‘মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যন্ত অঞ্চল’ নাটকটি ভাটির জনপদ মুক্তিযুদ্ধের নিখাদ ঘটনা প্রবাহ নিয়ে এক অনন্য দলিল লিখেছেন কমরেড শ্রীকান্ত দাশ। তখন জনপদটি কৃষি প্রধান স্বাধীন বাংলার নির্জলা প্রান্তিক কৃষকের ঘনবসতি এলাকা যোগাযোগহীন এক নিভৃত প্রত্যন্ত অঞ্চল। তাঁর নাটকের কুশীলবে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহনকারী মুক্তিযোদ্ধাসহ এলাকার কিছু সংখ্যক রাজাকারদের নাম বেরিয়ে আসে। এদের মধ্যে উল্লেখ্য মুক্তিযোদ্ধা সিপিবির প্রবীন রাজনীতিবিদ প্রভাংশু চৌধুরী, ছাত্রইউনিয়নের জগন্নাথ হল সভাপতি আইনজীবী সুরেশ দাশ, দিরাই মুক্তিবাহিনীর সংগঠক ন্যাপ নেতা অ্যাড: আব্দুল লতিফ সরদার, রাজনীতিবিদ পোস্টমাস্টার চান্দ মিয়া(চাঁন) ছাত্র ইউনিয়ন নেতা পিলু চৌধুরী ও সাংবাদিক সালেহ চৌধুরী। নাটকে কমরেড শ্রীকান্ত দাশ দেখিয়েছেন সালেহ চৌধুরী শুধু একজন কলম সৈনিক নয় তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধাও বটে। তাঁর এক হাতে কলম থাকলেও অন্য হাতে ছিল রাইফেল। রণকৌশল প্রকৃত আর্মি-মিলিটারিদের মতো। যার জন্য নাটকে তাঁকে মুক্তি মেজর হিসাবে অভিহিত করা হয়। আর কমরেড শ্রীকান্ত দাশের ঘরে বাচ্চাদের কাছে চৌধুরী সাহেবের পরিচয় হয় কাকু হিসাবে ( ঠাকুর কাকা)। কমরেডের শিশু আল্পনা-দুরন্ত (পুত্র-কন্যা) মনে করতো উনি ঠাকুর (ব্রাহ্মণ) কারন প্রায় একই দৈহিক ঘরনায় কমরেডের আরেক বন্ধু ছিলেন কমরেড শারদা চক্রবর্তী শাল্লা নিয়ামতপুর গ্রামের( চরিত্রটি নাটকে বিদ্যমান)। শিশুদ্বয় মনেকরতো শারদা কাকুর কোন আত্মীয় এমনকি তাঁর সহধর্মীনিও মনে করতেন তাই। আর এইজন্যেই শ্রীকান্ত দাশের ছেলে-মেয়েদের কাছে সালেহ চৌধুরী নয় সালেহ কাকু হিসাবে পরিচিত হয়ে উঠেন। ঐ সময়টাতে মুক্তিকামীরা সারা দিনরাত্র বিভিন্ন গ্রুপে কাজ করতো। কাজ শেষে কমরেডের মূল পৈত্রিক ভিঠায় দোতলা ঘরটি ছিল তাঁদের বিশ্বস্ত ও থাকার আস্তানা। মাঝে মাঝে ব্যবহার হতো ভাটি অঞ্চলের শিক্ষার আলোক বর্তিকা গিরিধর হাইস্কুলের পুরাতন দোতলা বিল্ডিংটি। যার ফলশ্রুতিতে যুদ্ধশেষে দেখা যায় সারা গ্রামকে-গ্রাম নষ্ট হলেও কমরেড শ্রীকান্ত দাশের পিতৃ ভিটার কোন চিহ্ন রাখেনি পাকিস্তানি তথা আলবদর আলশামস রাজাকাররা। আর যা রেখেছিলো তাহলো ঐ দোতলাঘরটির প্যারেক মারা(বড় লোহা) আগুনে ভষ্মিভূত একটি ঠুনির পালা (বড় গাছ দ্বারা তৈরি খুঁটি) আর শ্রীকান্ত দাশের মুক্তিকামী দোষের দোষি প্রতিবেশীর একবীজপত্রী উদ্ভিদ, ভষ্মিভূত অর্ধেক নারিকেল গাছটি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এগুলো অনেক দিন ছিলো যদিও এখন আর নেই।
আমাদের ভাটি অঞ্চলের সবচেয়ে সৌভাগ্যের বিষয় হচ্ছে আমাদের কিছু সংখ্যক মানুষ স্বশরীরে স্বহস্তে সরাসরি দেশের ক্রান্তিকাল থেকে একেবারে ঐতিহাসিক কালপর্যন্ত হাওরের আফালের চাঁন কপালি(বড় বড় জল তরঙ্গ)ঢেউকে পেছনে রেখে প্রতিটা মহেন্দ্রক্ষণের অংশগ্রহনে সম্পৃক্ততা। সেই ঐতিহাসিক মহেন্দ্রক্ষণের মানুষ হচ্ছেন সালেহ চৌধুরী। জন্ম ১৯৩৬ সালের ১১ নভেম্বর ভাটির খ্যাত দিরাই থানার গচিয়া গ্রামে। পিতার নাম আজমান রাজা চৌধুরীর এবং মাতার নাম আছিয়া খাতুন চৌধুরী। তিনি পিতা মাতার পঞ্চম সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয় সন্তান ছিলেন। তিনি নিজ গ্রামের পাশাপাশি মৌলভীবাজার, সিলেট এবং লাহোরে পড়াশুনা করেন। পড়াশুনা শেষ করে শাহেরা চৌধুরীকে বিয়ে করেন। সালেহ চৌধুরী একাধারে মুক্তিযোদ্ধা, সংগঠক, চিত্রশিল্পী, ভাস্করশিল্পী, সাংবাদিক, কলাম লেখক ছিলেন। এক ব্যক্তির চরিত্রে এত গুণের সমাহার সচরাচর দেখা যায় না।
