বিশেষ প্রতিনিধি::
বাউল শাহ আবদুল করিম ঘুমিয়ে আছেন তার প্রিয় গ্রাম উজানধলে। কালনী তীরের বাড়িতে একই কবরে স্ত্রী সরলার পাশেই পূর্বপ্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তাকে বাড়ির উঠোনে সমাহিত করা হয়েছিল। দরোজার সামনেই ছিল কবরটি। ঘর থেকে বেরুলেই প্রিয়তমার দর্শন লাভ করতে পারেন এই চিন্তা থেকেই তিনি বসতঘরের উঠোনে প্রাণপ্রিয় স্ত্রী সরলাকে কবর দিয়েছিলেন। স্ত্রীর পাশে যাতে তাকেও সমাহিত করা হয় মৃত্যুপূর্ব সেই নির্দেশনাও দিয়েছিলেন স্বজনদের। তাই ২০০৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর মারা যাবার পর স্ত্রীর পাশেই শাহ আবদুল করিমকেও সমাহি করা হয়।
বাঁশের বেড়া দেওয়া সেই সমাধিটিতে পাশাপাশি এতদিন ঘুমিয়ে ছিলেন স্বামী-স্ত্রী। এবার মাটির মানুষ শাহ আবদুল করিমের মাটিগন্ধা জীবনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে সুনামগঞ্জ জেলা পরিষদ নির্মাণ করেছে শাহ আবদুল করিমের বিশেষ সমাধী সৌধ। অপূর্ব নির্মাণশৈলির বৈশিষ্ঠের কারণে উজান ধলের আকাশ থেকে সমাধীতে আলো এসে সবসময় চুমু খেয়ে যাচ্ছে সর্বক্ষণ। চুন সুরকির কাজ না করেই কেবল ইটের গাঁথুনি দিয়ে নান্দনিক স্মৃতিসৌধটি এখন শাহ আবদুল করিমের অনুরাগীদেরও মন কেড়েছে। কোন সিরামিক ব্যবহার করা হয়নি সমাধীতে। সমাধির ডিজাইনে বাউলের মাটির জীবনবোধের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে সব কৃত্রিমতা এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। কাজও প্রায় শেষ। আরো অল্পকাজ বাকি আছে। করোনার কারণে অল্প কাজটি সম্পন্ন করা ও উদ্বোধন করা বাকি রয়ে গেছে বলে জানা গেছে।
সুনামগঞ্জ জেলা পরিষদ সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রামের স্থপতি আদর ইউসুফ এই সমাধিটির ডিজাইন করেন। স্ট্রাকচারাল ডিজাইন করেছেন জেলা পরিষদের সহকারি প্রকৌশলী প্রণব রায় চৌধুরী। এটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৩০ লক্ষ টাকা। চলতি বছর নির্মাণকাজ শেষ করেছে জেলা পরিষদ। তবে করোনার কারণে এখনো সমাধিটি উদ্বোধন করা হয়নি।
লাল সাধারণ ইট বসানো হয়েছে নির্দিষ্ট ফাঁক রেখে। যাতে এই ফাঁক দিয়ে বাইরের আলো বাতাস স্বামী স্ত্রীকে ছুঁইয়ে যায়। উপরের কিছু অংশে ছাদ এবং কিছু অংশে গ্লাস দেওয়া হয়েছে। যাতে সব সময় আলোকোজ্জ্বল থাকে সমাধিটি।
বাউল শীষ্যরা জানান, শাহ আবদুল করিমের স্ত্রীর আসল নাম ছিল বৈশাখী। বৈশাখ মাসে জন্ম নিয়েছিলেন বলেই বাবা মা এই নাম রেখেছিলেন। তবে সরলতার প্রতীমা হিসেবে করিম স্ত্রীর নাম রাখেন সরলা। সরলাকে নিয়ে তিনি কালজয়ী একাধিক গানও নিখেছেন। বাউল শীষ্যরা জানান, অভাব ছিল শাহ আবদুল করিমের নিত্যসঙ্গী। এর মধ্যেই গান গেয়ে বেড়াতেন বিভিন্ন স্থানে। মাসের পর মাস গানের আসরে কাটাতেন। এই সময়ে খেয়ে না খেয়ে সংসার চালাতেন সরলা। এ কারণে তার প্রতি আমৃত্যু কৃতজ্ঞ ছিলেন বাউল। তাই স্ত্রী সরলা যখন ১৯৯০ সনে মারা যান তখন তিনি বসতঘরের দরোজার সামনেই প্রিয় স্ত্রীকে সমাহিত করেন। মৃত্যুর পর তার ইচ্ছেনুযায়ী একই কবরে স্ত্রীর পাশে স্বামী শাহ আবদুল করিমকেও সমাহিত করা হয়।
দীর্ঘদিন ধরে সমাধিটি কাচা বাঁশের বেড়ায় আবদ্ধ ছিল। বৃষ্টি হলে পানি পড়তো। ঝড়ে ভেঙ্গে পড়তো। এই অবস্থা থেকে শাহ আবদুল করিমের জীবনদর্শনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে কৃত্রিমতা বর্জন করে সমাধিসৌধ নির্মাণ করে দিয়েছে জেলা পরিষদ।
বাউল শাহ আবদুল করিমের শেষপ্রজন্মের শীষ্য বাউল লাল শাহ বলেন, বাউল স¤্রাট তার স্ত্রী সরলাকে অসম্ভব ভালো বাসতেন। গানে গল্পকথায় বারবার সেই মহীয়সী নারীকে স্মরণ করছেন। তার মৃত্যুর পরও যাতে স্ত্রীর দর্শন পান এ কারণে দরোজার সামনে উঠোনে কবর দিয়েছিলেন। সেই কবরটি দৃষ্টিনন্দন করায় আমাদের ভালো লাগছে। তবে তার একমাত্র চাওয়া শাহ আবদুল করিম সঙ্গীতালয়টি চালু না হওয়ায় আমরা মর্মাহত।
বাউল স¤্রাট শাহ আবদুল করিমের একমাত্র পুত্র বাউল শাহ নূরজালাল বলেন, জেলা পরিষদ আমার বাবা মায়ের কবরটি নির্মাণ করে দেওয়ায় আমরা কৃতজ্ঞ। এখনো অল্প কাজ বাকি আছে। কাজটি সম্পন্ন করে দিলে আমরা কৃতার্ত থাকব। তিনি বলেন, বাবার একমাত্র ইচ্ছে ছিল শাহ আবদুল করিম সঙ্গীতালয়টি চালু হোক। তার গান যাতে অবিকল কথা ও সুরে এই প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষা পেয়ে পরিবেশন করা হয়। কিন্তু আমাদের সাধ্য না থাকায় বলতে গেলে প্রতিষ্ঠানটি এখন বন্ধই আছে। তিনি বলেন, করোনার কারণে এবার আমরা কোন অনুষ্ঠান করছিনা। তবে ঘরোয়াভাবে কিছু আয়োজন থাকবে।
সুনামগঞ্জ জেলা পরিষদের সহকারি প্রকৌশলী প্রণব রায় চৌধুরী বলেন, শাহ আবদুল করিম ছিলেন একজন পুরোপুরি মাটির মানুষ। তাই সমাধিতে কৃত্রিমতা বর্জিত করা হয়েছে। সবসময় আলো হাওয়া প্রবেশ করবে এমনভাবে বানানো হয়েছে। নির্মাণকাজ প্রায় শেষ। করোনার কারণে বাকি কাজ ও উদ্বোধনটা বিলম্ব হচ্ছে। তবে আশা করি শিগ্রই অল্প কাজ শেষ করব আমরা।