরাপত্তা বিধানের কথা বলা হয়েছে। এ কৌশলের প্রধান রূপকল্প হচ্ছে দেশকে ক্ষুধা ও দারিদ্র্য মুক্ত করা, বিশেষ করে দরিদ্র ও ঝুঁকিগ্রস্ত নাগরিকদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গড়ে তোলা। করোনার এই থাবা জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলের লক্ষ্যমাত্রাকে লন্ডভন্ড করে দিয়েছে। এক গবেষণায় দেখা যায় ২০০০ সালে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ৪৮.৯ শতাংশ। ২০১৯ সালে তা কমে সালে প্রায় ১৯ শতাংশ হয়েছে। আর ২০২০ সালে শুধু করোনার কারণে আবার দারিদ্রের হার এসে দারিয়েছে ৪৩% এ। ২০২০ সালের আগষ্টের প্রথম সপ্তাহে বারসিকের ছোট স্টাডিতে দেখা গেছে করোনার কারণে এখন পর্যন্ত ৫০% ভাগ গ্রহকর্মী এখনও তাদের কাজ ফিরে পায়নি। যারা কাজ করছে তারা আগে তিনটি বা চারটি কাজ করলেও এখন করছে মাত্র একটি। ফলে শুধু গ্রহকর্মীদের আয় কমেঠে ৬৬ ভাগ। যার প্রভাব পড়েছে তাদের খাদ্যাভ্যাস সহ অন্যান্য জীবনযাত্রায়।
পাওয়ার এন্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) এবং ব্র্যাক ইন্টিটিউট অব গবসেন্স এ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) তথ্য মতে করোনাকালে পারিবারিক খরচ চালাতে না পেড়ে ঢাকাশহর ছেড়ে ১৫.৬৪ শতাংশ মানুষ গ্রামে চলে গিয়েছে। অথচ করোনার আগে এই ঢাকা শহরের প্রতিদিন ১৪০০-১৬০০ মানুষ নতুন মানুষ এসে বসবাস শুরু করতো। তারা আরো বলেন, করোনার এই ক্রান্তিকালে ৩ কোটি ৫৬ লক্ষ মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছে, রিকশা চালকদের আয় কমেছে ৫৩%, দরিদ্র মানুষের আয় কমেছে ৪৩%, গৃহকর্মীরা কাজ হারিয়েছে ৫৪% এবং নগরে সরকারের নগদ সহায়তা পেয়েছেন ১৬% মানুষ।
।
সরকার ২০২০-২০২১ অর্থ বছর বাজেট ঘোষনা করেছেন ৫,৬৮০০০ কোটি টাকার এবং সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচীর জন্য প্রায় ৯৬ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছেন। অন্যান্য খাতের পাশাপাশি সামাজিক নিরাপত্তা খাতে যে ১৫০ টির মত সেবা উপখাত রয়েছে, সেখানে নগরের নিম্ন আয়ের মানুষদের যুক্ত করতে পারলে তাদের জীবন জীবিকা কিছুটা হলেও সচল হতে পারত বলে অনেকেই মনে করেন।
এই পেক্ষাপট বিবেচনায় সরকারের নিকট নি¤œ আয়ের মানুষদের প্রত্যাশা ও সুপারিশ সমূহঃ
১. নগরের নি¤œ আয়ের মানুষদের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সরকারকে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
২. নগরের নি¤œ আয়ের মানুষদের জন্য গ্রামের ন্যায় প্রচুর পরিমান সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচী চালু করা।
৩. করোনায় শহরের নি¤œ আয়ের গৃহকর্মীদের জন্য বিশেষ খাদ্য সহযোগিতা ও রেশনিং কার্ড এর ব্যবস্থা করা।
৪. করোনায় কর্মহীন নি¤œ আয়ের বস্তিবাসী ও পথবাসী মানুষ, বিশেষ করে গৃহকর্মীদের জন্য আয়বর্ধনমূলক কাজের প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করা। বস্তিতে ক্ষুদ্র শিল্প গড়ে তোলার জন্য সব ধরণের প্রশিক্ষন এবং আর্থিক সহায়তা ব্যবস্থা করা।
৫. তাদের ব্যয়ের খাত কমানোর জন্য পল্লী এলাকার মতো নগরের জনসংখ্যা বিবেচনায় স্যাটেলাইট ক্লিনিকের মাধ্যমে বিনামূল্যে চিকিওসা ব্যবস্থা করা। তাদর জন্য পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ, পানির, জ্বালানীর ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।
৬. নগরের সব ধরনের বস্তি উচ্ছেদ বন্ধ করা। বস্তিবাসীদের জন্য সরকারী উদ্যোগে আবাসন ব্যবস্থার কাজ শুরু করা।