আর এতোগুনের গুনান্বিত বিধায় এই প্রতিভাধর মানুষটি প্রতিভাবান হুমায়ুন আজাদ, শামসুর রহমান,হুমায়ুন আহমদ,ইমদাদুল হক মিলন সহ বিভিন্ন মানুষের সাথে সমাবেত হতে পারতেন।
তাঁর মুখ থেকেই নিসৃত হয়েছিলো ঐতিহাসিক ‘অপরাজেয় বাংলা’র নাম। যা সর্বস্তরের মানুষের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণের প্রতীকী চিহ্নই হচ্ছে ‘অপরাজেয় বাংলা’। করতেন ছাত্র ইউনিয়ন।
১৯৭২-৭৩ সালে ডাকসুর ভিপি ছিলেন মোজাহিদুল ইসলাম সেলিম এবং জিএস ছিলেন মাহবুব জামান। এ সময় ডাকসুর উদ্যোগে অপরাজেয় বাংলার কাজে হাত দেয়া হয়। এর তিনটি মূর্তির একটির ডান হাতে দৃঢ় প্রত্যয়ে রাইফেলের বেল্ট ধরা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি। এর চোখেমুখে স্বাধীনতার চেতনা উদ্দীপনা নিরাপোষ। এর মডেল ছিলেন আর্ট কলেজের ছাত্র মুক্তিযোদ্ধা বদরুল আলম বেনু। থ্রি নট থ্রি রাইফেল হাতে সাবলীল ভঙ্গিতে দাঁড়ানো অপর মূর্তির মডেল ছিলেন সৈয়দ হামিদ মকসুদ ফজলে। আর নারী মূর্তির মডেল ছিলেন হাসিনা আহমেদ।
সালেহ চৌধুরী ছিলেন একাত্তরের ঘাতক দালালবিরোধী আন্দোলন, ১৯৯২ সালের ‘গণ আদালতে’র অন্যতম সাক্ষী, মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মামলার সাক্ষী।
দেশে আরো অনেক অনেক মুক্তিযোদ্ধা আছেন কিন্তু অন্যদের তুলনায় উনি ছিলেন ভিন্ন ধাঁচের । কারন ঐ সময়ে উনি লেখার জগতটা কে বুঝতেন । তাইতো পুরোদমে টেকের ঘাটের স্বমন্বয়কের দায়িত্ব পালনকরেও লিপিবদ্ধ করেছেন মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ের সঠিক ঘটনা,সময়,তারিখ,স্থান, কাহিনী সহ,আলবদর,আলসামস,রাজাকারদের সম্পৃক্ততা। দেখিয়ে গিয়েছেন রাষ্ট্রের ক্ষমতাধর দলগুলো থেকে রাষ্ট্র যন্ত্রের বিভিন্ন স্তরে রাজাকারদের ছেলে পোলেরা আইন,ডাক্তারি,ইঞ্জিয়ারি সহ বিভিন্ন মানব সেবার নামে ছদ্মবেশে অধিষ্ঠিত। অনেক সময় আক্ষেপ করে বাঘা বাঘা পার্লামেন্টিয়ানদের বগলের তলে রাজাকারপুত্রদের উপস্থিতি দেখে গল্প করতেন। তেমনি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ের গ্রামের মোড়ল-মাতাব্বর থেকে লোকাল চেয়ারম্যান উজিড় নাজিড় কৌট্টালদের মুক্তিযুদ্ধে অবস্থান নিয়ে কিছু প্রকৃষ্ট উদাহরন দিয়ে গিয়েছেন যা কালের পরিক্রমায় উন্মোচন হলে ঐতিহাসিক দলিল হিসাবেই থাকবে। সুনামগঞ্জ জেলার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার সহ জেলার অনেকগুলো শহীদ মিনারের নকশা তৈরিতে ছিলেন তিনি। শুধু তাই নয় নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধ গবেষণায় উনি রেফারেন্সও বটে। এর প্রেক্ষিতে অনন্য মুক্তিযোদ্ধা জগৎজ্যোতি, দাস পার্টির খোঁজে, সুনামগঞ্জে মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত ৭১ সুনামগঞ্জ, মুক্তিযুদ্ধে সুনামগঞ্জ সহ অসংখ্য নাম না জানা মুক্তিযুদ্ধের