সিলেটে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি উঠেছিল গত শতকের চতুর্থ দশকে। এর অনুকূলে কয়েকবার সরকারি সিদ্ধান্তও গৃহীত হয়েছিল। কিন্তু রাজনৈতিক কোন্দল, অনৈক্য, রেষারেষি, দলাদলি, আঞ্চলিকতা, ষড়যন্ত্র, ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতা প্রভৃতি নানাবিধ কারণে বারবার বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা মারাত্মকভাবে বাঁধাগ্রস্ত হয়। ফলে একটি বিশ্ববিদ্যালয় পেতে গিয়ে সিলেটবাসীকে অপেক্ষা করতে হয় প্রায় ৫০ বছর!
আসাম প্রদেশের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়টি সিলেটে স্থাপনের দাবি ওঠার পর সমগ্র প্রদেশে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে আঞ্চলিকতা।
একদিকে বরাক উপত্যকাবাসী নিজেদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় দাবি করে, অপরদিকে সুরমা উপত্যকাবাসী হয়ে পড়ে দ্বিধাবিভক্ত। অহমীয়ারা চাইল বিশ্ববিদ্যালয়টি স্থাপিত হোক গৌহাটিতে। কিন্তু সুরমা উপত্যকায় একদল চাইল শিলঙে এবং অপর দলের দাবি বিশ্ববিদ্যালয়টি স্থাপিত হোক শ্রীহট্টে।
এই ত্রিমুখী দ্বান্দ্বিক পরিস্থিতিতে ১৯৪১ সালে তদানীন্তন শিক্ষামন্ত্রী সুনামগঞ্জের কৃতী সন্তান মৌলবি মুনাওওর আলী আসাম আইনসভায় বিশ্ববিদ্যালয়টি সিলেটে স্থাপনের সপক্ষে বক্তব্য দেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সরকারি উদ্যোগ স্তিমিত হয়ে পড়ে। এরপর হঠাৎ করেই বিশ্ববিদ্যালয়টি গৌহাটিতে স্থাপনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। এই পরিস্থিতিতে ১৯৪৫ সালে সিলেটে শিক্ষাব্রতী আন্দোলনের আহ্বান করা হয়। কিন্তু উদ্যোক্তাদের আত্মকলহের কারণে আন্দোলনটি ভেস্তে যায়। তখন মূলত জননেতা ব্রজেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর (সুনামগঞ্জের কৃতী সন্তান; পাইলগাঁও, জগন্নাথপুর; সিলেটের সরকারি মহিলা কলেজের প্রতিষ্ঠাতা) নেতৃত্বে সিলেটে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পুনঃউদ্যোগ গ্রহণ করা হয় এবং আন্দোলন জোরালো হয়ে ওঠে। কিন্তু তখনও নেতৃত্বের মধ্যে কোন্দল ও দলাদলির অবসান হয়নি। এপ্রসঙ্গে ব্রজেন্দ্রনারায়ণ লেখেন,
“১৯৪৫-এর আগস্টে শ্রীহট্টে পৃথক বিশ্ববিদ্যালয় করার জন্য বৃহৎ কনফারেন্স হয়। আসামের ভূতপূর্ব ডিপিআই স্মল সাহেব সাহায্য করেন। মুনাওওর আলী বিরোধিতা করেন। শেষপর্যন্ত হইল না।” (দ্র. ব্রজেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী, স্মৃতি ও প্রতীতি, পৃ. ১৫১-৫২)
এরপর অবশ্য ১৯৪৬ সালে সিদ্ধান্ত হয় আসাম বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হবে সিলেটে, কিন্তু দেশভাগের কারণে সেটি চলে গেল গৌহাটিতে।
পাকিস্তান আমলের শুরু থেকেই প্রদেশের দ্বিতীয় বিশ্ববিদ্যালয়টি সিলেটে স্থাপনের চেষ্টা চলতে থাকে। প্রথমে সরকারেরও সায় ছিল। কিন্তু হঠাৎ করে ১৯৫৩ সালে সেটি চলে গেল রাজশাহীতে। তখন গঠিত হয় সিলেট বিশ্ববিদ্যালয় বাস্তবায়ন সংগ্রাম পরিষদ এবং দাবি করা হয়, যেন প্রদেশের তৃতীয় বিশ্ববিদ্যালয়টি সিলেটে স্থাপন করা হয়। আন্দোলন চলতে থাকে। একপর্যায়ে আসে আইয়ুবের সামরিক শাসন।
