হাওর ডেস্ক::
২২ দিন ছিলেন হাসপাতালে। একদিকে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ ও অস্ত্রোপচার, এর ওপর করোনা সংক্রমণ—জোড়া ধাক্কা শেষ পর্যন্ত সামলাতে পারলেন না তিনি। দিল্লির আর্মি হসপিটাল রিসার্চ অ্যান্ড রেফারেলে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন ভারতের একমাত্র বাঙালি রাষ্ট্রপতি, বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু প্রণব মুখোপাধ্যায় (মুখার্জি)। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর।
তাঁর ছেলে অভিজিৎ মুখোপাধ্যায় গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় এক টুইটে বলেন, ‘দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আজ সবাইকে জানাতে হচ্ছে, হাসপাতালের চিকিৎসকদের সর্বোচ্চ চেষ্টা আর সমগ্র ভারতবাসীর দোয়া ও প্রার্থনার পরও আমার বাবা শ্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় এইমাত্র মারা গেলেন।’
ভারতীয় উপমহাদেশের সব পক্ষের শ্রদ্ধা পাওয়া এই রাজনীতিকের মৃত্যুর খবরে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন ভারতের রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ। তাঁর মৃত্যুতে আগামীকাল ২ সেপ্টেম্বর এক দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ সরকার। আর গতকাল থেকেই ভারতে সাত দিনের রাষ্ট্রীয় শোক পালিত হচ্ছে।
একাত্তরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ঘনিষ্ঠ সহচর, তখনকার কংগ্রেস নেতা ও পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যসভার সদস্য প্রণব যেমন বাংলাদেশের মুক্তিকামী বাঙালির পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন, তেমনি তিনি বন্ধু ছিলেন ভারতের রাষ্ট্রপতি হয়েও। তাঁর স্ত্রী রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী শুভ্রা মুখোপাধ্যায় ছিলেন এই বাংলাদেশের নড়াইলের মেয়ে। প্রণব-শুভ্রা দম্পতির দুই ছেলে ও এক মেয়ে।
রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ এক শোকবার্তায় বলেছেন, প্রণব মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যু ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতির জন্যই এক অপূরণীয় ক্ষতি। তিনি বলেন, ‘প্রণব মুখার্জি ছিলেন বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে প্রণব মুখার্জির ভূমিকা আমাদের বিজয়কে ত্বরান্বিত করেছিল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জনমত তৈরিতে তাঁর ছিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।’
আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ও তাঁর বোন শেখ রেহানার জীবনে অভিভাবকের মতো ছায়া হয়ে ছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। তাঁর মৃত্যুতে শোকে মুহ্যমান ও স্মৃতিকাতর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এক শোকবার্তায় প্রণবের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু পরিবার ও নিজের বহু স্মৃতি স্মরণ করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে একজন রাজনীতিবিদ ও আমাদের পরম সুহৃদ হিসেবে প্রণব মুখার্জির অনন্য অবদান কখনো বিস্মৃত হবার নয়। আমি সব সময় মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অসামান্য অবদান শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি।’
প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, ‘১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর ভারতে নির্বাসিত থাকাকালীন প্রণব মুখার্জি আমাদের সব সময় সহযোগিতা করেছেন। এমন দুঃসময়ে তিনি আমার পরিবারের খোঁজখবর রাখতেন, যেকোনো প্রয়োজনে পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। দেশে ফেরার পরও প্রণব মুখার্জি সহযোগিতা এবং উৎসাহ দিয়েছেন। তিনি আমাদের অভিভাবক ও পারিবারিক বন্ধু। যেকোনো সংকটে তিনি সাহস জুগিয়েছেন।’ শেখ হাসিনা বলেন, ‘প্রণব মুখার্জির মৃত্যুতে ভারত হারাল একজন বিজ্ঞ ও দেশপ্রেমিক নেতাকে আর বাংলাদেশ হারাল একজন আপনজনকে। তিনি উপমহাদেশের রাজনীতিতে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে বেঁচে থাকবেন।’ তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করেন এবং তাঁর শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান প্রধানমন্ত্রী।
রামনাথ কোবিন্দ এক টুইটে বলেছেন, ‘সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুর খবরে আমি শোকাহত। তাঁর মৃত্যুতে একটি যুগের অবসান হলো। তাঁর পরিবার, বন্ধুবান্ধব এবং দেশের সব মানুষের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি।’
নরেন্দ্র মোদি এক টুইটে বলেছেন, ‘ভারতরত্ন প্রণব মুখোপাধ্যায়ের প্রয়াণে ভারত আজ শোকগ্রস্ত।’ পাঁচ দশকের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের বেশির ভাগ সময় কংগ্রেসে কাটানো প্রণবের পদধূলি নেওয়ার ছবি টুইটে শেয়ার করে বিজেপি নেতা মোদি লিখেছেন, ‘দেশের উন্নয়নের গতি-প্রকৃতিতে তিনি এক অবিস্মরণীয় ছাপ রেখে গেছেন। একজন অসাধারণ পণ্ডিত, এক গৌরবময় রাষ্ট্রনায়ক, রাজনীতির সব মহল আর সমাজের সব শ্রেণিতে তিনি শ্রদ্ধা পেয়েছেন।’