উপর লেখা বইয়ে অত্র অঞ্চলের উনার উল্লেখিত তারিখ ও ঘটনা দেখতে পাই। সেই হিসাবে উনি যে কতো বড়ো কাজ করে গিয়েছেন তা প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম অনুধাবন করতে পারবে। তাছাড়া উানার সরজমিনে দেখা অলিখিত-গল্প মুক্তিযুদ্ধে তাদের অবস্থান নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ-গবেষকদের কাছ থেকে জানা যাচ্ছে । জানা যাচ্ছে সারা দেশে রাজাকার,আলবদর, আলশামস ৫০ হাজার(প্রায়) থাকলেও প্রতন্ত্য অঞ্চল শাল্লাতেই ৩৬টি রাজাকার পরিবারের নাম। তিনি বুঝিয়ে দিতে পেরেছেন রাজাকার অর্থ দেশদ্রোহী বা পাকবাহিনীর সহযোগী (Collaborator) যারা ১৯৭১-এ স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকবাহিনীকে সহায়তা করেছিল লাখ লাখ বাঙ্গালীকে চিহ্নিতকরণ এবং হত্যাযজ্ঞে। রাজাকারেরা মূলত মুসলিমলীগ, জামাতেইসলামী এবং ধর্মভিত্তিক অন্যান্য কিছু দলের সদস্যবৃন্দরাই ছিল।
আর এই সমস্থ মুসলিমলীগের বংশধরেরা নিরবিচ্ছিন্ন হাওরের মাটির উর্বরতার সুযোগে বঙ্গবন্ধু ও মুজিববাদের নাম নিয়ে মুখদিয়ে ফেনা তুলছে, গড়েতুলছে ওদের বাপ-দাদার আকাম-কুকামকে ঢাকবার জন্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সাধারন জনসাধারণের জন্য হাট বাজার।
সালেহ চৌধুরী স্কুল জীবন থেকেই ছিলেন সাহিত্য অন্তপ্রাণ মেধাবী ।বই পড়া, লেখা-লেখি, আঁকা-আঁকি নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। জন্মভূমির প্রতি তার ছিল অগাধ ভালবাসা ও ত্যাগ। তিনি জীবনকে বাজী রেখে যুদ্ধ করে গেছেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধার নাম ভাঙ্গিয়ে কিংবা হাতের কলমকে অসৌজন্য মূলক কোন কাজে ব্যবহার করে জীবনে বাড়তি সুযোগ গ্রহণ করেননি। সালেহ চৌধুরীর সবচেয়ে বড় গুণ ছিল তিনি ভালো মনের মানুষ ছিলেন। এই আকাশচুম্বি মানুষটি হৃদয়ে ছিল বিশালতা নিরহংকারী আত্মপ্রচার বিমুখী। এই মহান মানুষটির সাথে সর্বশেষ সমবেত হতে পেরেছি হুমায়ুনের হিমু তুহিন ভাইয়ের বাসা লন্ডনের লাইম-হাউস ২৯ নম্বর কারস্ট্রীটে। এই সমবেতে সবচেয়ে বেশী উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন তুহিন ভাই সালেহ চৌধুরী কর্তৃক কমরেড শ্রীকান্ত দাশ বিষয়ক এক উদৃতি নিয়ে, তখন খুব সম্ভবত উপস্থিত ছিলেন তুহিন ভাইয়ের বন্ধু সালেহ ভাই(মৌলভীবাজর) সাংবাদিক জুয়েল রাজ, সাংবাদিক আবু মুসা হাসান প্রমুখ। তুহিন ভাই বার বার আমাকে শুধরিয়ে দিয়েছেন মনে রেখো এটা সালেহ ভাই বলেছেন। উদৃতিটা হলো- “কমরেড শ্রীকান্ত দাশ স্বল্প শিক্ষিত ভালো মানুষ ছিলেন”। আজো কথাগুলো কানে ভাসে। আমার অনুমতি ছিল যে কোন সময়ে কল দিয়ে কথা বলার। কথা ছিল আমেরিকাতে আসবেন আর ফেরত যাওয়ার পথে লন্ডনে উঠবেন। নিয়তির বিরম্বনায় আর আসাও হয়নাই দেখাও হয় নাই । সেই দিন “এমনতো কথা ছিলনা কাকু” বলে ফেইস বুকে একটি স্ট্যাটাসও দিয়েছিলাম। এই পূজ্য ব্যক্তি ২০১৭ সালের ১লা সেপ্টেম্বর তাঁর বিপ্লবী কর্মময় থেকে চিরতরে বিধায় নিয়েছেন।
আমাদের কাছে অপরাজেয় বাংলার প্রেরণা হয়েই অম্লান থাকবেন আপনি।
লেখক- সুশান্ত দাস (প্রশান্ত) যুক্তরাজ্য প্রবাসী রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মী।ইমেইল-sushantadas62@yahoo.co.uk