১৯৬১ সালের নভেম্বর মাসে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোহাম্মদ আজম খান সিলেটে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা প্রদান করেন এবং ১৭ নভেম্বর তিনি ওই ঘোষণায় স্বাক্ষর করেন। পরের বছর মে মাসে গভর্নর আজম খান আকস্মিকভাবে পদত্যাগ করেন, তবে তার আগেই তিনি সিলেট বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন করেছিলেন। তাঁর পদত্যাগের সঙ্গে সঙ্গে সম্পূর্ণ ভোজবাজির মতো সিলেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইলটি চাপা পড়ে যায়। ওই সময় যুগপৎভাবে চট্টগ্রাম ও কুমিল্লায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের দাবি জোরালো হয়ে ওঠে। মন্ত্রীরাও নিজ নিজ এলাকায় বিশ্ববিদ্যালয়টি নিয়ে যাওয়ার জন্য তৎপর হয়ে ওঠেন। চলতে থাকে চক্রান্ত, রেষারেষি।
১৯৬২ সালের ১০ নভেম্বর সোহরাওয়ার্দী ও বঙ্গবন্ধু সিলেট সফরে এসে সিলেটবাসীর দীর্ঘদিনের বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবির প্রতি একাত্মতা পোষণ করেন। ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত হয় সিলেট বিশ্ববিদ্যালয় কনভেনশন।
১৯৬৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বিশ্ববিদ্যালয় স্থান নির্বাচন কমিশন সিলেট সফর করে। এরপর কমিশন কুমিল্লা এবং চট্টগ্রামেও যায়। তবে কমিশনের প্রতিবেদন ছিল অনেকটাই সিলেটের পক্ষে। ওই বছর ২৯ নভেম্বর চট্টগ্রামের ফজলুল কাদের চৌধুরী পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের স্পিকার মনোনীত হন। ১২ ডিসেম্বর সংসদে রাষ্ট্রপতির অনুপস্থিতিতে মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে সভাপতিত্বকালে তিনি চট্টগ্রামে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের নির্দেশ দেন। এরপর ১৯৬৪ সালের ১৭-১৯ জুলাই জাতীয় অর্থনৈতিক কাউন্সিল-সভায় চট্টগ্রামে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং চূড়ান্ত অনুমোদন প্রদান করা হয়। ওই সভায় পাকিস্তানের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসাবে সভাপতিত্ব করেন চট্টগ্রামের ফজলুল কাদের চৌধুরী। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ওই বছর ২৯ আগস্ট আনুষ্ঠানিকভাবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।
এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় বৃহত্তর সিলেটবাসী বিক্ষোভে ফুঁসে ওঠে। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য অপেক্ষা করতে হয় আরও দীর্ঘকাল। অতঃপর ১৯৮৭ সালে পাস হয় শাবিপ্রবি আইন।
সিলেটে বিশ্ববিদ্যালয় আন্দোলনের ইতিহাস থেকে আমরা কী শিক্ষা পাই? এখন সুনামগঞ্জবাসীরও সময় এসেছে এই বিষয়টি ভেবে দেখার। গত কয়েকদিন বিভিন্ন বয়সের বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে বুঝাতে পেরেছি- কাকে বলে Bigotry! কাকে বলে Fanaticism! এসব অপরিণামদর্শীরা মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয়টি তাদের নিজ নিজ পছন্দের জায়গায়তেই স্থাপিত হতে হবে, তা না-হলে অন্য জেলায় চলে যাক, তাতে তাদের নাকি কিছুই যায়-আসে না!
মতানৈক্য, মতান্তর, রেষারেষির ফল কখনোই শুভ নয়। আখেরে পস্তাতে হয়। কিন্তু তখন আর করার কিছুই থাকে না। আমাদের এটিও মনে রাখা প্রয়োজন যে, একজন এম. এ. মান্নান হুটহাট পাওয়া যায় না। একজন সৎ ও দক্ষ পরিকল্পনা মন্ত্রীও চাইলেই নিজ জেলায় হুট করে পাওয়া যায় না।
তাই বৃহত্তর স্বার্থে বিভেদ নয়, প্রয়োজন ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উপহার যাতে বিফলে না যায়- সেদিকেও সবার দৃষ্টি দেওয়া একান্ত প্রয়োজন। সর্বোপরি দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন, যেন কোনো কুচক্রীমহল জনগণের আবেগকে ব্যবহার করে জননেত্রী শেখ হাসিনার উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে বিঘ্নিত করতে না পারে।
লেখক: আইনজীবী, রাজনীতিবিদ ও গবেষক।