বাসার বাথরুমে পড়ে গিয়ে মাথায় আঘাত পাওয়ার পর গত ১০ আগস্ট দিল্লির আর্মি হসপিটাল রিসার্চ অ্যান্ড রেফারেলে ভর্তি হয়েছিলেন প্রণব। অস্ত্রোপচার করতে গিয়ে তাঁর শরীরে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ে। একপর্যায়ে তিনি চলে যান গভীর কোমায়। সেখান থেকে আর ফিরতে পারেননি।
প্রণব মুখোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯৩৫ সালের ১১ ডিসেম্বর পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার মিরাটিতে। তাঁর বাবা কামদা কিঙ্কর মুখোপাধ্যায় ছিলেন ন্যাশনাল কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত। ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে যুক্ত কামদা কিঙ্কর ১৯৫২ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত রাজ্যসভার সদস্য ছিলেন। তাঁর মায়ের নাম রাজলক্ষ্মী মুখোপাধ্যায়।
রাজনৈতিক পরিবারে জন্ম নেওয়া প্রণব শিউড়ি বিদ্যাসাগর কলেজে শিক্ষা লাভ করেন। পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও আইন বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি নেন। ১৯৬৩ সালে কলকাতার কাছে ছোট একটি কলেজে শিক্ষকতা শুরুর মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন। ওই সময়ে তিনি ‘দেশের ডাক’ নামের একটি সংবাদপত্রে কিছুদিন সাংবাদিকতাও করেন।
রাজনীতিতে প্রণব মুখোপাধ্যায়ের যাত্রা শুরু কিন্তু ভারতের ন্যাশনাল কংগ্রেসের হাত ধরে নয়। ১৯৬৯ সালে প্রথমবার তিনি রাজ্যসভার (ভারতীয় পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ) সদস্য নির্বাচিত হন আলাদা দল বাংলা কংগ্রেস থেকে। পরে অবশ্য দলটি কংগ্রেসের সঙ্গে একীভূত হয়ে যায়। পরে আরো চার মেয়াদে রাজ্যসভার সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর ২০০৪ সালে তা ছেড়ে দেন। ওই বছরই তিনি লোকসভা (পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ) নির্বাচনে জয় পান। টানা নির্বাচিত হয়ে ২০১২ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার আগে তিনি পদত্যাগ করেন। পরে তিনি দেশটির ত্রয়োদশ রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়ে ২০১৭ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তিনি একাধিক দফায় ভারতের বাণিজ্য, পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা ও অর্থ মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেছেন।
সংসদীয় রাজনীতিতে যোগ দিয়েই ইন্দিরা গান্ধীর বিশ্বস্ত সৈনিকে পরিণত হয়েছিলেন প্রণব। ১৯৮৫ সালে প্রথমবার পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কংগ্রেসের সভাপতি হন তিনি। ১৯৯৮-৯৯ সালে সোনিয়া গান্ধী কেন্দ্রীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হলে সাধারণ সম্পাদক হন প্রণব। রাজনৈতিক জীবনের ৩৭ বছর কাটিয়েছেন পার্লামেন্টে। ক্ষমতার শীর্ষে থেকেও কখনো দুর্নীতি স্পর্শ করেনি তাঁকে। দিল্লিতে বাঙালির অন্যতম প্রতিনিধি ছিলেন তিনি। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক পরিচিত এই বাঙালি রাজনীতিক আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ও আফ্রিকান উন্নয়ন ব্যাংকের বোর্ড অব গভর্নরসেও ছিলেন।
প্রণব মুখোপাধ্যায় ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের ভাষায় ছিলেন ‘আ ম্যান অব অল সিজনস’। বিভিন্ন সময়ে নানা পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন তিনি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রাখা বিদেশি বন্ধু হিসেবে ২০১৩ সালের ৪ মার্চ প্রণবের হাতে ‘বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা’ তুলে দিয়েছিলেন তখনকার রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান। ২০০৮ সালে ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা ‘পদ্মবিভূষণ’ ছাড়াও ২০১৯ সালে পেয়েছেন দেশটির সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা ‘ভারতরত্ন’। এ ছাড়া আইভোরি কোস্ট ও সাইপ্রাস থেকেও সর্বোচ্চ পর্যায়ের সম্মাননা পেয়েছেন তিনি। দেশ-বিদেশের নানা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডিগ্রি পাওয়ার পাশাপাশি প্রণব মুখোপাধ্যায় ভারতীয় অর্থনীতি ও দেশ গঠন ইস্যুতে বেশ কয়েকটি বইও লিখেছেন।
প্রয়াত প্রণব মুখোপাধ্যায়ের শেষকৃত্য আজ মঙ্গলবার দিল্লিতে অনুষ্ঠিত হবে। আর তাঁর অস্থি বিসর্জন হবে হরিদ্বারে।
ঢাকায় আসা আর হলো না : চলতি মুজিববর্ষের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ঢাকায় আসার কথা ছিল প্রণব মুখোপাধ্যায়ের। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমন্ত্রণও গ্রহণ করেছিলেন তিনি। কিন্তু নভেল করোনাভাইরাস মহামারির কারণে সেই অনুষ্ঠানগুলো স্থগিত করা হয়।
প্রণব মুখোপাধ্যায় সিলেটের হাওরাঞ্চল, ব্রিটিশ আমলের কমিউনিস্ট নেতা ভুপেশ গুপ্তের বাড়ি থেকে ময়মনসিংহে আসার আগ্রহের কথা বিভিন্নজনকে বলেছিলেন। কিন্তু এরই মধ্যে তিনি না-ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন।